Latest News

অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা, আবার যেন আমরা কলুষমুক্ত পৃথিবী দেখতে পারি

এ কোন আমেরিকা? এতগুলো বছর এখানে আছি, কই এই দেশের এই সময়ে এমন চেহারা তো আগে কখনও দেখিনি!

সায়ন্তনী বসু

এই বছর ফেব্রুয়ারির শেষে দেশ থেকে ফিরে বেশ ফুরফুরে মেজাজে দিন কাটছিল। আত্মীয়-বন্ধুদের সঙ্গে কিছুদিন কাটিয়ে লম্বা ছুটির পর মার্চে, মাসের প্রথমে যোগ দিলাম কাজে। তখন কি আর জানতাম সামনে এমন ভয়ঙ্কর দিন ঘনিয়ে আসছে!
আমরা থাকি মেরিল্যান্ডের সেভার্ন শহরে। এখন দু’সপ্তাহ ধরে বাড়িতে বন্দি। সকালে Work From Home আর তারপর বসে বসে Netflix, Amazon Prime series binge দেখা– এটাই এখন আমাদের ‘new normal’। করোনাভাইরাস বীরবিক্রমে আমেরিকা কাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে। তার ভয়ে মেরিল্যান্ড-সহ আমেরিকার বেশিরভাগ স্টেটই লকডাউন। কিছু জরুরি পরিষেবা যেমন গ্রসারি, ওষুধের দোকান ইত্যাদি ছাড়া বাকি সব বন্ধ। এক মাস আগেও করোনা ছিল ‘বিদেশি ভাইরাস’। নিউজ চ্যানেলগুলো অন্যান্য খবর দেখানোর সঙ্গে সঙ্গে news ticker বা crawl-এ জানাচ্ছিল চিনে করোনার ধ্বংসলীলার খবর। এখন CNN, Fox News, MSNBC ও আমেরিকার সব নিউজ চ্যানেলে সারাক্ষণ ধরে চলছে মূলত করোনারই খবর।
এই লেখা যখন লিখছি তখনও পর্যন্ত ৮৫ হাজারেরও বেশি আমেরিকান আক্রান্ত, ৯৩১ জনের মৃত্যু হয়েছে। হুহু করে বাড়ছেও সংখ্যাটা। এত বড় Pandemic যে আমেরিকার মতো দেশও সামলাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে।

মার্চ মাসটা শুরু হয়েছিল আগের মাসগুলোর মতোই। প্রথম সপ্তাহে অফিসে যাওয়ার পথে বাস, মেট্রো বা ট্রেনে কিছু লোককে মাস্ক, গ্লাভস আর হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে দেখলেও ব্যাপারটায় সেরকম গুরুত্ব দিইনি। টনক নড়ল, যখন ১২ মার্চ ভোররাতে অফিস থেকে মেল করে জানিয়ে দিল যে সেদিনের পর থেকে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য অফিস বন্ধ থাকবে। ১২ মার্চের দিনটা শুধু দেওয়া হচ্ছে, যাতে সবাই ল্যাপটপ বাড়ি নিয়ে যেতে পারে। এরপর থেকে ‘until further notice’, সবাই work from home (WFH) করবে।
আমি আর আমার স্বামী দু’জনেই তথ্যপ্রযুক্তি কর্মচারী। ওই সপ্তাহের মধ্যে আমাদের আরও অনেক বন্ধুদের অফিসেও WFH জারি হয়ে গেল। তখনও অবধি মেরিল্যান্ড, ওয়াশিংটন ডিসি বা ভার্জিনিয়ায় সেরকম করোনাভাইরাসের কেস শোনা যায়নি। অবস্থা আরও খারাপ হতে পারে ভেবে পরের দিন, ১৩ মার্চ, শুক্রবার দুপুর নাগাদ আমি আর আমার কর্তা বেরিয়ে পড়লাম বাজারহাট করতে। কিন্তু দোকানে গিয়ে ব্যাপারস্যাপার দেখে আমরা দু’জনেই অবাক আর আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়লাম। পাইকারি বাজার Costco-তে র‌্যাকের পর র‌্যাক খালি পড়ে আছে। চাল, পাঁউরুটি, ফ্রোজেন চিকেন, হাত ধোওয়ার সাবান, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, কিচেন টাওয়েল, বাথরুম টাওয়েল ও আরও বেশ কিছু দরকারি জিনিসপত্র গায়েব হয়ে গেছে। সপ্তাহের অন্য দিনগুলোতে যেখানে মোটে লোক দেখা যায় না Costco-তে, সেখানে দেখছি বিলিং করার লাইনে প্রায় ১০০ জন। ভয় পেয়ে আমরাও দুটো কার্ট ভর্তি করে প্রায় আটশো ডলারের মালপত্র কিনে ফেললাম।
সেই দিনই দৌড়লাম ভারতীয় দোকান ‘Patel Brothers’-এ। গিয়ে দেখি সেখানে পৌঁছতে আমরা দেরিই করে ফেলেছি। চাল, ডাল, বিস্কুট, ফ্রোজেন রুটি, পরোটা সব আগেই শেষ হয়ে গেছে। যা পাওয়া গেল– যেমন পনির, আটা, ময়দা, সুজি, তেল, ঘি, মশলাপাতি– তাই চটপট কিনে নিলাম।

