Latest News

২০১১-র ভোট : সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, লালগড়, বামদুর্গ ধূলিসাৎ

দ্য ওয়াল ব্যুরো : ২০০৮ সালে ভোটে বিরোধীদের বিরোধীদের বিশেষ সাড়াশব্দ মেলেনি। সেই সময় সাধারণ মানুষ ভাবত, সিপিএম যা খুশি তাই করতে পারে। সিপিএম নেতারা নিজেরাও সম্ভবত তাই ভাবতেন। লোকে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে পার্টির রাজ্য কমিটির অফিসকে বলত রাজবাড়ি। পাড়ায় পাড়ায় পার্টির লোকাল কমিটি ছিল সর্বশক্তিমান। সেখান থেকে পুরো এলাকা কন্ট্রোল করা হত। কে কী করছে, কিছুই পার্টির কাছে গোপন ছিল না। কার বাড়িতে কী রান্না হচ্ছে, তাও নাকি লোকাল কমিটির নেতারা পার্টি অফিসে বসে বলে দিতে পারতেন।

২০০৬ সালে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নেওয়ার পরেই ঘোষণা করেন, হুগলির সিঙ্গুরে টাটার ছোট গাড়ির কারখানা হবে। গাড়ির নাম ন্যানো। কারখানার জন্য সিঙ্গুরের গোপালনগর, বেড়াবেড়ি, বাজেমেলিয়া, খাসেরভেড়ি, সিংহেরভেড়ি অঞ্চলে হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করা হবে।

২৬ মে টাটা কোম্পানির কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্তা ও সরকারি আধিকারিকরা সিঙ্গুরে জমি দেখতে যান। গ্রামের বউরা ঝাঁটা, লাঠি নিয়ে তাঁদের তাড়া করেন। তাঁদের একটাই কথা, জমি দেব না। প্রথমে সিপিএম ব্যাপারটাকে উটকো ঝামেলা ভেবে উড়িয়ে দিয়েছিল। নেতারা ভেবেছিলেন, এর পিছনে বাইরের লোকের উস্কানি আছে। একবার কষে দাবড়ে দিলেই সবাই চুপ করে যাবে।

পরবর্তীকালে সেই জমি আন্দোলনই বাড়তে বাড়তে বিরাট আকার ধারণ করল। ২০১১ সালে বামফ্রন্টের সাজানো বাগান একেবারে তছনছ হয়ে গেল।

সিঙ্গুরের জমি মালিকদের অর্ধেকই অধিগ্রহণের নোটিশ গ্রহণ করেননি। তাঁদের যুক্তি ছিল, টাটার কারখানার জন্য যে জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে, তা অতি উর্বর। রাজ্য সরকার যেরকম দাবি করছে, পতিত বা একফসলি জমিতে কারখানা গড়া হবে, তা ডাহা মিথ্যা কথা। সরকার বলছে, জনস্বার্থে টাটার প্রকল্পকে রূপায়িত হতে দিতে হবে। একথাও অসত্য। কোনও বেসরকারি সংস্থা মুনাফার জন্যই শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে, মানুষের সেবা করার জন্য নয়।

সিপিএমের যুক্তি ছিল, টাটার কারখানা হলে এলাকায় প্রচুর কর্মসংস্থান হবে। টাটারা এলাকার উন্নয়ন করবে ইত্যাদি।

জমির ক্ষতিপূরণ বাবদ কৃষকদের যে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছিল, তা নিয়েও অনেকে আপত্তি তোলেন।

২৫ সেপ্টেম্বর সিঙ্গুরের কয়েক হাজার মানুষ বিডিও অফিসে শান্তিপূর্ণ অবস্থান করছিলেন। রাতে তাঁদের ওপরে লাঠিচার্জ করে পুলিশ। অনেকে আহত হন। আহতদের মধ্যে এক যুবক পরদিন মারা যান। তাঁর নাম ছিল রাজকুমার ভুল।

