Latest News

Pratima Banerjee: লতা-সন্ধ্যা নয়! বরাবর প্রতিমাকেই প্রথমে রেখেছিলেন হেমন্ত

দ্য ওয়াল ব্যুরো: বাংলা গানের স্বর্ণযুগ আলো করেছিলেন মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় (Hemanta Mukherjee), সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় (Sandhya Mukherjee), কিশোর কুমাররা। বাংলা লিরিকসে মন-প্রাণ ঢেলে দিয়ে যে সুরের আলোড়ন তাঁরা তুলেছিলেন তাতেই মিহি কণ্ঠের প্রলেপ এঁকেছিলেন আরও এক তারকা। তবে সঙ্গীতের আকাশে আজীবন নীরব নক্ষত্র হয়েই মিটিমিটি জ্বলেছেন তিনি। তাঁর নাম প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় (Pratima Banerjee)। গানের জগতের বাঘা বাঘা তারকাদের চোখ ধাঁধানো আলোতে তাঁর জ্যোতি খানিক ম্লান হয়ে যায় ঠিকই, কিন্তু প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা গানে নিজেই ছিলেন পূজনীয় প্রতিমার মতো। নীরব, অথচ কাঁচের মতো স্বচ্ছ, স্পষ্ট, উজ্জ্বল।

১৯৪৫ সালে প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বয়স যখন মাত্র ১১, তখনই তাঁর প্রথম গানের রেকর্ডটা বেরিয়েছিল। সুকৃতি সেনের কথা ও সুরে বেসিক গানের সেই রেকর্ড দিয়েই শুরু প্রতিমার পথ চলা। এগারো বছরের ‘কুমারী প্রতিমা চ্যাটার্জী’ কি তখন জানতেন তিনি সঙ্গীত দুনিয়ার শিখরে পৌঁছে যাওয়া বাঘা বাঘা শিল্পীদের সঙ্গে একাসনে বসবেন একদিন! তাঁর মিহি কণ্ঠের জাদুই একদিন মন গলিয়ে দেবে সক্কলের! প্রতিমা হয়ে উঠবেন ‘গানের পাখি’।

প্রতিমার গলায় হেমন্তর মুগ্ধতা (Pratima Banerjee)

হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বরাবরই প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গানের তারিফ করেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি লতা মঙ্গেশকর, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়দের থেকেও আগে রেখেছিলেন প্রতিমাকে। শোনা যায়, একবার এক সাংবাদিক হেমন্তবাবুকে প্রশ্ন করেছিলেন, তাঁর সমসাময়িক মহিলা সঙ্গীতশিল্পীদের মধ্যে কাকে তিনি প্রথমে রাখবেন? কার কণ্ঠ সবচেয়ে সুরেলা?
সাত-পাঁচ না ভেবেই নাকি হেমন্ত উত্তর দিয়েছিলেন ‘প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়’। উত্তর শুনে খানিক অবাকই হয়েছিলেন ওই সাংবাদিক। পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন, লতা মঙ্গেশকর, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় থাকতে প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম করছেন? বলা বাহুল্য, প্রশ্নকর্তা উক্ত দুই নামের একটি আশা করছিলেন হেমন্তের মুখে। কিন্তু সে প্রশ্ন হেসেই উড়িয়ে দেন হেমন্ত। বরং ওই সাংবাদিককে আরও এক অজানা কথা শুনিয়ে দেন সঙ্গে সঙ্গে। বলেন, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলার স্বরে মুগ্ধ লতা, সন্ধ্যারাও। এমনকি লতা মঙ্গেশকর তো নিজের ব্যক্তিগত সংগ্রহেও রেখে দিয়েছেন প্রতিমার গান! সকলেই বলাবলি করেন, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় আসলে মানুষ নয়, তিনি পাখি, গানের পাখি। তাঁর কণ্ঠ এতই মিহি, যে মানুষের স্বর বলে বিশ্বাসই করতে পারতেন না কেউ কেউ।

ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছিলেন প্রতিমা (Pratima Banerjee)

হঠাৎ কোনও একদিন হারমোনিয়াম ধরেই কিন্তু গানের আকাশে তারা হয়ে জ্বলে উঠতে পারেননি প্রতিমা। তাঁর রক্তেই মিশে ছিল গানের কলি। আর সেই সঙ্গে তাঁর এই গানের সাধনার সঙ্গে জুড়ে ছিল স্বামীহারা এক অভাবী মায়ের হার না মানা সংগ্রাম। এক বছর বয়সি একরত্তি প্রতিমাকে রেখে পরলোকে পাড়ি দিয়েছিলেন তাঁর বাবা মণিভূষণ চট্টোপাধ্যায়। তিনিও গান গাইতেন খাসা। তাঁর গানের একটি রেকর্ডও বেরিয়েছিল সেকেলে কলকাতায়। মণিভূষণের মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী কমলাদেবী নিজের চেষ্টায় সংসারের হাল ধরেন, প্রতিমার হাতে তুলে দেন বাবার ফেলে যাওয়া গীতবিতানটুকু। এরপর কষ্টেশিষ্টে রক্ত জল করা টাকা জমিয়ে মেয়েকে হারমোনিয়ামও কিনে দিয়েছিলেন কমলা। ছোটবেলাতেই প্রকাশকালী ঘোষাল, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের মতো গুরুকে শিক্ষকাসনে পেয়েছিলেন প্রতিমা। প্রথম রেকর্ডের পর তাঁকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