বাড়িতে আমরা ছাড়াও দু’জন বয়স্ক মানুষ– আমার শ্বশুর-শাশুড়ি আর আমাদের আট মাসের বাচ্চা আছে। তাই খাবারদাবার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্টক করতে হবে সেটা বুঝতে আর দেরি হল না। বড় বড় রিটেল স্টোর ছেড়ে আমরা গেলাম ছোট ছোট পাকিস্তানি আর বাংলাদেশি দোকানগুলোতে। কপাল ভাল যে এই দোকানগুলোয় আমরা চাল, ডাল, বিস্কুট, মশলাপাতি, নান, চিনি ইত্যাদি প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো পেয়ে গেলাম। পরে কিছু বন্ধুর কাছে শুনেছি যে তারা উইকএন্ডে গিয়ে ওই দোকানগুলোতেও সেইরকম কিছু জিনিস পায়নি। দু-তিন ঘণ্টা লাইন দিয়ে Costco, Walmart থেকে যেটুকু যা পেয়েছে, নিয়ে এসেছে।
মার্চের মাঝামাঝি থেকে সব স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি বন্ধ হয়ে গেছে। স্টুডেন্টদের জন্যে অনলাইন ক্লাস/ কোর্স ইত্যাদির ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এক সপ্তাহের মধ্যে M D Governor মল, সিনেমা হল, রেস্তোরাঁ, চার্চ, মন্দির সব বন্ধ করে দিল। রাস্তাঘাট, হাইওয়ে, ফি ওয়েগুলো সব শুনশান হয়ে গেছে। অ্যাম্বুলেন্স, পুলিশের গাড়ি আর দমকল ছাড়া কিছুই বিশেষ চলছে না। আমাদের কমিউনিটিতে HOA-এর (Home Owners’ Association) পক্ষ থেকে সুইমিং পুল,কমিউনিটি হল, চিলড্রেন পার্ক সব বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কমিউনিটির মধ্যে সকাল-বিকেল যে কিছু সংখ্যক লোকজন হাঁটত, দৌড়ত, পোষ্যদের নিয়ে ঘোরাত, তাদের কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। সারাদিন বসে জানলার বাইরে তাকিয়ে থাকলে USPS (United States Postal Service), Fedex, UPS– এইরকম কিছু ডেলিভারি সার্ভিস ভ্যান ছাড়া অন্য কোনও গাড়ির দেখা পাওয়া মুশকিল।