নভেম্বরের শেষে কারখানার জন্য জমি ঘিরতে গেলে আর একদফা গণ্ডগোল শুরু হয়। ২ ডিসেম্বর সকালে আন্দোলনকারীদের ওপরে লাঠিচার্জ করে র‍্যাফ। ৪৯ জন গ্রেফতার হন। কয়েকদিন পরে জনমতের চাপে পুলিশ তাঁদের মুক্তি দেয়। সরকার পুরো হুগলি জেলায় ১৪৪ ধারা জারি করে। ৪ ডিসেম্বর ধর্মতলায় অনশন শুরু করেন তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৮ ডিসেম্বর সিঙ্গুরের মেয়ে তাপসী মালিককে ধর্ষণ ও হত্যা করা হয়। প্রমাণ লোপের জন্য তার দেহটি পুড়িয়েও দেওয়ার চেষ্টা হয়। অভিযোগ ওঠে সিপিএম ক্যাডারদের বিরুদ্ধে।

২০০৮ সালের ৩ অক্টোবর রতন টাটা ঘোষণা করেন, তাঁরা সিঙ্গুর থেকে ন্যানো প্রকল্প সরিয়ে নিচ্ছেন।

পুলিশ ও ক্যাডারবাহিনী নামিয়ে শিল্পায়ন করতে চেয়েছিল সিপিএম। এই গা জোয়ারি ভালভাবে নেয়নি রাজ্যের মানুষ। তাদের অসন্তোষ আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল নন্দীগ্রামের ঘটনায়।

সিপিএম তথা রাজ্য সরকারের পরিকল্পনা ছিল, নন্দীগ্রামে গড়ে উঠবে কেমিক্যাল হাব। ২০০৭ সালের ৩ জানুয়ারি গড়চক্রবেড়িয়ার কালীচরণপুর ৯ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতে জমি অধিগ্রহণের নোটিশ টাঙানো হয়। সেদিন দলে দলে মানুষ কালীচরণপুর গ্রাম পঞ্চায়েতে ভিড় করে। তারা ওই নোটিশ সম্পর্কে জানতে চায়। পঞ্চায়েত প্রধান তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন বলে অভিযোগ। তাতে জনতা উত্তেজিত হয়ে ওঠে। পঞ্চায়েত অফিস থেকে থানায় ফোন যায়। পুলিশ উত্তেজিত জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতার জন্য টিয়ার গ্যাসের শেল ফাটায়, গুলিও চালায়।

এরপরে তেতে ওঠে পুরো নন্দীগ্রাম। পুলিশকে জনতা তাড়া করে। রাস্তা কেটে, কালভার্ট ভেঙে মানুষ পুলিশ ও সিপিএম ক্যাডারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে। আলিমুদ্দিন থেকে বিনয় কোঙার হুঁশিয়ারি দেন, নন্দীগ্রামকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলব। লাইফ হেল করে দেব। অন্যদিকে নন্দীগ্রামের কৃষকরা গড়ে তোলেন ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি।

১৪ মার্চ নন্দীগ্রামে বড় ধরনের পুলিশি অভিযান হয়। সেদিন সকালে ভাঙ্গাবেড়া সেতুর নীচে তালপাটি খালের উত্তরে বহু মানুষ জড়ো হয়েছিলেন। চাঁদোয়া খাটিয়ে গৌরাঙ্গ পূজা হচ্ছিল। ন’টা বেজে ৪০ মিনিট নাগাদ পুলিশবাহিনী হানা দেয়। অভিযোগ, তাদের সঙ্গে সিপিএমের ক্যাডাররা ছিল।

জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য প্রথমে টিয়ার গ্যাসের শেল ফাটানো হয়। তারপর চালানো হয় গুলি। ১৪ জন মারা যান। আহত হন বহু। লরিতে, ট্রেকারে করে মৃতদেহ পাচার করার অভিযোগ ওঠে।

