
দ্য ওয়াল ব্যুরো: গাছের মতো গুরুত্ব পায়নি মাটি। জলবায়ু পরিবর্তন যে অশনি সঙ্কেত দেখাচ্ছে তাতে শুধু জল, বায়ু নয় দূষিত হচ্ছে মাটিও (Soil Pollution)। কলকারখানার বর্জ্য মিশছে মাটিতে, ইঞ্জেকশনের সূচ, জীবাণুযুক্ত তুলো, ব্যান্ডেজ বা মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ সমস্ত পচে গলে মিশে যাচ্ছে মাটির সঙ্গে আর মাটি থেকে জলে। প্লাস্টিকের সূক্ষ্ম কণা থেকে কারখানার তেজস্ক্রিয় পদার্থ, মাটি যেন মারণ বর্জ্যের আঁতুরঘর হয়ে উঠছে। মাটির রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশছে বিষ, গাছপালা সেই বিষই শুষে নিচ্ছে। উদ্ভিদ থেকে তা পৌঁছে যাচ্ছে থাবারের থালায় অথবা ভূগর্ভস্থ জলের সঙ্গে মিশে পানীয় ও রোজকার ব্যবহারিক জলে। বাতাসে মিশছে কার্বণ আর শরীরে মিশছে বিষ– মাটি দূষণের ভয়ঙ্কর প্রভাব বুঝতেই পারছে না এখনকার ডিজিটাল সভ্যতার মানুষ।
তেজস্ক্রিয় বর্জ্য মিশছে মাটিতে, কার্বন মেঘ জমছে বাতাসে
বায়ু দূষণ, জল দূষণ নিয়ে আলোচনা বিস্তর হয়। কিন্তু মাটি দূষণ (Soil Pollution) নিয়ে সচেতনতা সেই আঁধারেই। মার্কিন বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি তাদের একটি গবেষণায় বলেছেন, কলকারখানার দূষণ থেকে নাইট্রোজেন মিশছে মাটিতে। কারখানা. গ্যাস প্ল্যাট, তৈল শোধনাগারের বর্জ্য এবং নানা তেজস্ক্রিয় বর্জ্য মাটিকে শুষ্ক করে তুলছে। এই শুষ্ক মাটি থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড মিশে যাচ্ছে বাতাসে। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, অতিরিক্ত নাইট্রোজেন ও তেজস্ক্রিয় বর্জ্য কার্বনকে ধরে রাখতে পারছে না মাটিতে। এই কার্বন তেজস্ক্রিয়ের সঙ্গে মিশে গিয়ে গ্রিন হাউস গ্যাসের চেহারা নিয়ে বাতাসে মিশছে। প্রতিনিয়ত এমন বিষাক্ত গ্যাস বাতাসে মিশে দূষণের কারণ হয়ে উঠছে।

অতিরিক্ত নাইট্রোজেন কীভাবে মাটির স্বাস্থ্য খারাপ করছে ও বাতাসে গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমণ করছে সেই প্রক্রিয়াটা জানার চেষ্টা করছেন পরিবেশ বিজ্ঞানীরা। মানুষের তৈরি রাসায়নিক দূষণের কারণেও মাটিতে অতিরিক্ত নাইট্রোজেন মিশছে। গাছের ফলন বাড়াতে কীটনাশকের যথেচ্ছ প্রয়োগ, পুরসভার নানা ধরনের বর্জ্য, কৃষিতে ব্যবহৃত নানা রাসায়নিক মাটির ক্ষতি করে। পেট্রোলিয়াম চালিত গাড়ি থেকে নানাবিধ যন্ত্রও মাটির দূষণের কারণ হয়। এই রাসায়নিক ব্যবহারের ফলে কিছু উপজাত দ্রব্যও তৈরি হয়। সেগুলও মাটির ক্ষতি করে। দূষিত মাটি ভূমিক্ষয়ের অন্যতম কারণও।

মাটির প্রাণ ‘বন্ধু’ মাইক্রোবসরা নিশ্চিহ্ন হচ্ছে
মাইক্রোবস বা মাইক্রোঅর্গানিজম বলতে বোঝাচ্ছে মাটিতে বসবাসকারী ব্যাকটেরিয়া, প্রোটোজোয়া, কেঁচো, নিমাটোড, ছত্রাক ও নানা রকম পোকামাকড়কে। মাটির জৈবিক উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য এরাই দায়ী। বিজ্ঞানীরা বলেন, মাটিতে কম করেও ১৫ রকম ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, প্রোটোজোয়া নিমাটোড ও সন্ধিপদী প্রাণীরা বসবাস করে। এরাই মাটির প্রাণশক্তি ধরে রাখে, শস্যের ফলনের জন্য পুষ্টি উপাদানের জোগান দেয়। বর্তমান সময়ে শস্যের ফলন বাড়াতে এত বেশি রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার হচ্ছে যে মাটি নিষ্প্রাণ হয়ে যাচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে মাটির জৈব উপাদান, ছত্রাক ও জীবাণু। কমছে ফলনের পরিমাণ। বিজ্ঞানীরা বলছেন, জৈব উপাদান মাটির প্রাণশক্তি। সেটা ‘হিউমাস’ গঠন করে। তার উপরে নির্ভর করে ছত্রাক ও রাইজোবিয়াম লেগুমিনোসেরাম, ব্যাসিলাস ফার্মাসের মতো উপকারী জীবাণুর বংশবিস্তার। সেটা কমে যাওয়ায় ছত্রাক ও জীবাণু দুর্বল হচ্ছে। তাই মাটি নির্জীব হয়ে যাচ্ছে।

