
দেশের তৃতীয় টিকা, ভেক্টর ভ্যাকসিন ‘স্পুটনিক ভি’ কেমন, কীভাবে তৈরি করেছে রাশিয়া
দ্য ওয়াল ব্যুরো: অক্সফোর্ড টিকা তথা দেশের তৈরি কোভিশিল্ড এবং ভারত বায়োটেকের কোভ্যাক্সিনের পরে রুশ টিকা স্পুটনিক ভি ছাড়পত্র পেয়েছে দেশে। কেন্দ্রীয় ড্রাগ নিয়ামক সংস্থার বিশেষজ্ঞ কমিটির পরীক্ষায় পাশ করে গেছে রাশিয়ান ভাইরাল ভেক্টর ভ্যাকসিন। বিশ্বের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ স্পুটনিকের নামে এই ভ্যাকসিনের নামকরণ করেছে রাশিয়া। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যখন প্রথম তাদের করোনার প্রতিষেধক এই স্পুটনিক ভ্যাকসিনের কথা ঘোষণা করেন, তখন তা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক-সমালোচনাও হয়। টিকার কার্যকারিতা নিয়ে নানা প্রশ্নও ওঠে। কিন্তু এখন সেসব বিতর্ক থেমে গেছে, বরং রুশ টিকাকে সুরক্ষিত বলে ঘোষণা করেছে অনেক দেশই।
রুশ ভ্যাকসিন নির্মাতা সংস্থা গ্যামেলিয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তৈরি স্পুটনিক ভি ভ্যাকসিন কেমন, সেটাই এখন আমজনতার প্রশ্ন। কোভিশিল্ড ও কোভ্যাক্সিনের যাবতীয় তথ্য এতদিনে দেশবাসী জেনে গিয়েছে। অজানা রুশ ভ্যাকসিনের খুঁটিনাটি। অনেকেই বলছেন, অক্সফোর্ডের টিকাও তো ভেক্টর ভ্যাকসিন তাহলে রুশ টিকার বিশেষত্ব কোথায়? তফাৎ আছে, স্পুটনিক টিকাও ভাইরাল ভেক্টর ভ্যাকসিন কিন্তু তৈরি হয়েছে বিশেষ পদ্ধতিতে।
পর পর ধাপগুলো জেনে নেওয়া যাক—
ভাইরাসের জিনের খবর শরীরে পৌঁছে দেবে স্পুটনিক ভি
গ্যামেলিয়ার তৈরি এই ভ্যাকসিনের নাম গ্যাম-কোভিড-ভ্যাক (Gam-Covid-Vac)। অ্যাডেনোভাইরাসকে ভেক্টর হিসেবে ব্যবহার করে তৈরি হয়েছে এই ভ্যাকসিন। শরীরে ঢুকলে করোনার মতো স্পাইক প্রোটিন তৈরি করে শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে সক্রিয় করে তোলে। এটা হল স্পুটনিক ভ্যাকসিনের গোড়ার কথা। মোডার্না ও ফাইজারের ভ্যাকসিনের ডোজও শরীরে ঢুকলে স্পাইক প্রোটিনের অনুরূপ প্রোটিন তৈরি করে কিন্তু স্পুটনিকের মতো নয়। কারণ মোডার্না-ফাইজারের ভ্যাকসিন শরীরে ঢুকে আরএনএ (সিঙ্গল-স্ট্র্যান্ডেড) প্রোটিন তৈরি করে আর স্পুটনিক বানায় ডিএনএ (ডবল-স্ট্র্যান্ডেড)। স্পুটনিক ভ্যাকসিন যে প্রোটিন বানায় তার মধ্যে ভাইরাসের জেনেটিক ইনফরমেশন বা জিনগত তথ্য থাকে। এই প্রোটিনের খোঁজ পেলেই শরীরের ইমিউন কোষ (বি-কোষ বা টি-কোষ)তেড়েফুঁড়ে উঠে প্রোটিনের আগাগোড়া ভাল করে চিনে রাখে। সংক্রামক ভাইরাল প্রোটিন ঠিক কেমন, তার বিরুদ্ধে কেমনভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে তার একটা ছকও সাজিয়ে নেয়।
দু’রকম অ্যাডেনোভাইরাস নিয়ে তৈরি