নভেম্বর থেকে মোটামুটি ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত স্নো ফলের জন্য ঘরবন্দি প্রায় সব লোকজন শীত চলে গেলে হইহই করে বেড়াতে বেরিয়ে পড়ে। এবারও অনেকে তেমনই জর্জিয়া আর ফ্লরিডার সমুদ্র সৈকতে ভিড় জমিয়েছিলেন।তখনও সব স্টেটের সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল ঘরেই থাকুন। স্টে ইন প্লেস। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা সেকথা শোনেননি। সোশাল ডিসট্যান্সিং মানেননি। তারই ফল বোধহয় এখন ভুগতে হচ্ছে। তারপরে অবশ্য লকডাউন ঘোষণা করা হয়।
এখানে আরও একটা কথা বলা দরকার। করোনাভাইরাস নিয়ে মিডিয়া এবং সরকারের প্রচুর প্রচার সত্ত্বেও বহু আমেরিকান ভাবছিলেন যে এটা ফ্লু। এখনও অনেকে তেমনই ভাবছেন। মনে করছেন এটা শুধু বয়স্ক মানুষদের পক্ষেই ক্ষতিকর। তা যে নয় সেটা কে বোঝায়! করোনাভাইরাস যে বয়েস মানে না তা তো স্পষ্ট হয়ে গেছে।

এখন সব বন্ধ। ঘরে বসে বসে ভাবি, এ কোন আমেরিকা? এতগুলো বছর এখানে আছি, কই এই দেশের এই সময়ে এমন চেহারা তো আগে কখনও দেখিনি!
এই থমথমে পরিবেশের মধ্যেই কিন্তু আমেরিকায় বসন্ত এসে গেছে। আমার বাগানে গোলাপ গাছগুলোয় নতুন পাতা গজিয়েছে। চেরি ব্লসম গাছ ফুলে ফুলে ভরে উঠেছে। শুধু প্রকৃতির এই সৌন্দর্য উপভোগ করার মানুষগুলোই আজ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে গৃহবন্দি হয়ে রয়েছে। বাড়ির বারান্দায় (এখানে বলে ডেক) মাঝেমধ্যে গিয়ে দাঁড়ালে দেখি প্রতিবেশীদের বাগানগুলোও চেরি ব্লসমের শোভায় রঙিন। শুধু সারি সারি বাড়িগুলো যেন হানাবাড়ির মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে। বাইরে থেকে কে বুঝবে এই বাড়িগুলোর বাসিন্দারা সব ভিতরে সেঁধিয়ে আছে করোনার ভয়ে।
করোনাভাইরাস সারা বিশ্বকে শিখিয়ে দিল যে এই গ্লোবাল ভিলেজের যুগে ‘বিদেশি ভাইরাস’ বা ‘অন্য দেশের সমস্যা’– এই সব বলা বা ভাবা নিছকই বোকামি। ‘We are all in this together’। মার্চ মাসের শুরুতে ‘কী করোনা’ বলে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়ানো আমরাই দু’সপ্তাহের মধ্যে খাবারদাবার মজুত করে ঘরবন্দি।
তবে ভাবতে বসলে দেখি, এই ভাইরাস আক্রমণ কতগুলো ভাল দিকের নিশানাও দেখিয়ে গেল আমাদের। বিজ্ঞানীরা বলছেন, গোটা পৃথিবীর পরিবেশ দূষণের মাত্রা নাকি অভাবনীয় ভাবে কমছে। হিমবাহগুলোর গলনের হারও অনেক কমেছে। অর্থাৎ প্রকৃতি আবার তার পুরনো সুস্থতার ছন্দে ফেরার চেষ্টা চালাচ্ছে। আবার অন্যদিকে ধর্ম, জাতপাত, ধনী-দরিদ্রের মধ্যেকার ভেদাভেদ, প্রতিবেশী বা আন্তর্জাতিক দেশগুলির মধ্যেকার মিত্রতা, শত্রুতা সব নিমেষে বিলীন হয়ে গেছে। গোটা পৃথিবী আজ এক সত্যিকারের বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠেছে। করোনা আজ সুদূর চিন, জাপান, ইতালি, স্পেন, ভারতকে আমেরিকার সঙ্গে একই সূত্রে বেঁধেছে। এক দেশের লোক শুধু নিজের দেশ নয়, অন্য দেশের লোকেদের দুর্দশায় গৃহবন্দি অবস্থায় চোখের জল ফেলছে। এ কি কম পাওয়া?
তাই এই মুহূর্তে শুধু এই প্রার্থনাই করছি– ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা/ অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।’ করোনার আক্রমণকে জয় করে আবার যেন আমরা এক নতুন কলুষমুক্ত পৃথিবীর মুখ দেখতে পারি।

(সায়ন্তনী বসু তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী, বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ডের বাসিন্দা।)

You might also like