
শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
মোহিনী যুবতী, রূপসী, কোমলে কাঠিন্যে অসামান্যা। তাঁর জীবনে পুরুষ এসেছে তিনবার, যদিও মোহিনী ত্রিচারিণী নয় কখনও। প্রথম যৌবনে শচীপতি, যিনি মোহিনীর প্রথম ভালোবাসা। কিন্তু শচীপতিদের পরিবারে কোনও পুরুষ চল্লিশের অধিক বাঁচেনা। তাই মোহিনীর পিতৃদেব মেয়ের বৈধব্য-যন্ত্রণা ভেবেই এ বিয়েতে মত দেননি। সংস্কারকে বিশ্বাস মেনে শচীপতিও মোহিনীকে কেড়ে নিতে পারেনি।দ্বিতীয় পুরুষ রাজেশ্বর, সাতপাক ঘুরে যাকে বরণ করে নিয়েছিল মোহিনী অতীতকে বিসর্জন দিয়ে নতুন সুখস্বপ্নের দোলায়। কিন্তু ফুলশয্যার দিনই মোহিনী বুঝে গেল রাজেশ্বরের প্রাণাধিকা তাঁর সেজ বৌদি। সেজ জা-র সঙ্গে প্রতিযোগিতা না করে মোহিনী নিজেই বাপের বাড়ি ফিরে এল। বাপের বাড়ির সংসার বলতে এখন চারজন বিপত্নীক জ্যাঠামশাই, পিতৃমাতৃহীনা দুই বোন মোহিনী আর আয়না আর তাদের ভাই সুহাস।
এবার বহু যুগ পর পঁয়ত্রিশ পেরনো মোহিনীর মনে আবার দোলা দিল অবিন। মোহিনীর ভাই সুহাসের কলকাতার বন্ধু অবিন এসেছে কদিনের জন্য তাঁদের বাড়িতে। শত চেষ্টাতেও মোহিনী নিজেকে আড়াল করতে পারছেনা। অবিন দুর্বার ঝোড়ো হাওয়া হয়ে বর্ষার দুরন্ত বর্ষণ ঘটাল মোহিনীর জীবনে। তারপর…বাংলা সাহিত্যে এক অসামান্য সৃৃষ্টি বিমল করের ‘অসময়’ ৷ বিমল কর ‘অসময়’ উপন্যাসের জন্য ১৯৭৫ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন। যে উপন্যাস সেসময় সাড়া ফেলে দেয়। ১৯৭৬ সালে বিমল করের ‘অসময়’ উপন্যাস নিয়ে একই নামে ছবি তৈরি করেন পরিচালক ইন্দর সেন। অপর্ণা সেন অভিনীত সেই ‘অসময়’ ছবি আজও বাংলা ছবির ইতিহাসে মাইলফলক। যেমন ছবির কাহিনি, তেমন পরিচালনা এবং বক্সঅফিস ও পুরস্কারেও ছবিটি সমৃদ্ধ হয়েছিল। অথচ ‘অসময়’ ছবি আজ বিস্মৃতির আড়ালে। এ প্রজন্ম দেখার সুযোগ পায়নি এই ছবি। আর কি কখনও দেখা যাবে বিমল করের উপন্যাসের এমন সার্থক চলচ্চিত্রায়ণ!
বিমল করের (১৯ সেপ্টেম্বর ১৯২১ – ২৬ অগস্ট ২০০৩) জন্মশতবর্ষে ফিরে দেখা যাক অসময়ে হারানো বাংলা ছবি ‘অসময়’-এর সত্তর দশকের সেইসব দিনগুলো।
বিমল করের লেখনী চমৎকার। ‘অসময়’ সম্পূর্ণ উপন্যাসটা উত্তম পুরুষে লিখেছেন লেখক। যেন চরিত্ররা নিজেই কথা বলছে। একটি একটি পর্বে তাঁদের চোখ দিয়েই আমরা এই কাহিনি পড়ছি। পড়তে পড়তে তৈরি হয় একটা অমোঘ টান। যেন মনে হয় এইসব ঘটনাগুলো কখনও আমাদের সঙ্গেও ঘটেছিল। সহজ-সরল অথচ কেমন যেন চুম্বকের মতো টেনে ধরা একটা ভাষা ব্যবহার করেছেন লেখক। ফলে পড়তে কোনও সমস্যাই হয় না। পৌনে তিনশ পৃষ্ঠা কখন শেষ হয়ে যায় সে খেয়ালও থাকে না। প্রধান ছয় চরিত্রের বয়ানে গল্প বলার বিষয়টাও বেশ অভিনব। নামকরণও দুর্দান্ত। ‘অসময়’ নামটা ক্লাইম্যাক্সের সঙ্গে যেমন খাপ খেয়েছে, তেমনি খাপ খেয়েছে প্রতিটা চরিত্রের অবস্থার সাথেও। সহজ কথা সহজে বলার অসাধারণ একটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে ‘অসময়’ বইটা।