
সাবিনা ইয়াসমিন রিংকু
বর্ষাকাল এলে ঠিক কখন, কোন মুহূর্ত থেকে পূবালি বাতাস বইতে শুরু করবে! কখন গর্ভবতী ইলিশ লেজ নাচাতে নাচাতে সমুদ্র থেকে মোহনার দিকে ডিম পাড়তে পাড়ি দেবে! কখন জেলেরা ওৎ পেতে থাকবে আর ঝপাস করে জাল ফেলে খপাস করে ইলিশ ধরবে… এ সবের তোয়াক্কা করতেন না ঢাকার সিদ্দিকুল্লা সাহেব। করোনা আসার আগেকার কথা বলছি। কাওরান বাজারে ভালো সাইজের ইলিশ উঠলেই তিনি বিবির হেল্প নিয়ে তিন চার রকমের পদ রেঁধে বসিরের হাত দিয়ে মেয়ের বাড়ি পাঠিয়ে দিতেন। বসির শেখ সিদ্দিকুল্লা সাহেবের ছোটো শ্যালক। তাঁর কাছেই থাকে। দুলহাভাইয়ের ব্যবসার কাজে সাহায্য করে। একটু বোকাসোকা। কিন্তু পাগল নয়। প্লেনে দিব্যি যাতায়াত করতে পারে। প্লেনে চেপেই তো সে তার জামাইবাবুর মেয়ের কাছে ইলিশের রকমারি পদ পৌঁছে দেয়! দুলহাভাইয়ের মেয়ে থাকে কোথায়? কলকাতার বেকবাগানে।
ঢাকা থেকে প্লেনে কলকাতা সাকুল্যে পঁয়ত্রিশ মিনিট। বাড়ির গাড়ি পাঠালে আর জ্যাম না থাকলে এয়ারপোর্ট থেকে বাইপাস হয়ে বেকবাগান পৌঁছতে লাগে ২৫ থেকে ৩০ মিনিট।আমরা যারা এসব ঘটনার সাক্ষী, তারা হিংসেয় জ্বলে মরতাম। পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে থেকেও আমাদের কারও বাপের বাড়ি ট্রেনে সাড়ে চার ঘণ্টা, কারও বাসে তিন ঘণ্টা। তারপর টোটো বা ভ্যানে আরও কুড়ি মিনিট। মা ভালোমন্দ খাবার বেঁধেছেদে দিলে কলকাতায় আনতে আনতে ট’কে যায় কিংবা সে খাবার মুখে তোলার মতো অবস্থায় আর থাকে না।
এদিকে ঢাকা থেকে হটপটে পদ্মার ইলিশের রকমারি পদ কলকাতায় আসছে কারও এক আদরের দুলালির কাছে… এমনতরো রূপকথা আমাদের সহ্য হত না। এই ব্যাপারটা নিয়ে আমাদের মধ্যে ফোনে চর্চা হত। “বাপটার মনে হয় অনেক টাকা!”
আমাদের মধ্যে কেউ একজন বলত, “নিশ্চয়ই ঘুষ খায় নইলে লোকের টাকা মেরে বড়লোক।” আমরা নিজেরা কতোটা ছোটলোক হলে অচেনা অজানা মানুষের সম্বন্ধে এইসব আলোচনা করি… সেটা একবারও ভাবতাম না। রকমারি ইলিশের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে আমাদের ভাবনাগুলো অন্য স্রোত ধরে এগোতে চাইত। কিন্তু পদ্মার ইলিশের ডিমভরা পেটি আর ঝিরিঝিরি পেঁয়াজের বিছানায় নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকা এত্ত বড় ইলিশের খণ্ড আমাদের থামিয়ে দিত।ইলিশের মধ্যে পেঁয়াজ শুনলে অনেকেই নাক তোলেন। তুলবেন না। বরং ভালো দেশি পেঁয়াজ পেলে একেবারে মিহি ঝিরিঝিরি করে কেটে একচিমটে নুন মাখিয়ে রাখুন। এবার যে কড়াইতে মাছ রান্না করবেন, সেটাতে কিছুটা সর্ষের তেল ঢালুন। তারপর নুন হলুদ মাখানো ইলিশের খণ্ড, কেটে রাখা পেঁয়াজ, বেশ কয়েকটা কাঁচালংকা ওই সর্ষের তেলের মধ্যে রেখে হাত দিয়ে ভালো করে মেখে