এবার দেখে নেওয়া যাক, ভ্যাকসিন তৈরি হল কীভাবে। রুশ ভাইরোলজিস্টরা দুরকম অ্যাডেনোভাইরাস (মামু সর্দি-কাশির ভাইরাস, কম সংক্রামক)দিয়ে ভেক্টর ভ্যাকসিন বানিয়েছেন। সেটা কেমন? এডি২৬ (AD26) ও এডি৫ (AD5)—এই দুই রকম অ্যাডেনোভাইরাসের ডিএনএ-র সঙ্গে করোনার স্পাইক প্রোটিনের টুকরো বিশেষভাবে মিশিয়ে ভ্যাকসিন তৈরি হয়েছে। করোনার স্পাইক প্রোটিন প্রাণঘাতী, তাই এই প্রোটিন সরাসরি শরীরে ঢুকলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। ভাইরাল প্রোটিন সংখ্যায় বেড়ে কোষগুলোকে আক্রমণ করবে। তাই অ্যাডেনোভাইরাসের সঙ্গে যদি ভাইরাল প্রোটিন মিশিয়ে দেওয়া হয় তাহলে তার সংক্রামক ক্ষমতা কমে যাবে। আর অ্যাডেনোভাইরাসকেও নিষ্ক্রিয় করে নেওয়া হয় যাতে তারও কোনওরকম খারাপ প্রভাব মানুষের শরীরে না পড়ে। দু’রকম অ্যাডেনোভাইরাস আর করোনার স্পাইক মিলে যে ভ্যাকসিন ডিজাইন করেছেন রুশ ভাইরোলজিস্টরা তার কাজ দুটো—প্রথমত শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে সক্রিয় করা, দ্বিতীয়ত—অ্যান্টিবডি তৈরি করে রোগ প্রতিরোধ করা।
ভ্যাকসিনের ডোজ ঢুকছে কোষে…তারপর
স্পুটনিক ভি তৈরি হল এবার মানুষের শরীরে কেমনভাবে কাজ করবে সেটাই দেখার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভ্যাকসিনের ডোজ মানে হল অ্যাডেনোভাইরাস ও করোনার প্রোটিনের মিশ্রণ শরীরে ঢুকে সরাসরি কোষে প্রবেশ করবে। আগেই বলা হয়েছে, এই ভ্যাকসিন কোষে ঢুকে ডিএনএ ইনজেক্ট করবে। এই ডিএনএ-র তথ্য ভাল করে বুঝে নিয়ে আমাদের দেহকোষ তাকে বার্তাবহ আরএনএ (mRNA)-তে বদলে দেবে। এই আরএনএ হবে ঠিক করোনার প্রোটিনের মতো। তাকে দেখে কোষও করোনার মতো স্পাইক তৈরি করবে, তাকে দেখতেও হবে অনেকটা ভাইরাসের মতো।
এই ধরনের কোষকে শরীরে ঘুরঘুর করতে দেখলে স্বভাবতই আমাদের রোগ প্রতিরোধী কোষগুলি জীবন্ত হয়ে উঠবে। ইমিউন সিস্টেমের কাছে বার্তা যাবে, ভিনদেশী প্রোটিন শরীরে ঢুকে গেছে, এবার তাকে কব্জা করো। এই সিগন্যাল পেয়ে প্লাজমায় বি-কোষ বিভাজিত হয়ে অ্যান্টিবডি তৈরি শুরু করবে। সক্রিয় হবে টি-কোষ বা টি-লিম্ফোসাইট কোষও।
অন্যদিকে, কোষে তৈরি করোনার মতো প্রোটিনের অংশগুলো যত ছড়িয়ে পড়তে শুরু করবে, বি-কোষ ও টি-কোষ ততই দ্রুত রোগ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে থাকবে। শরীরের ভেতর একটা সুরক্ষা বলয় তৈরি হবে। করোনার মতো প্রোটিনগুলোকে ঘিরে ধরবে অ্যান্টিবডি। তারপর তাদের মাথায় চড়ে বসে একটা একটা করে প্রোটিন নষ্ট করতে থাকবে। এইভাবে শরীরে ইমিউন রেসপন্স তৈরি হবে মানে ভাইরাস প্রতিরোধী শক্তি তৈরি হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্পুটনিক ভি টিকার প্রথম ডোজটা হবে এডি২৬ অ্যাডেনোভাইরাসের। ০.৫ এমএল ডোজ দেওয়া হবে। তার ২১ দিন পরে এডি৫ অ্যাডেনোভাইরাসের দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হবে। পর্যায়ক্রমে এই দুই ডোজ ইমিউনিটি তৈরির গোটা প্রক্রিয়াটা সম্পূর্ণ করবে।