
দ্য ওয়াল ব্যুরো: ধীরে ধীরে ধাপে ধাপে এগোচ্ছে চিন। দুই দেশের সীমানা অর্থাৎ প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলএসি) বরাবর চিনা স্থলবাহিনীর বিশেষ তৎপরতা ধরা পড়েছে উপগ্রহ চিত্রে। শয়ে শয়ে ট্রাক, বুলডোজার, চার চাকার গাড়ি ও অন্যান্য সরঞ্জাম নিয়ে ক্রমশই প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর এগিয়ে আসছে চিন। গত ৯ জুন সীমান্তের কাছে গালওয়ান উপত্যকার যে ছবি স্যাটেলাইটে ধরা পড়েছিল, তার থেকে ১৬ জুনের ছবি অনেকটাই আলাদা। উপগ্রহ চিত্র জানান দিচ্ছে, সীমান্তের কাছে বড়সড় সামরিক প্রস্তুতি চলছে।
লাদাখে চিন-ভারত সীমান্ত যাকে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বলা হয়, তার সঠিক কোনও সীমারেখা চিহ্নিত করা যায়নি। কারণ চিনা সেনা যে এলাকাকে নিজের বলে দাবি করে, ভারত তা করে না। আবার ভারতীয় বাহিনী যতদূর অবধি এলাকাকে নিজেদের বলে, চিন সেটা নস্যাৎ করে দেয়। ম্যাপ দেখলে বোঝা যাবে, আকসাই চিন পেরিয়ে লাদাখের উপর দিয়ে বয়ে গিয়ে শিয়ক নদীতে মিশেছে গালওয়ান নদী। এই গতিপথের মধ্যেই ধরা হয় প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখাকে। পূর্ব লাদাখের এই গালওয়ান উপত্যকাই চিন-ভারত সংঘাতের কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠেছে।
এই গলওয়ান উপত্যকায় বহুদিন থেকেই মুখোমুখি দাঁড়িয়ে চিন ও ভারতীয় সেনা। মাঝেমধ্যেই সংঘাতের পরিস্থিতি তৈরি হয়। মে মাসের গোড়াতেই পূর্ব লাদাখের গালওয়ান উপত্যকা, নাকু লা ও প্যাংগং লেকের উত্তরপ্রান্তে এলএসি পেরিয়ে ভারতীয় এলাকায় কয়েক কিলোমিটার অবধি ঢুকে আসে চিনা ফৌজ। রীতিমতো তাঁবু খাটিয়ে ঘাঁটি তৈরি করে ফেলে। মুখোমুখি হাতাহাতিও হয়। দু’ পক্ষেই জখম হওয়ার ঘটনা ঘটে। এরপরে সেনাস্তরে বৈঠকে ৬ জুনের পরে নাকু লা থেকে দু’পক্ষই কিছুটা পেছিয়ে আসে।
আরও পড়ুন: সীমান্তে তৎপর চিনা বায়ুসেনা, পাল্টা আকাশে যুদ্ধবিমান ওড়াল ভারত
গালওয়ানের যে জায়গায় সংঘাত হয়েছিল প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর ওই জায়গা শিয়ক নদী পর্যন্ত ভারতীয় বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। অর্থাৎ প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার পশ্চিম দিকের অংশটায় ভারতীয় বাহিনী টহল দেয়। এই অংশের উপরেই চিনের নজর রয়েছে। চিন দাবি করে ওই এলাকা তাদের এক্তিয়ারের মধ্যে পড়ে। যদিও এই দাবি বরাবরই খণ্ডন করে এসেছে নয়াদিল্লি।