নিন। হাত-ধোয়া জলটুকুও দিয়ে দিন। গ্যাস অন করে কড়াই ঢেকে দিন। তিন চার মিনিট পর আঁচ ঢিমে করে দিয়ে আপনার বাকি কাজগুলো সেরে নিন। মাঝে একবার ইলিশের টুকরোগুলো সাবধানে উল্টে দিয়ে আবার ঢেকে দিন। পেঁয়াজ মাখনের মতো মোলায়েম হতে একটু সময় লাগে। পেঁয়াজ নরম হয়ে এলে নামিয়ে নিন। পেঁয়াজ কিন্তু গলে যাবে না। অথচ তুলতুলে হয়ে যাবে। যখন পেঁয়াজের কাঁই দিয়ে ভাত মাখবেন,তখন বুঝবেন পেঁয়াজের মাখন কী জিনিস! ইলিশগন্ধী পেঁয়াজের সে এক আলাদা ক্যারিশমা।
সেই বাংলাদেশের মেয়ে যে কিনা ইন্ডিয়ার বউ, তার জন্য তিন থাকের টিফিনবক্সে তিনরকম ইলিশের আইটেম থাকত। ইলিশ ভাজা, ইলিশের ঝোল, কোনও একটা সবজি দিয়ে ইলিশের তরকারি।মাঝেমাঝে মানকচু আর সর্ষেবাটা দিয়ে ইলিশের ঝোলও থাকত। আগের রাতে ভিজিয়ে রাখা মেথির দানা দিয়ে ইলিশের তরকারি খেয়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। ভালো লেগেছিলো লাউ দিয়ে ইলিশের মাথা।
চিরকাল সর্ষেবাটা দিয়ে ইলিশ মাছের পাতুরি খাওয়ার অভ্যেসে নতুন চমক লাগিয়েছিল ওই বেকবাগানের বৌটি’র আম্মি। আম্মির হাতের বানানো তিলবাটা দিয়ে ইলিশ মাছের পাতুরি খেয়ে দিল হারা হারা হয়ে গিয়েছিল।
কোনও কোনও সময় টিফিনবক্সে থাকতো ইলিশের ডিমের লুকা পাতুরি, ইলিশের টক, ইলিশের ল্যাজা ভর্তা। সেই ইলিশের সাইজ দেখে গঙ্গার ইলিশখেকো আমরা ভিরমি খেতাম। মাছের গা’গুলো ছিল সুখি মেয়েমানুষের ত্বকের মতো তেলালো। তেমনই তার গন্ধ। আমরা অনেকেই ভাগ পেতাম সেই মাছের। দূরে থাকা মেয়ের জন্য ব্যাকুল বাবামায়ের ভালোবাসা লেগে থাকত সেই রান্নায়। সেই ব্যাপারটাই ওই সাধারণ রান্নাগুলোকে ভীষণরকমভাবে বিশেষ করে তুলতো।এখন বাজারে খোকা আর ধেড়ে, দুরকমেরই ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। শরতের গায়ে শ্রাবণের প্রলেপ লেগেছে বেশ কিছুদিন ধরেই। ইলিশ খাওয়ার জবরদস্ত সময় রচনা করে দিয়েছে প্রকৃতি।
চলুন আজ একটু অন্যভাবে ইলিশ খাওয়া যাক।
চালকুমড়ো ইলিশ
উপকরণ: একটা কচি চালকুমড়ো ঝিরি ঝিরি করে কাটা, চার টুকরো ইলিশ মাছ, সাদা সর্ষে বাটা ১ টেবিল চামচ, নারকেল বাটা ১ টেবিল চামচ, নুন, হলুদ গুঁড়ো, কাঁচালংকা, সর্ষের তেল পরিমাণমতো।
প্রণালী: কড়াইতে সর্ষের তেল গরম করে চালকুমড়ো দিয়ে একটু ভাজা ভাজা করে নিতে হবে। তারপর নুন, হলুদগুঁড়ো, সাদা সর্ষেবাটা, কাঁচালংকা দিয়ে কষতে হবে। চালকুমড়ো নরম হয়ে এলে ওর মধ্যে মাছগুলো দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। আলাদা করে জল দেবার প্রয়োজন পড়ে না। চালকুমড়োর মধ্যেই প্রচুর জল থাকে। একটু পর কড়াইয়ের ঢাকনা খুলে মাছগুলো আলতো হাতে উল্টে দিতে হবে। শেষে নারকেলবাটা দিয়ে ঝোলটা একটু ফুটিয়ে নামাতে হবে।
