Latest News

ছ’টা ঋতুই তো আর নেই, এ কেমন আবহাওয়া বঙ্গে? কেন গ্রীষ্ম-বর্ষা-শীতের হিসেবই থাকছে না

চৈতালী চক্রবর্তী

‘ছয় ঋতু ফিরে ফিরে নৃত্য করে আসি/ নব নব পাত্র ভরি ঢালি দেয় তারা’..

ছ’টা ঋতু কি আর আছে? বর্ষাটা না হয় বোঝা গেল। কিন্তু গ্রীষ্ম, শীত, শরৎ, হেমন্ত, বসন্তের তফাৎটাই তো করা যাচ্ছে না। গরমকাল যেন কাটতে চাইছে না, মাঝে আকাশ কালো করে একদিন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হতে মনে হল বর্ষা এসেছে। কিন্তু কোথায় বর্ষা? ‘ওরে ঝড় নেমে আয় আয়রে আমার শুকনো পাতার ডালে’, বার বার ডাক দিয়েও ঝড় এল না, মেঘ জমল না, বৃষ্টিও হল না (Weather Change)।

Image - ছ'টা ঋতুই তো আর নেই, এ কেমন আবহাওয়া বঙ্গে? কেন গ্রীষ্ম-বর্ষা-শীতের হিসেবই থাকছে না
প্রযুক্তি-পরিবেশবিদ সৌমেন্দ্র মোহন ঘোষ

বাঙালির স্বপ্নের ঋতুরঙ্গে আজও ছয় ঋতুর খেলা। কিন্তু আবহাওয়াবিদরা বলছেন, এ বঙ্গে ছয় ঋতুই আর নেই। বাংলার দুর্গাপুজো ভাবতে বাধ্য করে পেঁজা তুলোয় ভেসে শরৎ এসেছে, কিন্তু আদৌ কি শরৎ-সুলভ আবহাওয়া আর এখন আছে? মাঝে হেমন্ত কালকে বেমালুম ভুলে গেছে বঙ্গবাসী। সে আদৌ আসে কিনা তা টের পাওয়া যায় না। হেমন্তকে টপকে ঝুপ করে একদিন শীত আসে। সঙ্গে নিয়ে আসে গরমকেও। শুরু হয় শীত-গরমের লুকোচুরি। এই শীত, তো এই গরম। কনকনে উত্তুরে হাওয়ার আমেজ গায়ে মাখতে না মাখতেই সূর্যের তেজ এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয়। বঙ্গবাসী হাপিত্যেশ করে থাকে শীতের জন্য। কবির বুলি আউরে চাতকের মতোই বলে, ‘শীত কবে আসবে সুপর্ণা?’ ভোরে কোকিলের ডাক, দুপুরে চড়া রোদ, সন্ধে নামলেই ঘ্যাঁঘর-ঘ্যাঙ ব্যাঙের ডাকে শীতের হাওয়া পাক খেয়েই মিলিয়ে যায়। ভোরের শীত দুপুরে মিলিয়ে যায় কখন টের পাওয়া যায় না। এই করেই বসন্ত পার হয়ে যায় নিঃশ্চুপে। লাল পলাশের দিন বুঝতে না বুঝতেই গরম এসে যায় (Weather Change)।

কেন আবহাওয়ার এত বদল হচ্ছে? বাংলায় কেন বারে বারে ভোল বদলাচ্ছে আবহাওয়া? কেন শীত-গরমের এই অদ্ভুত লুকোচুরি চলছে? সবকিছুই ব্যাখ্যা করলেন প্রযুক্তি-পরিবেশবিদ সৌমেন্দ্র মোহন ঘোষ।

