Latest News

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর শান্ত, সংযত মুখ্যমন্ত্রী, সৌজন্য নাকি কৌশল?

দ্য ওয়াল ব্যুরো: চারমাসের থেকেও তিনদিন কম। বিধানসভা নির্বাচনের পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুটি দিল্লি সফরের মধ্যে এই হল সামান্য ব্যবধান। দু’বারই তিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দেখা করেছেন। কিন্তু দুটি সফরের মধ্যে মস্ত বড় চরিত্রগত ফারাক করে দিয়েছে বুধবার সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সামনে এক অন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতি। সংবাদ মাধ্যমের সামনে মুখ্যমন্ত্রীর শব্দচয়ন, শব্দ প্রক্ষেপণ সবই ছিল ভিন্ন প্রকৃতির। এক কথায় মুখ্যমন্ত্রীর ভিন্ন মুড, অন্য মমতা।

প্রথম সফরে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক শেষে তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে রীতিমতো সরব ছিলেন। তাতে বিষয় হিসেবে যেমন ছিল পেগাসাস কেলেঙ্কারি তদন্তের দাবি, তেমনই ছিল রাজ্যের আর্থিক দাবি-দাওয়া। কিন্তু বুধবার সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে বেরিয়ে আসার পর গোটা দেশের মিডিয়ার সামনে মুখ্যমন্ত্রীর মেজাজ, বাচনভঙ্গি এবং শব্দচয়ন কোনটাই আক্রমণাত্মক ছিল না। রাজ্যের দাবি-দাওয়া, কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তে আপত্তি, ইত্যাদি নানা বিষয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন বলে সংবাদ মাধ্যমের সামনে জানান। সব কথাই বলেছেন ভিন্ন মেজাজে। যে।মুখ্যমন্ত্রীকে দেখে অনেকেই বলেছেন, ইনি অন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলার অগ্নিকন্যা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে মুখ খোলা, তাঁর সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া দেওয়ার সময় ছিলেন শান্ত, সংযত। অত্যন্ত পরিশীলিত ভাষায় গোটা বিষয়টি বর্ণনা করেন। তাতে রাজ্যের আর্থিক দাবি-দাওয়া নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে যেমন জানান, তেমনই তিনি জানিয়েছেন, কথা হয়েছে বিএসএফের এলাকা বৃদ্ধির কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত নিয়ে। আবার কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্পগুলি রাজ্যের নামে চালালে দিল্লি অর্থ বরাদ্দ করবে না বলে যে হুঁশিয়ারি দিয়েছে সে প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মুখ খোলেন। কিন্তু তাঁর প্রতিক্রিয়ায় আক্রমণ, সমালোচনা ছিল না। বরং গলা নামিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে যুক্ত রাষ্ট্রীয় কাঠামো রক্ষার কথা বলেছেন। তাঁর কথাবার্তায় কখনওই সেই পরিচিত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখা যায়নি।

এই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে স্বভাবতই চর্চা শুরু হয়েছে রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক মহলে। কারণ সবাই জানে নরেন্দ্র মোদীকে ছেড়ে কথা বলার পাত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নন। আর তীব্র মোদী বিরোধিতাই তাঁর এখনকার রাজনীতির ইউএসপি।

আগরতলায় মাথা ফাটল তৃণমূল পোলিং এজেন্টের, সিপিএম প্রার্থীর বাড়িতে হামলা

স্বভাবতই কৌতূহলের বিষয় হচ্ছে, এমন আচরণ কি নিছকই মুখ্যমন্ত্রীর তরফে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সৌজন্য প্রদর্শন এবং তাঁর সাংবিধানিক মর্যাদা রক্ষা, নাকি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এটি নতুন কোনও কৌশল?
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের অধিকাংশের অভিমত, এটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুচিন্তিত কৌশল। কারণ, রাজনীতিতে মেপে পা ফেলতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। অবশ্যই পরিস্থিতির প্রয়োজনেই এটা তৃণমূল নেত্রীর কৌশল।