উপগ্রহ চিত্র দেখাচ্ছে, শতাধিক ট্রাক, ও সামরিক সরঞ্জাম নিয়ে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর ওই এলাকার দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে চিনা বাহিনী। ৯ জুনের উপগ্রহ চিত্রে দেখা গিয়েছিল ওই এলাকা একেবারেই জনশূন্য। ১৬ জুনের স্যাটেলাইট ইমেজে দেখা গেছে, ট্রাক, বুলডোজার মিলিয়ে অন্তত ৭৯টি গাড়ি এলএসি থেকে ১.৩ কিলোমিটার দূরে দাঁড়িয়ে আছে।
পরের উপগ্রহ চিত্রে দেখা গেছে, ক্রমশই এই সংখ্যা বাড়ছে। এলএসি বরাবর চিনা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় ১২৭টি গাড়ির বিরাট জমায়েত লক্ষ্য করা গেছে। এই এলাকা এলএসি থেকে ৬ কিলোমিটার দূরত্বে রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ট্রাক, বুলডোজার ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম নিযে যুদ্ধের প্রস্তুতিই নিচ্ছে চিন। অতর্কিতে হামলা হতে পারে যে কোনও সময়েই। এলএসি থেকে ২.৯ কিলোমিটার রেঞ্জের মধ্যে চিনা বাহিনীর ৫০ টি ক্যাম্প ধরা পড়েছে উপগ্রহ চিত্রে। রীতিমতো তাঁবু খাটিয়ে এলএসি বরাবর সামরিক সরঞ্জাম প্রস্তুত রাখছে চিন।
আরও একটা জিনিস ধরা পড়েছে উপগ্রহ চিত্রে। সেটা হল, এলএসি বরাবর গালওয়ান নদীর যে গতিপথ সেখানেই নতুন করে কোনও কাঠামো গড়ে উঠেছে বলে মনে করা হচ্ছে। ৯ জুনের উপগ্রহ চিত্রে নদী উপত্যকায় তেমন কোনও কাঠামো দেখা যায়নি। তবে ১৬ জুনের উপগ্রহ চিত্রে দেখা গেছে, নদী উপত্যকা বরাবর এলএসি থেকে ৬০০ মিটারের মধ্যে নতুন করে কোনও কাঠামো তৈরি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্যাম্প করে সামরিক প্রস্তুতি চালাচ্ছে চিন। ভারত সীমান্ত থেকে মাত্র ২০০ কিলোমিটারের মধ্যে পুরোদস্তুর বিমানঘাঁটিও গড়ে তুলেছে। লাদাখের প্যাংগং লেকের ২০০ কিলোমিটার দূরে তিব্বতের ‘গাড়ি কুনসা’য় দশ বছর আগেই একটি বিমানবন্দর বানিয়েছিল চিন। বেজিং তখন জানিয়েছিল, অসামরিক বিমান পরিবহণের জন্যই ওই বিমানবন্দর তৈরি করা হচ্ছে। কিন্তু উপগ্রহ চিত্রে ধরা পড়েছে, গত এক মাসে ওই বিমানবন্দরের সম্প্রসারণের কাজ রাতারাতি বেড়ে গেছে এবং সেখানে রীতিমতো একটি বিমানঘাঁটি তথা এয়ারবেস বানিয়ে ফেলেছে চিন।
গালওয়ান নদীর গতিপথে বুলডোজার দাঁড়ি করিয়ে দিয়েছে চিন। উপগ্রহ চিত্রে সেটাও ধরা পড়েছে। যার কারণে উপত্যকা বরাবর নদীর প্রবাহ বাধা পেয়েছে।
উপগ্রহ চিত্র দেখে মনে করা হচ্ছে, এলএসির পেট্রল পয়েন্ট ১৪-র কাছেই দুই দেশের বাহিনীর মধ্যে সংঘাত হয়েছিল। এলএসি ঘেঁষা ওই রাস্তা দারফুক, শিয়ক ছুঁয়ে চিন নির্মিত কারাকোরাম পাসের কাছে শেষ হয়েছে। সংঘাতের স্পষ্ট চিহ্ন ধরা পড়েছে উপগ্রহ চিত্রে।