
দ্য ওয়াল ব্যুরো: শালিমার (Shalimar Coconut Oil)) নারকেল তেলের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ছোটবেলার নস্টালজিয়া। দুর্গাপুজোর ঠিক আগে একসময় টিভি খুললেই কানে ভেসে আসত বিজ্ঞাপনের চেনা সুর। বাঙালির প্রাণের পুজোর প্রেক্ষাপটে নিখুঁত গান বেঁধেছিল শালিমার। আজও পুজোর আগে আগে সেই সুর ভেসে ওঠে মোবাইলের স্ক্রিনে। ঘরে ঘরে শালিমার নারকেল তেলই ছিল মা-কাকিমাদের প্রথম পছন্দ। শুধু তো নারকেল তেল নয়, শালিমার এখন সারা দেশের খাদ্যপণ্যেরও একটা বড় ব্র্যান্ড। যে কুঁড়ি থেকে আজকের এই বিরাট বৃক্ষের পত্তন, সেই কুঁড়ির ইতিহাসটা একবার ফিরে না দেখলেই নয়।
আরও পড়ুন: ২০ টাকায় শ্যামলদার পেট চুক্তি ফুচকা, দেড়শো খেলে ৫০১ টাকা পুরস্কার
চল্লিশের দশকের এক বাঙালি ব্যবসায়ীর হাত ধরে পরাধীন ভারতে গুটি গুটি পায়ে পথচলা শুরু করেছিল শালিমার (Shalimar Coconut Oil)। নেপথ্যে প্রকৃতিনাথ ভট্টাচার্য (Prakritinath Bhattacharya)। বছর ২৩-এর সেই যুবক সেদিনের টালমাটাল পরিস্থিতিতে চাকরি নয়, ব্যবসায় নিজের ভাগ্য পরীক্ষা করে দেখতে চেয়েছিলেন। কখনও আটার কল, কখনও ইঞ্জেকশনের অ্যাম্পুল, নানান ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছিলেন প্রকৃতিনাথ। তাঁর হাত ধরেই ১৯৪১ সালে গড়ে ওঠে ‘শালিমার কেমিক্যাল ওয়ার্কার্স প্রাইভেট লিমিটেড’। বাঙালির প্রিয় নারকেল তেল তৈরি হত এই কারখানাতেই।

তিরিশের দশকে তখন হাওড়ায় ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের রমরমা। কারিগরি শিল্পের দিকেই ঝুঁকছেন সকলে। প্রচলিত সেই ধারায় গা না ভাসিয়ে শিবপুর বাজারে গম পেষাইয়ের কারবার খুলে বসেন প্রকৃতিনাথ। টুলো পণ্ডিত বংশের বামুনের এই মতিগতি মোটেই ভাল চোখে দেখেনি তৎকালীন সমাজ। তবে লোকজনের সেই তর্জনী উপেক্ষা করেই ব্যবসায় মন দেন তিনি। হাতে মূলধন তখন মাত্র আড়াইশো টাকা। ছাত্র ব্যবসা করতে চায় শুনে স্কুল মাস্টার দীনবন্ধু চট্টোপাধ্যায় প্রকৃতিনাথের হাতে গুঁজে দিয়েছিলেন ওই টাকা। তা নিয়ে ‘শঙ্খ আটা কল’ দিব্যি চলছিল। তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষে সে ব্যবসা লাটে ওঠে।
আরও পড়ুন: হঠাৎ করে খুব পেটে ব্যথা, মোচড় দিচ্ছে? ঘরোয়া উপায়ে কমিয়ে ফেলুন
সাইকেলে চেপে কৌটোয় ভরা নারকেল তেল (Shalimar Coconut Oil) পৌঁছে দিতেন প্রকৃতিনাথ

স্বল্প সঞ্চয়ে এরপর জ্ঞানাঞ্জন নিয়োগী মশাইয়ের পরামর্শে ইঞ্জেকশনের অ্যাম্পুল তৈরির ব্যবসা শুরু করেছিলেন প্রকৃতিনাথ। বছর খানেক সেই ব্যবসা চালানোর পর বন্ধু পঞ্চানন মণ্ডলের সঙ্গে মিলে শুরু করেন ‘শালিমার’ (Shalimar Coconut Oil)। প্রথম প্রথম অপরিশ্রুত নারকেল তেল কিনে নিজেদের কারখানায় শোধনের পর শালিমার লেবেল এঁটে তা বিক্রি করা হত। সাইকেলে চেপে কৌটোয় ভরা সেই তেল দোকানে দোকানে পৌঁছে দিয়ে আসতেন প্রকৃতিনাথ নিজে। ১৯৫৫ সাল থেকে ব্যবসার ভোল বদলে যায়। কোপরা বা নারকেলের শাঁস কিনে তা মেশিনে পেষাই করে নারকেল তেল উৎপন্ন করতে শুরু করে শালিমার। ক্রমে ফুলেফেঁপে ওঠে প্রকৃতিনাথের হাতে গড়া ব্যবসা। বছর চারেকের মধ্যে নরেন্দ্রপুরের কাছে কোম্পানি কিনে ফেলে ২৭ বিঘে জমি। বড় কারখানা তৈরি হয় সেখানেই।

বর্তমানে শালিমার সেই কারখানা থেকে শুধু মাথায় মাখার তেল নয় (Shalimar Coconut Oil), উৎপন্ন হয় খাওয়ার তেল, বিভিন্ন মশলাপাতি। দেশজুড়ে শালিমার কোম্পানি তাদের ডালপালা মেলেছে। তেলেঙ্গানাতেও রয়েছে শালিমার কেমিক্যাল ওয়ার্কসের কারখানা।
প্রকৃতিনাথ পরলোকে পাড়ি দিয়েছেন ১৯৮৮ সালে। আজ তাঁর উত্তরাধিকারীদের কাঁধে ভর করেই এগিয়ে চলেছে ‘শালিমার’। পণ্য বিপণনের পাশাপাশি সিনেমার প্রযোজনাতেও হাত পাকিয়েছে সে। ৭৫ বছরের বেশি সময় ধরে ধারাবাহিকভাবে বাঙালির ঐতিহ্য, সংস্কৃতিকে বয়ে নিয়ে চলেছে শালিমার। কুঁড়ি থেকে সে এখন হয়ে উঠেছে বিরাট বটবৃক্ষ।
পরাধীন ভারতে শালিমারের কুঁড়ির উপর দিয়ে অনেক ঝড়ঝাপটা বয়ে গিয়েছিল। তেতাল্লিশের মন্বন্তর, ছেচল্লিশের দাঙ্গা, বিশ্বযুদ্ধের ভ্রূকুটি- একের পর এক ঢেউয়ে টালমাটাল শালিমারকে দু’হাতে আগলে রেখেছিলেন প্রকৃতিনাথ ভট্টাচার্য। দেশ স্বাধীন হলে ব্যবসায় গতি আসে। বিজ্ঞাপনকে হাতিয়ার করে সে ব্যবসাকে আলাদা মাত্রায় নিয়ে যান তিনি। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল আজকের শালিমার। ছক ভাঙা এক ব্যতিক্রমী হিসেবে এই ব্যবসায়ীকে আজীবন মনে রেখে দেবে বাঙালি।