
অমল সরকার
কেরলে রাজ্যপাল আরিফ মহম্মদ খানের সঙ্গে সিপিএমের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়নের বিরোধ চরমে উঠেছে। বছর আড়াই আগে আরিফ মহম্মদ রাজ্যপালের দায়িত্ব নিয়ে তিরুবনন্তপুরমের রাজভবনে পা রাখার পর মাস কয়েক রাজ্য-রাজ্যপাল সম্পর্কে সৌহার্দ্য বজায় ছিল। তারপর থেকে খোটাখুটি লেগেই আছে। ঠিক যেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বনাম জগদীপ ধনকড়ের বিরোধ। বিবৃতি, পাল্টা বিবৃতি তো আছেই, পত্রাঘাতও থেমে নেই। যা দেখে অনেকেই বলছেন, এতো রাজ্য-রাজ্যপাল বিরোধে কেরলে বাংলা মডেল।
বাংলা মডেল বলার পাশাপাশি রাজ্যপালের সঙ্গে বিরোধে অনেকেই সিপিএমের পলিটব্যুরোর সদস্য তথা দু-বারের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাইয়ের সরকার পরিচালনা, বিশেষ করে রাজ্যপালের সঙ্গে বিরোধের ক্ষেত্রে তাঁর মধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছায়া দেখতে পাচ্ছেন।
রাজ্যপালদের সাংবিধানিক দায়িত্বের পাশাপাশি তাঁরা রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্যের দায়িত্ব পালন করে থাকেন। আচার্য হিসাবে রাজ্যপালদের হাতে কিছু ক্ষমতাও দেওয়া আছে সংশ্লিষ্ট আইনে। তার মধ্যে অন্যতম হল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ। এই ব্যাপারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ২০১৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত আইনের সংশোধন করে আচার্য তথা রাজ্যপালের হাত থেকে সব ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে। এমনকি সার্চ কমিটিতে রাজ্যপালের প্রতিনিধি বাছাইয়ের ক্ষমতাও এখন রাজ্য সরকারের হাতে।
আগে সার্চ কমিটির বাছাই করা তিনটি নামের থেকে রাজ্যপাল একজনকে বেছে নিতে পারতেন উপাচার্য হিসাবে। কিন্তু বাংলায় সেই ক্ষমতাও এখন সরকারের কুক্ষিগত। রাজ্য সরকার নির্বাচিত প্রার্থীকেই আচার্য-রাজ্যপাল আনুষ্ঠানিক নিয়োগের সম্মতি দিতে বাধ্য। বিধানসভা নির্বাচনের পর একগুচ্ছ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের নিয়োগ, মেয়াদ বৃদ্ধি ঘটানো হয়েছে আচার্যের সম্মতি ছাড়াই। ২০১৭ সালের আইন-বিধির জোরেই গত শুক্রবার রাজ্যের উচ্চশিক্ষা দফতর সব কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়কে চলতি সেমেস্টারের পরীক্ষা অনলাইনেই নিতে বলেছে।
কেরলে পিনারাই বিজয়ন সরকার বাংলার মতো আইন সংশোধনের পথে না হাঁটলেও কার্যক্ষেত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকেই অনুসরণ করছে। তারা বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত বিষয়ে আচার্য-রাজ্যপালের মতামতের তোয়াক্কাই করছে না বলে অভিযোগ। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে রাজ্যপাল আরিফ মহম্মদ খান মুখ্যমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে স্পষ্ট হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, রাজ্য সরকার উচ্চশিক্ষায় হস্তক্ষেপ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বশাসন খর্ব করা বন্ধ না করলে তিনি আচার্য পদ ছেড়ে দেবেন। মুখ্যমন্ত্রীকে খানিক উপহাস করে লিখেছেন, আমি স্বেচ্ছায় আচার্য পদ থেকে সরে দাঁড়াচ্ছি। আপনি বরং আইন বদলে নিজেই আচার্য হয়ে যান। তাহলে আপনি আপনার রাজনৈতিক ইচ্ছাপূরণ করে নিতে পারবেন।
