
আবদুল মান্নান
বাংলাদেশের (Bangladesh) জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের (Sheikh Mujibur Rahman) ৪৭তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর ও পরিবারের যে ১৭ জন সদস্য ১৯৭৫ সালের ১৫ অগস্ট ঘাতকদের হাতে নিহত হয়েছিলেন তাঁদের স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। অনেকে মনে করেন ১৯৭৫ সালের ১৫ অগস্ট বঙ্গবন্ধুকে তাঁর ব্যক্তিগত শত্রুরাই সপরিবারে হত্যা করেছিল। আসলে সেদিন ঘাতকরা শুধু একজন শেখ মুজিবকেই হত্যা করেনি, তাদের লক্ষ্য ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে হত্যা করে বাংলাদেশকে আর একটি মিনি-পাকিস্তানে পরিণত করা। বাংলাদেশের আত্মাকে খুন করা। রূপক অর্থে বঙ্গবন্ধুই ছিলেন বাঙালি আর বাংলা নামক দেশটির আত্মা।

পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিমা শাসকদের নিপীড়ন, বঞ্চনার অবসান ঘটাতেই যেন বাংলার মাটিতে আবির্ভূত হয়েছিলেন শেখ মুজিব। সেই কাজ শেষ করার অল্পকাল পরেই তাঁকে চিরদিনের জন্য সরিয়ে দিল বাংলাদেশ ও বাঙালির শত্রুরা। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু এমন এক রাষ্ট্রীয় নীতি প্রণয়ন করে গিয়েছেন যা আজও বাংলাদেশের পথ-প্রদর্শক।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ শত্রু মুক্ত হল। ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু মুক্ত হয়ে ১০ জানুয়ারি দেশে ফেরেন। ১২ তারিখ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে নূতন দেশের নূতন সরকার গঠিত হয়।
মুজিবকে হত্যা করার ষড়যন্ত্রে যুক্ত খন্দকার মোশতাক ও তাঁর দোসরদের সঙ্গে জড়িত ছিলেন কতিপয় সেনা কর্মকর্তা যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের একেবারেই শেষ সময়ে এসে প্রবাসী সরকারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। ধারণা করা হয়, তাঁদের পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে পাঠিয়েছিল। এই ষড়যন্ত্রের কথা গোড়া থেকেই অবহিত ছিলেন সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান জেনারেল জিয়া, যিনি সেনা ছাউনিতে গঠন করেছিলেন বিএনপি। ১৯৯১ সালে বেগম জিয়া ক্ষমতায় এসে জাতীয় সংসদে খন্দকার মোশতাকের জন্য শোক প্রস্তাব পাশ করিয়েছিলেন।
অনেকে প্রশ্ন করেন, বঙ্গবন্ধু কি তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে জানতেন না? জানতেন হয়তো, তবে তা তিনি বিশ্বাস করেননি। তাঁকে বিভিন্ন মহল থেকে বিশেষ করে বাংলাদেশের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ও ভারতের শীর্ষ গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ একাধিকবার সতর্ক করার চেষ্টা করেছিল। বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করেননি।
বঙ্গবন্ধু ২৩ বছরের পাকিস্তান শাসনাধীন দেশে বাঙালির স্বার্থ আদায়ে প্রায় ১৩ বছর কারাগারে কাটিয়েছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে বেঁচে ছিলেন মাত্র সাড়ে তিন বছর। এই সময়ে দেশকে একটি অত্যাধুনিক সংবিধান উপহার দিয়েছিলেন, যার ভিত্তি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র আর বাঙালি জাতীয়তাবাদ। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর জিয়া ক্ষমতা দখল করে সবার আগে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাতিল করার কাজটি করলেন। বঙ্গবন্ধু ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করা সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ করেছিলেন। নিষিদ্ধ করেছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী সব রাজনৈতিক দলকে।