আর কেমন ছিল পরিচালক ইন্দর সেনের বানানো ‘অসময়’ ছবিটি! ইন্দর সেনের প্রথম ছবি ‘প্রথম কদম ফুল’ ছিল সুপারহিট বক্সঅফিসে এবং সংগীতেও। তিনি প্রথমে ছিলেন মৃণাল সেনের সহকারী পরিচালক। এরপর ‘পিকনিক’, ‘চামেলি মেমসাহেব’, ‘ঠিকানা’ সহ ‘অসময়’ ছবির পরিচালকও ইন্দর সেন। তাঁর পরিচালনায় শ্রেষ্ঠ ছবিগুলোর অন্যতম একটি ‘অসময়’। যে ছবি আলোড়ন ফেলেছিল সেইসময় এবং অপর্ণা সেনের ফিল্মোগ্রাফিতে এই ছবি একটি মাইলস্টোন।
আর সর্বজনবিদিত আইকনিক মেগা সিরিয়াল ‘জন্মভূমি’রও পরিচালক ছিলেন তিনি। বহুযুগ ইন্দর সেন অন্তরালে থাকতেই পছন্দ করেন। হয়তো অনেকটা অভিমানেই। তবু বিমল করের শতবর্ষে ‘অসময়’ নিয়ে বলতে রাজি হলেন পরিচালক।বিমল করের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের দিনটার কথা দিয়েই ইন্দর সেন বলতে শুরু করলেন “বিমল করের সঙ্গে আগেই আমার প্রাথমিক আলাপ ছিল অন্যান্য ছবির সূত্রে। ‘অসময়’ উপন্যাসটা পড়ে তো খুব ভাল লেগেছিল। তারপর আমি বিমল করের সঙ্গে দেখা করি ওঁর কর্মস্থলে একটি সংবাদপত্রের অফিসে। ওঁকে যখন বলি আপনার লেখা এই উপন্যাস নিয়ে ছবি করতে চাই সেটা শুনে উনি খুব খুশি হয়েছিলেন। তারপর আমি বিমল কর মহাশয়ের সল্টলেকের বাড়িতেও গেছিলাম কথাবার্তা বলতে। ছবি করার অনুমতি দিলেন উনি। শ্যুটিং শুরু করলাম অপর্ণা সেন, অনিল চ্যাটার্জি, স্বরূপ দত্ত সবাইকে নিয়ে। ‘অসময়’-এর প্রিমিয়ারে বিমল কর-কে ছবি দেখতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। উনি এসেওছিলেন এবং ছবি দেখে ওঁর খুব ভাল লেগেছে সেটা জানিয়েওছিলেন আমায়। সাহিত্য আর ছবিতে তফাত খুব একটা ছিলনা আর যেটুকু পরিবর্তন দরকার সেটা নিয়ে ওঁর কোনও আপত্তি ছিলনা। বিমল কর শুধু ভাল সাহিত্যিকই নন, খুব খোলা মনের মানুষ ছিলেন।”
‘অসময়’ ছবিতে কাস্টিং হয়েছিল উপন্যাস ধরেই। মোহিনী অপর্ণা সেন, জ্যাঠামশাই অনিল চট্টোপাধ্যায়, অবিন স্বরূপ দত্ত, শচীপতি দীপঙ্কর দে, আয়না মহুয়া রায়চৌধুরী, সুহাস কল্যাণ চ্যাটার্জি এছাড়াও ছিলেন পার্থ মুখোপাধ্যায়, কণিকা মজুমদার, চিন্ময় রায় প্রমুখ। সংগীত পরিচালনা আনন্দ শংকর।
ছবিতে ব্যবহার হয়েছিল বেশ ক’টি নজরুলগীতি ও দ্বিজেন্দ্রগীতি। কন্ঠশিল্পী মান্না দে, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, শিপ্রা বসু, অনুপ ঘোষাল ও স্বকন্ঠে চিন্ময় রায়। প্রতিমার গানটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল সেকালে।
বিএফজেএ সহ তৎকালীন বিভিন্ন পুরস্কারে ছবিটি বিবিধ বিভাগে পুরস্কৃত হয়েছিল। অপর্ণা সেনও পেয়েছিলেন পুরস্কার অভিনেত্রী রূপে যতটা মনে করতে পারলেন পরিচালক।তবে বহুযুগ আর দেখার উপায় নেই ‘অসময়’। সত্তর দশকের শেষভাগের ছবি, খুব বেশিদিনের কথা নয়। তাহলে কেন এমন একটি বিখ্যাত আলোচিত প্রশংসিত ছবি লুপ্ত হয়ে গেল? এই হারিয়ে যাওয়ার মধ্যে কি রয়েছে অন্য কোনও গল্প?
চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক ইন্দর সেন সব রহস্যের পর্দা উন্মোচন করে দিয়ে বললেন, “আসল ঘটনাটা হল ছবিটার প্রোডিউসার ছিলেন স্বরূপ দত্ত। ইউকো ব্যাঙ্কের থেকে লোন নিয়ে ছবিটা করা হয়েছিল। ইউকো ব্যাঙ্ক গাড়ি, বাসের জন্য যেভাবে লোন দিত সিনেমা বানানোর জন্য সেভাবেই লোন দিত। পরে শুনেছিলাম উনি সেই টাকাটা শোধ করতে পারেননি। তাই ইউকো ব্যাঙ্ক ছবিটা বাজেয়াপ্ত করে নেয়। সেই কারণেই ছবিটার আর কোনও কপি নেই। প্রযোজক টাকা পরেও আর দিতে পারেননি। এবার আমার পক্ষেও অত টাকা দেওয়া সম্ভব ছিলনা। দূরদর্শনে একবার দেখিয়েছিল ছবিটা ১৯৭৮ সালে। ওদের কাছে যদি কপি থাকে কোনও খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন। যদিও থাকার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
আরেকটা সম্ভাবনা আছে। পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটে ভারতবর্ষে যত ছবি হয় সবার একটা করে প্রিন্ট পাঠানো হয়। এখন মনে নেই পাঠিয়েছিল কিনা ‘অসময়’-এর প্রিন্ট। পুনেতে খোঁজ করলে পেলেও পাওয়া যেতে পারে। ছবির প্রিন্ট পরিচালকদের কাছে থাকেনা। প্রযোজকদের ব্যাপার বেশিরভাগ। তো কপি বাজেয়াপ্ত হবার কারণেই মূলত ছবিটা দেখার সুযোগ নেই বললেই চলে। আমার পরিচালিত অনেক ছবি হারিয়ে গেছে, তাই লোকে আমাকে আজকাল ‘জন্মভূমি’ সিরিয়ালের পরিচালক বলেই চেনে! এটা যেমন ভালো লাগার, তেমন আফশোসও।”
বিমল করের কাহিনি অবলম্বনে ‘বসন্ত বিলাপ’ ও ‘যদুবংশ’ ছবির নায়িকাও অপর্ণা সেন। সে দুটি ছবি যদিও পাওয়া যায়।
অপর্ণা সেনও তাঁর হারিয়ে যাওয়া ছবিগুলি নিয়ে হতাশ। ‘অসময়’, ‘সুজাতা’, ‘নৌকাডুবি’ কোনওটাই আজকাল আর নেই। ‘নৌকাডুবি’ ছিল অজয় করের ছবি। সেই ছবিও ব্যাঙ্ক বাজেয়াপ্ত করেছে, তেমনটাই জানিয়েছিলেন অজয় কর কন্যা কৃষ্ণা মুখোপাধ্যায়।অন্যদিকে দূরদর্শনের অবহেলায় হারিয়ে গেছে অপর্ণা সেন পরিচালিত ‘পিকনিক’ টেলিফিল্ম। ইন্দর সেন করেছিলেন ‘পিকনিক’ ছবি, যাতে ছিল সুধীন দাশগুপ্তর সব সুপার-ডুপারহিট গান। আর ‘পিকনিক’ টেলিছবি দূরদর্শনের জন্যই বানান অপর্ণা। শাবানা আজমি, শ্রীলা মজুমদাররা অভিনয় করেছিলেন।
অপর্ণা সেন জানাচ্ছেন “আমার অভিনীত ও পরিচালিত অনেক ছবিই হারিয়ে গেছে। আমার ‘পিকনিক’ দেখার সুযোগ আছে বলে আর মনে হয়না। আমার ‘পিকনিক’ ছবিটা তো হারিয়েই গেল। দূরদর্শন উল্টে আমাকে ফোন করছে ‘আপনার কাছে আছে?’ আমি বললাম ‘আমার কাছে কীকরে থাকবে! ‘পিকনিক’ ছবি বানানোর সময় আমাদের যে চুক্তি হয়েছিল তাতে বলাই ছিল আমি নিজের কাছে কিছু রাখতে পারবনা।’ তখন বলছে ‘হ্যাঁ, কিন্তু লোকে তো রেখে দেয় অনেকে।’
আমি হতভম্ব শুনে। এটা কীরকম ধরনের কথা। যেন লুকিয়ে রেখে দেয়। এখন মনে হয় সেটাই করা উচিত ছিল।’ছবি হারিয়ে গেলে পরের প্রজন্মের কাছে ছবিটার আর কোনও অস্তিত্বই থাকেনা। এই প্রতিবেদনের দ্বারা অন্তত কিছু ডকুমেন্টেশান থাক ছবিটা সম্পর্কে। যা দেখেও পরবর্তী প্রজন্ম জানতে পারবে এমন একটি অবিস্মরণীয় ছবির কথা।
যারা সত্তর দশকে দেখেছেন ‘অসময়’ তাঁদের চোখে আজও লেগে আছে অপর্ণা সেনের মোহিনীমায়া।
ছবি সৌজন্যে- সংগ্রাহক জ্যোতিপ্রকাশ গুহ ও ফাল্গুনি দত্ত রায়