মানুষের তৈরি দূষণ আর বিষাক্ত রাসায়নিকের প্রভাবে মাটির (Soil Pollution) যে দূরাবস্থা হচ্ছে তার ভয়ঙ্কর প্রভাব পড়ছে মানুষের শরীরেও। শস্যের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে সেই রাসায়নিক, সেখান থেকে ঢুকছে মানুষের শরীরে। নানা রকম জটিল মারণ ব্যধির কারণ হয়ে উঠছে।

পুঁজ-রক্তমাখা বর্জ্য ছড়াচ্ছে মাটিতে
হাসপাতাল চত্বরে অনেক সময়ই ব্যবহৃত রক্ত মাখা তুলো, ব্যান্ডেজ, ক্যাথিটার নিয়ে পথ কুকুরদের টানাটানি করতে দেখা যায়। এইসব মেডিক্যাল বর্জ্য (Medical Waste) মাটিতে মিশে নানা রোগ ও অ্যালার্জি জনিত অসুখের কারণ হয়ে উঠছে। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের নির্দেশে এবং নির্দিষ্ট আইনের ভিত্তিতে এই মেডিক্যাল বর্জ্য সাধারণ ভ্যাটে ফেলার কথাই নয়। আলাদা-আলাদা রঙের প্যাকেটে আলাদা-আলাদা বর্জ্য রাখা থাকবে এবং তা প্রতিদিন সংগ্রহ করে নিয়ে যাবে সরকার নিযুক্ত সংস্থা। তার পর নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় ওই বর্জ্য নষ্ট করে ফেলার কথা। আদতে এই নিয়ম মানা হয় না অনেক জায়গাতেই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেডিক্যাল বর্জ্য মাটিতে ফেললে মাছি, মশা ওই বিষাক্ত আবর্জনায় বসে এর পর আশপাশের এলাকার খাবারে মধ্যে বসলে তা থেকে ডায়রিয়া, আমাশা জাতীয় রোগ হতে পারে। জলে বিষাক্ত রাসায়নিক মিশে টাইফয়েড, কলেরা জাতীয় রোগের প্রভাব দেখা যেতে বাধ্য। ডাম্পিং গ্রাউন্ডের লাগোয়া এলাকার শিশুদের ভবিষ্যতে অ্যালার্জিজনিত রোগ বা ত্বকের নানা অসুখ হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাদের একটি রিপোর্টে বলেছিল,হাসপাতাল বর্জ্য থেকে রোগ সংক্রমণের আশঙ্কা অত্যন্ত বেশি। স্বাস্থ্য দফতর নির্ধারিত ‘বায়োমেডিক্যাল ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট রুল’ অনুযায়ী, এই বর্জ্য অন্য ময়লার সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া যাবে না। হাসপাতালের ওয়ার্ডে রোগীর দেহাংশ, টিউমার, থুতু, দেহরস, মলমূত্র, কফ, রস, রক্ত বা পুঁজ লেগে থাকা বর্জ্য ফেলতে হবে হলুদ প্লাস্টিকে। এবং সেই বর্জ্য মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কা থাকে এর থেকে। লাল প্লাস্টিকে সিরিঞ্জ, ক্যাথিটার, ইন্ট্রাভেনাস টিউব, গ্লাভস, স্যালাইন বোতল ফেলতে হবে। নীল রঙের প্লাস্টিকে থাকবে কাচ ও ধাতব বর্জ্য। কালো রঙের পাত্রে থাকবে সাধারণ বর্জ্য। একমাত্র কালো প্যাকেট সাধারণ ভ্যাটে ফেলা যাবে। বাকিগুলো কোনও ভাবেই তা করা যাবে না।
তেজস্ক্রিয় বর্জ্য মহামারীর মতো রোগ ছড়াতে পারে
পৃথিবীর সব উন্নত ও উন্নয়ণশীল দেশেই রয়েছে একাধিক পারমাণবিক চুল্লি। সেখান থেকে নির্গত তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ও পারমাণবিক বর্জ্য পরিবেশের সঙ্গে মিশছে অহরহ। এই তেজস্ক্রিয় বর্জ্য মাটিতেও মিশছে। হাজার হাজার টন এই তেজস্ক্রিয় বর্জ্যকে নিষ্ক্রিয় করে সংরক্ষণ করার কোনও উন্নত প্রযুক্তিই এখনও অবধি সেইভাবে সামনে আসেনি। আমেরিকা, জার্মানি, রাশিয়া এই প্রক্রিয়ায় অনেকটা অগ্রসর হলেও ভারতে এখনও তেমন পদ্ধতি তৈরি হয়নি।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্লুটোনিয়াম ২৩৯ হচ্ছে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন তেজস্ক্রিয় পদার্থ, যা ক্যানসার সৃষ্টির জন্য দায়ী। একটি মাঝারি মাপের পরমাণু চুল্লি প্রতি বছরে ২৫০-৩০০ কিলোগ্রাম প্লুটোনিয়াম ২৩৯ তৈরি হয় যা লক্ষ লক্ষ বছরের জন্য পারমাণবিক দূষণ তৈরি করে। মৃত জীবেও তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব থেকে যায় এবং পরিবেশেও ক্রিয়াশীল থাকে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই তেজস্ক্রিয় বর্জ্য নিষ্ক্রিয় করে নিরাপদে সংরক্ষণ করতে না পারলে আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে প্রাণঘাতী ফুসফুসের ক্যানসার রোগ মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়বে গোটা বিশ্বে।