খুব ভাবনা চিন্তা করেই তিনিও আর একজন অরবিন্দ কেজরিওয়াল হতে চাইছেন। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আপাতত সরাসরি সংঘাত এড়িয়ে চলা। কেজরিওয়াল ও মমতা এক বছরের ব্যবধানে বিধানসভা নির্বাচনে নজরকাড়া ফল করে ক্ষমতায় টিকে গিয়েছেন। ভোটের ময়দানে দু’জনেই মোকাবিলা করেছেন নরেন্দ্র মোদীকে। আর দু’জনেই ক্ষমতায় টিকে যাওয়ার পর টের পাচ্ছেন, ভোটের আগে দেওয়া নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি রক্ষাই এখন সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার কারণ। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়াল এবং বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্বাচনী সাফল্যের পেছনে প্রধান ভূমিকা নিয়েছে তাঁদের সরকারের নানা জনমুখী কর্মসূচি এবং গুচ্ছ সুবিধা। কেজরিওয়াল যেমন ২০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ নিখরচায় দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। এ ছাড়া ফ্রি ওয়াইফাই, মহিলাদের নিখরচায় বাসে যাতায়াতের সুবিধা, প্রবীণদের সরকারি খরচে তীর্থস্থান ভ্রমণের ব্যবস্থা এবং স্কুলপড়ুয়াদের নিখরচায় সরকারি বাসে যাতায়াতের সুবিধা। তীব্র গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় এসে কেজরিওয়াল রাজধানীর বাসিন্দাদের জনপরিষেবা প্রদানে নজির গড়েছেন।

একই কথা প্রযোজ্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে। তিনি ও লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় এসে সাধারণ মানুষের জন্য পরিসেবা নিশ্চিত করেছেন। এই সব পরিষেবা চালিয়ে যাওয়াই এখন দুই সরকারের চূড়ান্ত মাথাব্যথার কারণ হয়েছে। সরকারের হাতে পর্যাপ্ত অর্থ নেই। করোনা পরিস্থিতিতে আয়ের নতুন পথ বের করাও কঠিন।

কেজরিওয়াল তাই দিল্লিতে ক্ষমতায় টিকে যাওয়া মাত্র নরেন্দ্র মোদীর দ্বারস্থ হন। করোনাকালে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী সঙ্গে তাঁর নানান বিষয়ে বিরোধ হলেও কেজরিওয়াল মোদীকে সরাসরি আক্রমণ যথাসম্ভব কমিয়ে দিয়েছেন। এমনকি কাশ্মীরের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ রদের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত সমর্থন করেন। এমনকী হালে দিল্লির জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য নরেন্দ্র মোদীকে কৃতজ্ঞতা জানতেও ভোলেননি।
ওয়াকিবহাল মহলের বক্তব্য, কেজরিওয়াল আসলে বুঝে গিয়েছেন নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে হলে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে একটা বোঝাপড়ার সম্পর্ক রেখে চলতে হবে এবং সেই বোঝাপড়ার সম্পর্কের সেতু করতে হবে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীকেই।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখনই ততটা নরম মনোভাব না নিলেও তিনিও বুঝতে পারছেন যে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা তাঁর পক্ষে অত্যন্ত কঠিন হয়ে উঠতে পারে কেন্দ্রীয় সরকারের সহযোগিতা ছাড়া। আর তাতে অদূর ভবিষ্যতে তাঁর রাজনৈতিক ক্ষতির সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। আসন্ন পুরভোটে মোদী-অমিত শাহকে মোকাবিলার প্রশ্ন নেই।

তৃণমূলের একাংশ আবার মনে করছে, নেত্রীর এমন আচরণ শুধুই দিল্লির কথা মাথায় রেখে। দল তাঁকে আগামী লোকসভা ভোটে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসাবে তুলে ধরতে চায়। সেই লড়াইয়ে আবার অগ্নিকন্যা ভাবমূর্তি কাজে নাও আসতে পারে। সেই কারণে, রাজধানীর সংবাদ মাধ্যমের সামনে তিনি ছিলেন ধীর স্থির, সংযত। তবে, রাজ্যের বেহাল আর্থিক পরিস্থিতি সামলে ওঠার তাগিদেই কেন্দ্রের সঙ্গে আপাতত সংঘাতের পথ এড়াতে চাইছেন তিনি। আর এই ব্যাপারে বার্তা দিতেই কোনও ইস্যুতেই গলা চড়াননি।