weather - Cyclone Asani is unlikely to hit West Bengal - Telegraph India

জলবায়ু বদলটাই যত নষ্টের গোড়া

বাংলায় আজ আবহাওয়ার সঙ্গে ‘খামখেয়ালি’ ট্যাগ জুড়ে দেওয়া হয়েছে। চায়ের দোকানে আড্ডায় তুফান ওঠে, ‘সেই আগের মতো ওয়েদার আর নেই!’ পরিবেশবিদ সৌমেন্দ্রবাবু বলছেন, বাংলার আবহাওয়া কয়েক বছর আগেও এমন ছিল না। বাংলা কেন, সারা দেশ, বিশ্বের বিভিন্ন শহরের আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি বদলাচ্ছে। এর সবচেয়ে বড় কারণ হল জলবায়ু বদল। সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বাড়ছে, সমুদ্রের জলের তাপমাত্রাও বেড়েছে, মেরু প্রদেশে বরফ গলছে, কাজেই এর ভয়ঙ্কর প্রভাব দেখা দিচ্ছে। গত ৫০ বছরে মেরুপ্রদেশের তাপমাত্রা বেড়েছে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আন্টার্কটিকের এসপেরানজা বেসের অবস্থা বিপজ্জনক জায়গায় দাঁড়িয়েছে। তার ওপর গ্রিন হাউস গ্যাসের বাড়বাড়ন্ত তো রয়েছেই। এইসব কিছুই আবহাওয়ার ভোলবদলের অন্যতম প্রধান কারণ।

Impact of climate change apparent in nearly all weather-linked fluctuations  Earth, study says - UPI.com

শীত কি উবেই যাবে একসময়? শীতের সন্ধেয় এত গরম কেন?

পরিবেশবিদ সৌমেন্দ্রবাবুর কথায়, ছয় ঋতুর ঋতুরঙ্গ আর নেই। এখন শুধু হাতে গোনা তিনটে ঋতু–গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীত। এর মধ্য়ে গরমকালটা সবচেয়ে বেশি। বর্ষা এখন খামখেয়ালি হয়ে গেছে। আর শীতকাল। গরম যেন কাটতে চায় না। তাপমাত্রা বেড়েই চলে। আর শীত থাকতেই চায় না। পালাই পালাই করে।

উত্তর ভারতে তেড়ে বরফ পড়ছে, কিন্তু কলকাতা সহ গোটা বাংলায় গরম। এর কারণ হল, সমুদ্রের জলের উষ্ণতা অনেক বেড়ে গেছে। সাধারণত সমুদ্র উপকূলবর্তী জায়গাগুলোতে গরম বাড়ছে। কলকাতা থেকে কাছাকাছি সমুদ্রতট প্রায় ২০০ কিলোমিটারের মধ্যে, আবার সমুদ্র থেকে ৩০০-৪০০ কিলোমিটার দূরেও রয়েছে যে শহর বা জেলাগুলো, সেখানেও গরমের আঁচ এসে পড়ছে কারণ সমুদ্রপৃষ্ঠ ও সমুদ্রের জলের তাপমাত্রা বেড়ে চলেছে।

আরও একটা কারণ হল, গরম হাওয়া খুব বেশিক্ষণ থমকে থাকছে পরিবেশে। আগে গরম ও শীতল হাওয়ার আদলবদল হত। গরম হাওয়া ওপরে উঠে গেলে তার জায়গা নিত শীতল হাওয়া। কিন্তু এখন, গরম হাওয়াই আটকে পড়ছে পরিবেশে। যে কারণে পরিবেশের তাপমাত্রাও বাড়ছে।

It's unlikely Washington will have another extreme heat wave this summer |  king5.com

নগরোন্নয়ন আটকে রাখছে গরমকে, শীত আসবে কি করে?

সহজ করে বললে, এখন সবুজ প্রকৃতিপ জায়গায় চুন-সুড়কি-ধাতুর নগরোন্নয়ন ঘটছে। এই ইট-পাথরের জঙ্গলে আটকে পড়ছে গরম। পরিবেশ থেকে গরম হাওয়া বেরিয়ে যাওয়ার জায়গা চাই। তাকে চারদিক থেকে আটকে দিচ্ছে বড় বড় বাড়ি, ধাতব টাওয়ার, শপিং মল। পরিবেশবিদ সৌমেন্দ্রবাবু বলছেন, আগে কাঠ বা ইটের বাড়ি হত, এখন প্রযুক্তি যত উন্নত হচ্ছে তত বেশি ধাতুর ব্যবহার হচ্ছে। অ্যালুমিনিয়াম জাতীয় ধাতুর ব্যবহার এখন বেশি যা দীর্ঘ সময় তাপমাত্রা ধরে রাখতে পারে। ফলে পরিবেশ শীতল হওয়ার সময়ই পাচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে, শীতকালেও বিকেল বা সন্ধের পরে তাপমাত্রা বাড়ছে।