জিয়া এই সব নিষেধাজ্ঞা তুলে দিয়ে ৩০ লাখ শহিদের রক্তে বিধৌত বাংলাদেশে আবার পাকিস্তানি ভাবধারার রাজনীতি ফিরিয়ে আনলেন। পাকিস্তান যে একাত্তরে বাংলাদেশকে দখল করেছিল আর মুক্তিযোদ্ধারা তা মুক্ত করতে যুদ্ধে গিয়েছিল, তা ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য ‘পাকিস্তানি বাহিনী’র পরিবর্তে ব্যবহার করেন ‘দখলদার বাহিনী’ শব্দ দুটি। এই ইতিহাস নিয়েই বাংলাদেশের অন্তত তিনটি প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে। তাদের বঞ্চিত করা হয়েছে দেশের প্রকৃত ইতিহাস জানা থেকে।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর ২১ বছর আওয়ামি লিগ ক্ষমতার বাইরে ছিল। ১৯৯৬ সালে প্রথমবার বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা জনগণের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এসে ইতিহাসের গতিটাকে আবার সামনের দিকে নিয়ে যেতে চেষ্টা শুরু করেন। কাজটা মোটেও সহজ ছিল না, কারণ এই দীর্ঘ সময়ে দেশে যে প্রশাসন গড়ে উঠেছে তা অনেকটা পাকিস্তানি ধাঁচের।
২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ফের রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসে চেষ্টা করেছেন দেশকে আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরিয়ে নিতে। কিন্তু পথে বাধা তো আছেই। বাধা আছে ঘরের ভিতর। বাধা আছে বাইরে।
এরই মধ্যে যারা পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার ক্ষেত্র তৈরি করার দায়িত্ব পালন করেছিল, তারা নানা নামে একত্রিত হচ্ছে। সঙ্গে আছে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর যারা ক্ষমতা দখল করেছিল, তারা। লক্ষ্য, যে কোনও উপায়ে সামনের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করা।
বঙ্গবন্ধু কন্যাকে কখনও কখনও মনে হয় তিনি একজন নিঃসঙ্গ শেরপা। তাঁর চারপাশে মানুষ আছে অনেক, কিন্তু ক’জন তাঁর বিশ্বস্ত? বঙ্গবন্ধুর চারপাশেও মানুষের ঘাটতি ছিলনা। তাদের অনেকেই বঙ্গবন্ধুর লাশকে ধানমন্ডির বাসবভনের সিঁড়িতে ত্রিশ ঘণ্টা রক্তাক্ত অবস্থায় ফেলে রেখে নতুন সরকারের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিলেন। বাদ ছিলেন জাতীয় চার নেতা। তাঁরা তাঁদের জীবন দিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁদের বিশ্বাস ও আনুগত্যের প্রমাণ রেখে গিয়েছেন। এতকিছুর পরও বঙ্গবন্ধু কন্যা অসাধ্যকে সাধন করার চেষ্টা করছেন।
তিনি কদিন আগে বলেছেন, তাঁর বিরুদ্ধ ষড়যন্ত্র হচ্ছে। তাঁর এই ধারণা অমূলক নাও হতে পারে। কারণ যারা পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল সেই শক্তি তাঁকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। যে দলটির জন্ম বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর, তারা তো তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে রাখঢাক করে না। প্রায়ই স্লোগান দেয় ‘একাত্তরের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আর একবার’।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পূর্বে ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে এগিয়ে এসেছিল কয়েকটি মিডিয়া। এই মুহুর্তে ঠিক এমন ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে একাধিক মিডিয়া আর সংগঠন। তাদের কথা শুনলে বা পড়লে মনে হতে পারে বাংলাদেশের সব মুশকিলের অবসান হয়ে যাবে একজন শেখ হাসিনাকে হঠাতে পারলে।
তবে এই মুহূর্তে নির্মোহ ভাবে চিন্তা করলে বলতে হয় শেখ হাসিনাই বাংলাদেশের শেষ বাতিঘর। তাঁর ভুল ত্রুটি থাকতেই পারে। তিনি তো আর ফেরেশতা নন। তবে তাঁকে হয়তো আরও সাবধানী হতে হবে। দূরে থাকতে হবে ওই সব মানুষ থেকে, যারা চারিদিকের ঘটে যাওয়া সত্যটা তাঁর কাছ থেকে আড়াল করে তিনি যা শুনে খুশি হবেন তাই তাঁকে শোনায়। এরাই হতে পারে শেখ হাসিনার সব চেয়ে বড় শত্রু।
মতামত ব্যক্তিগত
লেখক: সাবেক চেয়ারম্যন, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন ও
প্রাক্তন উপাচার্য, চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয়।
টেলি-প্রম্পটার নয়, স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে কাগজেই ভরসা রাখলেন মোদী