পার্শ্বচরিত্রের প্লে-ব্যাকে প্রতিমা (Pratima Banerjee)

প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গানের সমালোচকরা কেউ কেউ বলেন, তিনি ঠিকমতো আবেগ ঢেলে গাইতে পারতেন না। তাঁর গানে আবেগের ঘড়া নাকি কানায় কানায় পূর্ণ ছিল না। আর সেই কারণেই নাকি সিনেমার প্লে-ব্যাকে প্রতিমাকে দেওয়া হত পার্শ্বচরিত্রের কণ্ঠ। নায়িকার কণ্ঠে নাকি তাঁর মিহি আবেগবর্জিত গলা ঠিকমতো খাপ খেত না। কিন্তু নিন্দুকদের এই বিশ্লেষণ হেলায় উড়ে যায় ১৯৭৪-এ এসে। প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সবচেয়ে জনপ্রিয়, সাড়া জাগানো গানটা মুক্তি পেল ওই বছরেই। হৃদয়ের সবটুকু আবেগ নিংড়ে দিয়ে প্রতিমা গাইলেন, ‘বাঁশ বাগানের মাথার উপর, চাঁদ উঠেছে ওই…’
প্রতিমার দরদী কণ্ঠের জাদু সেদিন ছিটকে দিয়েছিল আপামর বাঙালি শ্রোতাকে। সুরের মূর্ছনায় বিবশ হয়ে তাঁরাও হন্যে হয়ে খুঁজেছিলেন ‘শোলক বলা’ কাজলা দিদিকে। আর প্রতিমার ঠিকানায় জমা পড়েছিল গুচ্ছ গুচ্ছ ফ্যান-লেটার।

কালজয়ী গানে প্রতিমা (Pratima banerjee)

সমালোচকদের মুখে কুলুপ এঁটে দিয়ে এরপর থেকে প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গানের তরণী গতি পেয়েছিল আরও। ‘নিঙারিয়া নীল শাড়ি শ্রীমতি চলে’ থেকে শুরু করে ‘ত্রিবেণী তীর্থপথে কে গাহিল গান’, ‘সংসারে যদি নাহি পাই সাড়া’, ‘একটা গান লিখো আমার জন্যে’, একের পর এক কালজয়ী গানে বাঙালিকে মাতিয়ে দিয়েছেন প্রতিমা। কেরিয়ারে তিনি নিজের পাশে গুরুজনের মতো পেয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে। যিনি কখনও ভগ্নিসম প্রতিমার মাথায় চাটি মেরে বলেছেন, ‘ঠিক করে গা, ওভাবে কেন সুর ধরলি!’ আবার পরমুহূর্তেই মাথায় হাত রেখে হেসে ফেলেছেন। বলেছেন, ‘আচ্ছা, তোর নিজের মতো করেই গা’।

‘পাথর’ প্রতিমা (Pratima Banerjee)

প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা বড় গুণ ছিল, তিনি গানের সময়ে থাকতেন অস্বাভাবিক স্থির, অচঞ্চল। তাঁর গান শুনতে শুনতে হয়তো মাথা নেড়ে সুরের সাগরে ডুবছেন শ্রোতারা, কেউ হাতে হাতে তাল রাখছেন, কারও পা নড়ছে ছন্দ মিলিয়ে, কিন্তু গানের কারিগরটির সেদিকে খেয়াল নেই। গাইতে গিয়ে মুখ-চোখের একটা রেখাও কখনও কাঁপেনি প্রতিমার। হাত-পা নড়েনি একচুলও। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বলতেন, ‘প্রতিমা বাঁশরীকণ্ঠী। তাঁর চেয়ে সুরে সারেগামাপা আর কেউ গাইতে পারে না।’

লতা মঙ্গেশকর, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, কিশোর কুমার, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়- বাংলা গানকে দশকের পর দশক ধরে বহন করেছেন যাঁরা, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদেরই সহযাত্রী। কণ্ঠভরা প্রতিভা নিয়ে বাঙালি মায়ের কোল আলো করে এসেছিলেন তিনি। সে নক্ষত্র গানের জগতে ধ্রুবতারা হয়ে জ্বলে থাকবে আজীবন, প্রতিমার পক্ষী-কণ্ঠ বাঙালির হৃদয় থেকে ফিকে হবে না। বরং যত দিন এগোবে, ততই উজ্জ্বল হবে তার দ্যুতি।

আনন্দমঠ উপন্যাস সেলুলয়েডে বন্দি হতে চলেছে! তবে বাংলায় নয়

You might also like