বৃষ্টি কেন সব জায়গায় সমানভাবে হচ্ছে না

বর্ষাকালও এখন খামখেয়ালি। সব জায়গায় সমানভাবে বৃষ্টি হচ্ছে না। উত্তরের জেলাগুলো যখন ভেসে যাচ্ছিল, তখন দক্ষিণ ছিল খটখটে শুকনো। মাঝে দু’বার কালবৈশাখীর ঝাপটা এসেছে। আবার দক্ষিণে যখন বৃষ্টি শুরু হল, তখনও সব জায়গায় সমানভাবে হল না।

North Bay of Bengal received more rain than any part of India in last  10,000 years - India Today

পরিবেশবিদের মতে, দেশজুড়েই বৃষ্টির তারতম্য দেখা যাচ্ছে। হাওয়া অফিস এর জন্য তীব্র তাপপ্রবাহ, বাতাসের গতি কমে যাওয়া, জলীয়বাষ্পের আধিক্য, সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার মধ্যে পার্থক্য কমে যাওয়াকেই দায়ী করছে। তবে গোড়ার কথা হল, ইভাপোরেশন বা বাষ্পমোচন এবং কনডেনসেশন বা ঘনীভবনের তারতম্য। সহজ করে বললে, গাছ কেটে ফেলাই সর্বনাশের কারণ। গাছ ভূমিক্ষয় রোধ করে এবং বৃষ্টি আনতেও সাহায্য করে। কীভাবে?

মূলত দুটি প্রক্রিয়ায় বৃষ্টি আনতে সাহায্য করে থাকে। ইভাপোরেশন বা বাষ্পমোচন এবং কনডেনসেশন বা ঘনীভবন। গাছ মূল দ্বারা শোষিত জলের ১০ শতাংশ সালোকসংশ্লেষ করতে ব্যবহার করে বাকি ৯০ শতাংশ বাষ্পের আকারে প্রকৃতিতে ছড়িয়ে দেয়। এতে বাতাসে ভাসমান জলীয়কণার পরিমাণ বাড়ে। যা বৃষ্টির প্রধান উপাদান । বাতাসে জলের পরিমাণ বাড়ার ফলে এলাকার তাপমাত্রা কমে। এতে বাষ্প ঘনীভূত হয়ে জলকণায় পরিণত হয় এবং ভারী হয়। ফলে বাতাস আর ধরে রাখতে পারে না তখন বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে। এজন্য মরুভূমির থেকে বনভূমিতে বৃষ্টি বেশি হয়।

কিন্তু ইদানীং সময়ে যত্রতত্র গাছপালা কেটে ফেলা হচ্ছে। তাই গাছ যেখানে কম, সেখানে বাস্তুতন্ত্রও বিগড়ে যাচ্ছে। ফলে বৃষ্টির পরিমাণ কমছে। তাই রাজ্যজুড়েই খাপছাড়া বৃষ্টি হচ্ছে।

হিট-আইল্যান্ড কলকাতা

এ বছর সবচেয়ে উষ্ণ জানুয়ারি দেখা গেছে। বাংলা শুধু নয়, ইউরোপিয় দেশগুলো যেমন পোল্যান্ড, ডেনমার্ক, চেক প্রজাতন্ত্র, নেদারল্যান্ড, ল্যাটিভা, লিথুয়ানিয়াতেও জানুয়ারি মাসে তাপমাত্রা বেড়েছে।

আফ্রিকার পশ্চিম উপকূল থেকে গরম বায়ু বা তাপপ্রবাহের স্রোত পর্তুগাল-স্পেন হয়ে উত্তর-পূর্ব ইউরোপের উপর দিয়ে বয়ে গেছে। ফলে তাপমাত্রার পারদ চড়েছে। সমুদ্রের জলের তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণই এর জন্য দায়ী। ঠিক তেমনটাই হয়েছে এ দেশেও। গাছ কেটে নগরোন্নয়নই কলকাতা সহ বাংলার খামখেয়ালি আবহাওয়ার কারণ। এই কারণেই কলকাতা এখন হিট-আইল্যান্ড হয়ে গেছে। আগামী কয়েক বছরেও যদি উষ্ণায়ণকে রোখা না যায়, তাহলে আরও চরম পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে সকলকে।

You might also like