
দিব্যেন্দু ভৌমিক, কোচবিহার
জন্ম থেকেই চোখে দেখেন না। বেশ কয়েক বার অপারেশন করালেও দৃষ্টি ফিরে পাননি। চোখে পঁচানব্বই শতাংশ অন্ধকার। সরকারি খাতায় একশো শতাংশ প্রতিবন্ধী এক সময় আকাশবাণীর শিল্পী যোগেন্দ্রনাথ সরকার। এখন কোচবিহারের পথে পথে গান গেয়ে ভিক্ষা করাই তাঁর পেশা।
জন্ম থেকে পৃথিবীর রূপ-রং দেখা হয়নি প্রায় জন্মান্ধ যোগেন্দ্রনাথের। পরে অনেক চেষ্টাতেও দৃষ্টি ফিরে পাননি। সরকারি ভাবে তিনি একশো শতাংশ প্রতিবন্ধী তবে রক্তে তাঁর গানের নেশা। জীবনের একটা বড় সময় কলকাতায় আকাশবাণীতে তিনি গেয়েছেন লোকগীতি। তখন তিনি ছিলেন শিলিগুড়ির বাসিন্দা। তাঁর বাবা শিলিগুড়িতে মৎস্য বিভাগে কর্মরত ছিলেন। বাবার অকাল প্রয়াণে প্রথাগত শিক্ষায় তাঁর ইতি হয়ে যায়।
মালদহের এক চিকিৎসক তাঁর দৃষ্টি ফেরাতে চার বার চোখ অপারেশন করেন। তবে দৃষ্টি ফেরেনি। পরে তিনি চলে আসেন কোচবিহার ১ নম্বর ব্লকের গুড়িয়াহাটির নতুনপল্লির বাড়িতে। সংসার চালাতে এবার তাঁকে জীবন সংগ্রামে নামতে হয়। আকাশবাণীতে তাঁর গান গাওয়ার পাট যখন চুকে যায় তখন তিনি আক্ষরিক অর্থেই পথে নামেন।
বিভিন্ন হাটে, বাজারে, ট্রেনের কামরায় কামরায় তিনি গাইতে শুরু করেন দোতারা নিয়ে। তবে করোনাভাইরাসের জন্য দেশজুড়ে লকডাউন শুরু হওয়ায় সেই পথও বন্ধ হয়ে যায়। বছর পঞ্চান্নর শিল্পী এখন ব্যাগে করে অ্যামপ্লিফায়ার, পোর্টেবল ইকোসিস্টেম, ব্যাটারি ও কর্ডলেস মাইক্রোফোন নিয়ে বের হন। কোচবিহারের পথে কোথাও বেশি শব্দ শুনলে নেমে পড়েন টোটো থেকে। হাতড়ে হাতড়ে ব্যাগ থেকে বের করে আনেন গানের নানা সরঞ্জাম। গান ধরেন এক সময় আকাশবাণীর শিল্পী। এখন তিনি গান বেঁধেছেন করোনা সচেতনতা নিয়ে। গান শেষ হলে পথ চলতি মানুষ শিল্পীকে দেন পাঁচ-দশ টাকা। অনেকে দেনও না। এক সময় যে তাঁর গলার স্বর শোনা যেত বেতারে সে খোঁজই বা ক’জন রাখেন!
নাট্য ব্যক্তিত্ব কল্যাণময় দাস বলেন, “এক সময় লোকগীতি, পল্লিগীতি ও ভাওয়াইয়া শিল্পী হিসাবে তাঁর কদর ছিল।” শিল্পী যোগেন্দ্রনাথ বলেন, “এখন ৯৫ শতাংশ দৃষ্টিশক্তি নেই। বাড়িতে স্ত্রী ও দুই ছেলেমেয়ে আছে। ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাই। বাবা মারা যাওয়ার পরে আমার পড়াশোনা এগোয়নি। ভিক্ষা করে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করাই। মাসে এক হাজার টাকা করে শিল্পী ভাতা পাচ্ছি। করোনার সময় গান গেয়ে মানুষকে সচেতন করছি।” তিনি জানালেন এখন ফোনে কথা হয় এক সময় যাঁরা আকাশবাণীতে তাঁর সহশিল্পী ছিলেন তাঁদের কারও কারও সঙ্গে।
স্মৃতিচারণ করেন শিল্পী, “একবার আকাশবাণীতে অনুষ্ঠান করে ফিরছি কিন্তু পকেটে পয়সা নেই। চিন্তা করছি কী খাব। ওঁরা ট্রেনের টিকিট কেটে দিয়েছেন। দোতারা নিয়ে প্রথম শ্রেণীর কামরায় গান ধরি। আমি তো জানতাম না ওই কামরায় শিল্পী পরীক্ষিৎ বালা আছেন। গান শেষ হতে উনি আমাকে ডেকে কথা বলেন। পরে বেশ কয়েক বার ওঁর সঙ্গে গাইবার ভাগ্য হয়েছে।”
কোচবিহারের জেলা তথ্য ও সংস্কৃতি আধিকারিক সন্তু বিশ্বাস বলেন, “উনি শিল্পী। প্রতি মাসে শিল্পীর ভাতা পান।”