তিলবাটা দিয়ে ইলিশ মাছের পাতুরি
উপকরণ: যতগুলো পাতুরি বানাতে চান ততোগুলো ইলিশ মাছ নিন। নুন, হলুদ গুঁড়ো, কাঁচালংকা বাটা, জিরেগুঁড়ো, বেশ খানিকটা তিলবাটা, সর্ষের তেল, আস্ত কাঁচা লংকা, একটা বড় সাইজের কলাপাতা।প্রণালী: একটা বড় বাটিতে মাছগুলোর মধ্যে নুন,হলুদ, জিরের গুঁড়ো,লঙ্কাবাটা,তিলবাটা ,কিছুটা কাঁচা সর্ষের তেল মাখিয়ে আধঘণ্টা রেখে দিন।
তারপর গ্যাসে কলাপাতাটাকে সেঁকে নিয়ে পাতাটার ওপর তেল ব্রাশ করে মাছের টুকরোগুলো পর পর সাজিয়ে মাছ পিছু একটা করে চেরা কাঁচা লঙ্কা দিন। তারপর পাতাটা মুড়িয়ে সুতো দিয়ে বেঁধে নিন। এবারে একটা ননস্টিক প্যানে পাতাটা উল্টে পাল্টে পুড়িয়ে নিন।
ইলিশ মাছের ল্যাজা ভর্তা
অনেক সময় ফ্রিজে একটা দুটো ইলিশের লেজ পড়ে থাকে। প্রচুর কাঁটার কারণে কাতলার লেজের মতো ইলিশের লেজ চিবিয়ে চুষে খেয়ে মজা নেই। অথচ ইলিশ মাছের লেজের ভর্তা করলে দেখবেন বাড়ির মেম্বাররা ইলিশের পেটি ছেড়ে লেজভর্তা দিয়ে পুরো ভাত খেয়ে উঠে যাচ্ছেন। ট্রাই করে দেখতে পারেন।
উপকরণ: ইলিশ মাছের লেজ ২ খানা, নুন, হলুদ গুঁড়ো, শুকনো লংকার গুঁড়ো, ২ টো শুকনো লঙ্কা, ১ টা কাঁচালংকা, ঝিরিঝিরি করে কাটা বড় সাইজের পেঁয়াজ ১টা, অল্প সর্ষের তেল, ১ টেবিল চামচ ধনেপাতা।প্রণালী: ইলিশ মাছের লেজদুটোতে নুন, হলুদগুঁড়ো, শুকনোলঙ্কার গুঁড়ো মাখিয়ে তেলে ভেজে নিন। ভীষণ কড়া করে ভাজবেন না। তেল থেকে তুলে ঠান্ডা হলে কাঁটা বেছে রাখুন। বিরক্ত হবেন না। ইলিশের লেজে ছোটো কাঁটা থাকে না। একটু লম্বা কাঁটা থাকে। দেখবেন খুব সহজেই বেছে ফেলতে পারবেন। এবারে ইলিশ ভাজার তেলেই দুটো শুকনোলংকা মুড়মুড়ে করে ভেজে তুলুন। ওই তেলেই কেটে রাখা পেঁয়াজ একটু নেড়েচেড়ে নিন। সঙ্গে একটা কাঁচালংকাও নেড়েচেড়ে নিন। পেঁয়াজ সাদা থাকতে থাকতেই তেল থেকে তুলে নিন। এবার একটা প্লেটে একটু নুন দিয়ে শুকনোলংকা দুটোকে মুচড়ে নিন। ওর মধ্যে কাঁটা ছাড়ানো মাছ, পেঁয়াজ ভাজা আর কাঁচালংকা ভাজাটা দিয়ে সবগুলো একসঙ্গে ভালো করে মেখে ভর্তা করে নিন। ভর্তাটাকে দুভাগ করুন। একটা ভাগের মধ্যে কুচোনো ধনেপাতা মেশান।
এবার একটা ভর্তা ধনেপাতা দিয়ে, আর একটা ধনেপাতা ছাড়া… আলাদা আলাদাভাবে গরম ভাতের সঙ্গে খেয়ে দেখুন। যদিও ইলিশ মাছে ধনেপাতা একদম যায় না। কিন্তু আশ্চর্য ভাবে ইলিশের ল্যাজা ভর্তার সঙ্গে ধনেপাতা একেবারে খাপে খাপ হয়ে আপনার রসনায় একরাশ মুগ্ধতা ছড়িয়ে দেবেই।
লেখিকা পেশায় স্কুলশিক্ষিকা, ভালোবাসেন রকমারি রান্না আর রন্ধনবিষয়ক আড্ডা।
https://three.pb.1wp.in/opinion/blog/opinion-blog-about-some-exclusive-veg-nonveg-recipes-with-festive-mood/