২০০৭ সালের নভেম্বরে নন্দীগ্রামে পুনরায় জমি দখল করে সিপিএম। পার্টি নেতৃত্ব বলেছিল নন্দীগ্রামে ‘সূর্যোদয়’ হয়েছে। সম্ভবত মানুষের ক্ষোভের কথা নেতারা তখনও আঁচ করতে পারেননি। ততদিনে সাধারণ মানুষের চোখে লক্ষ্মণ শেঠ, বিনয় কোঙার, বুদ্ধদেব ভট্টচার্যরা ভিলেন হয়ে উঠেছেন।

রাজ্য জুড়ে এই উত্তাল পরিস্থিতির মধ্যে সক্রিয় হয়ে উঠছিল মাওবাদীরা। নন্দীগ্রামে তাদের উপস্থিতির কথা শোনা গিয়েছিল। জঙ্গলমহলে ছিল তাদের ঘাঁটি। ২০০৮ সাল থেকে রাজ্যে মাওবাদী সমস্যা গুরুতর আকার ধারণ করে।

২০০৮ সালের ২ নভেম্বর শালবনিতে জিন্দালদের লৌহ-ইস্পাত কারখানার শিলান্যাস করতে গিয়েছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টচার্য। সেই সঙ্গে ছিলেন তৎকালীন দুই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রামবিলাস পাসোয়ান ও জিতিন প্রসাদ। তাঁদের কনভয় যখন ফিরছে, মাওবাদীরা বিস্ফোরণ ঘটায়। মন্ত্রীরা অক্ষত থাকলেও কয়েকজন পুলিশকর্মী আহত হন।

এরপর মাওবাদী ধরার জন্য পুরো এলাকায় তল্লাশি অভিযান শুরু করে পুলিশ। গ্রামবাসীদের ওপরে অত্যাচারের অভিযোগ ওঠে। ৪ নভেম্বর লালগড় থানা ঘেরাও করে বিপুল সংখ্যক মানুষ। তাদের দাবি ছিল, সাধারণ মানুষের ওপরে জোরজুলুম করার জন্য পুলিশ সুপারকে ক্ষমা চাইতে হবে। লালগড়ের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে পুলিশি সন্ত্রাসবিরোধী জনসাধারণের কমিটি গড়ে তোলে। তাদের পিছনে অবশ্যই মাওবাদীদের ইন্ধন ছিল। এইসময় কিষেণজি নামে এক মাওবাদী নেতার নাম খুব শোনা যেতে থাকে। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল মাল্লোজুলা কোটেশ্বর রাও। তিনি অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে এসেছিলেন।

জঙ্গলমহলে মাওবাদী ঠেকাতে ২০০৯ সালের জুন মাসে শুরু হয় পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর যৌথ অভিযান। মাওবাদীরা ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে পড়ে। ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি সকালে ঝাড়গ্রাম সাবডিভিশনের নেতাই গ্রামে মানুষ সিপিএম নেতা রথীন দণ্ডপাতের বাড়ি ঘেরাও করে। বাড়ির ভিতর থেকে গুলি চালানো হয়। অনেকে হতাহত হন।

সিঙ্গুর আন্দোলনের সময় থেকেই বাংলার বিদ্বজ্জনেদের এক বড় অংশ গণ আন্দোলনের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। সিপিএমের পক্ষেও ছিলেন কেউ কেউ। বাংলার বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এরকম বিভাজন আগে দেখা যায়নি।

২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচন হয় ছয় দফায়। ১৮ এপ্রিল ভোটপর্ব শুরু হয়ে শেষ হয় ১০ মে। গণনা হয় ১৩ মে। তাতে দেখা যায় ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছে বামদুর্গ।

সেবার কংগ্রেস ও তৃণমূল ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই করেছিল। তৃণমূল কংগ্রেস একাই পায় ১৮৪ টি আসন। কংগ্রেস পায় ৪২ টি। সিপিএম পায় ৪০ টি। ফরওয়ার্ড ব্লক পায় ১১ টি। আরএসপি পায় সাতটি। সিপিআই পায় দু’টি।

You might also like