রাজ্য সরকারের আর্থিক অবস্থা কেমন? নবান্ন সূত্রের খবর, শুধু স্বাস্থ্যসাথী এবং লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্পের জন্য রাজ্য সরকারের বছরে অতিরিক্ত প্রায় কুড়ি হাজার কোটি টাকা খরচ হবে। এই টাকা কোথা থেকে আসবে তার কোনো আগাম হিসেবে সরকারের তরফে করা হয়নি। মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করার পর অর্থ দফতরের অফিসাররা এ নিয়ে আলাপ আলোচনায় বসেন।

সরকারি কর্তারা জানাচ্ছেন, এখনও পর্যন্ত টাকার সংস্থান করার কোন পাকাপোক্ত ব্যবস্থা কেউই মুখ্যমন্ত্রীর সামনে হাজির করতে পারেননি। মুখ্যমন্ত্রী নিজেই এখন অর্থ দফতর সামলাচ্ছেন। শেষ ভরসা বাজার থেকে ফের ঋণ নেওয়া।

অথচ, ক্ষমতায় এসেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই ব্যাপারে বিগত সরকারের বিরুদ্ধে পদে পদে সরব হন। তাঁর প্রধান অভিযোগ ছিল, বামফ্রন্ট সরকার বিপুল টাকা ঋণ করে গিয়েছে এবং সেই ঋণের টাকা শোধ করতে গিয়ে তাঁর সরকারকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ফলে উন্নয়ন খাতে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ করতে পারছেন না তিনি।
এখন দেখা যাচ্ছে বামফ্রন্ট সরকার ৩৪ বছরে যে পরিমাণ টাকা বাজার থেকে ঋণ নিয়েছিল দশ বছরে তার চাইতে বেশি অর্থ ধার করেছে বর্তমান সরকার। অচিরেই তা পাঁচ লক্ষ কোটি টাকায় পৌঁছে যাবে।

এই পরিস্থিতিতে রাজ্য সরকারের সামনে দুটি পথ খোলা। এক, কেন্দ্রের কাছ থেকে বকেয়া আদায়। খুবই নমনীয় সুরে বুধবার মুখ্যমন্ত্রী জানান, রাজ্যের পাওনার পরিমাণ প্রায় ৯৬ হাজার কোটি টাকা। তাৎপর্যপূর্ণ হল যে শুধু আমফানের পরই রাজ্য সরকার প্রায় এক লক্ষ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ বাবদ দাবি করেছিল। এছাড়াও অতীতের আর অনেকগুলি প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং অন্যান্য খাতেও রাজ্য সরকারের বিপুল অর্থ পাওনা রয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইয়াসের ক্ষয়ক্ষতি। দুই ক্ষেত্রেই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী রাজ্য দল ঘুরে গিয়েছে। আমফানের পর এসেছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও। কিন্তু কেন্দ্রের কাছ থেকে পর্যাপ্ত অনুদান না মিললেও মুখ্যমন্ত্রী গলা চড়াননি। বস্তুত সেই প্রসঙ্গে একটি বাক্যও উচ্চারণ করেননি বুধবার। অর্থাৎ তিনি চাইছেন যে কোনওভাবেই হোক বিরোধ এড়াতে।

বিএসএফের এলাকা বৃদ্ধির বিষয়টিই দেখা যাক। এই প্রসঙ্গে তিনি রাজ্যে যতটা আক্রমনাত্মক ছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক শেষে তার লেশমাত্র দেখা যায়নি। খানিক বিনীত সুরে বলেন যে প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছেন এই সংক্রান্ত সরকারি সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নিতে।

অনেকেই মনে করছেন মুখ্যমন্ত্রী খানিক নমনীয় মনোভাব নিয়েছেন এবং তার মূলে আছে রাজ্যের চলতি আর্থিক পরিস্থিতি। সরকারের ওপর যে বিপুল আর্থিক বোঝা চেপেছে কেন্দ্রীয় সরকারের সহযোগিতা ছাড়া এই পরিস্থিতি থেকে নিস্তার পাওয়া কঠিন। সম্ভবত এই সমস্ত কারণেই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সরাসরি সংঘাতের রাস্তা আপাতত এড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। এই সঙ্গেই আছে নিজেকে প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য দেশবাসীর সামনে একজন ধীরস্থির, প্রাজ্ঞ নেত্রী হিসেবে তুলে ধরা।

পড়ুন দ্য ওয়ালের সাহিত্য পত্রিকাসুখপাঠ

You might also like