কোনও আচার্য-রাজ্যপালের তরফে মুখ্যমন্ত্রীকে এমন চিঠি লেখার নজির বাংলাতেও নেই। আরিফ মহমন্মদ খান লিখেছেন, আচার্য হিসাবে তিনি অত্যন্ত অসহায় বোধ করছেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলির স্বশাসন রক্ষা করতে না পারায়। তাঁর বক্তব্য, রাজ্য সরকারের হস্তক্ষেপ এমন পর্যায়েই পৌঁছেছে।
উত্তরপ্রদেশের মানুষ আরিফ রাজীব গান্ধীর মন্ত্রিসভায় ছিলেন। শাহবানু মামলায় সুপ্রিম কোর্ট তালাকপ্রাপ্ত মুসলিম মহিলাদের খোরপোশ নিশ্চিত করে রায় দিয়েছিল। ধর্মীয় নেতাদের চাপে রাজীব গান্ধী সংসদে বিল এনে সর্বোচ্চ আদাতলের রায় বদলে দিয়েছিলেন। ওই ঘটনায় মুসলিম তোষণের অভিযোগ তুলে মন্ত্রিসভা ছাড়েন আরিফ। পরে বিজেপিতে যোগ দেন।
মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়নকে লেখা চিঠিতে রাজ্যপাল আচার্য হিসাবে তাঁর ক্ষমতা খর্বের একাধিক দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন। তার একটি হল, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে পুনর্নিয়োগের প্রস্তাব। রাজ্য সরকারকে তিনি জানান, উপাচার্যের মেয়াদ বৃদ্ধি করা যায়। পুনর্নিয়োগ সম্ভব নয়। কিন্তু রাজ্য সরকার এবং মুখ্যমন্ত্রীর আইনি উপদেষ্টা তা মানতে চাননি। আরিফের বক্তব্য, রাজ্য সরকারে সঙ্গে বিরোধ এড়াতে তিনি অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রস্তাবে শেষ পর্যন্ত সায় দিয়েছেন। এ জন্য এখন তাঁর অনুশোচনা হচ্ছে। আর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে আচার্য বলার পরও রাজ্য সরকার উপাচার্যের বেতন এক বছর ধরে আটকে রেখেছে। তৃতীয় ঘটনাটি উপাচার্য নিয়োগ সংক্রান্ত। সার্চ কমিটি একটি বিশ্বিবিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সুপারিশ অগ্রাহ্য করে তিনজনের পরিবর্তে একটি নাম আচার্যের সম্মতির জন্য পাঠায়। আচার্যকে বলা হয়, যে ছয়জন আবেদন করেছিলেন তাঁদের মধ্যে একজনকেই সার্চ কমিটি উপযুক্ত মনে করেছে।
কেরলে সিপিএম সরকারের সঙ্গে রাজ্য সরকারের বিরোধে বড় আকার নিয়েছিল গত বছর নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন সম্পর্কে রাজ্যপালের ভাষণে কেন্দ্রের সমালোচনা। রাজ্য সরকারের লিখে দেওয়া ভাষণ মুখ্যমন্ত্রীকে ফেরৎ পাঠিয়ে রাজ্যপাল তা পড়তে অস্বীকার করেন। পরে মুখ্যমন্ত্রীর অনুরোধে তিনি ভাষণ পাঠ করলেও সিএএ সংক্রান্ত অংশের সঙ্গে তিনি সহমত নন বলে পরে সাংবাদিক সম্মেলন করে মিডিয়াকে জানিয়ে দেন।
প্রসঙ্গত, সিএএ-সহ কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে একাধিক রাজনৈতিক ইস্যু ছাড়াও করোনা মোকাবিলায় মোদী সরকারের রাজ্যগুলির প্রতি দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কেরলের সিপিএম মুখ্যমন্ত্রীর একাধিকবার ফোনে কথাও হয়। মোদী বিরোধী সমাবেশে একবার পিনারাইকে আমন্ত্রণ জানানোর কথাও বলেন মমতা।
বাংলার তৃণমূল সরকারের মতো পিনারাই বিজয়নও রাজ্যবাসীকে নগদ টাকা দেওয়ার নানা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। অনেকে মনে করছেন বাংলায় মমতার তৃতীয়বার আর কেরলে পিনারাইয়ের দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার নেপথ্যে বড় ভূমিকা নিয়েছে নগদ বিলির প্রকল্পই।