
দ্য ওয়াল ব্যুরো: ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরের মতো, ১৯৯৯-এর ২৬ জুলাই ভারতীয় সেনাবাহিনীর জন্য অত্যন্ত গর্বের। ’৭১-এ পাকিস্তানকে যুদ্ধে পর্যুদস্ত করে বাংলাদেশের মাটিতে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেছিল ভারতীয় সেনাবাহিনী। আর ১৯৯৯-এর ২৬ জুলাই কার্গিল-সহ (Kargil War) কাশ্মীরের বিস্তীর্ণ পর্বত ঘেরা ভারতীয় ভূখণ্ড পাক সেনার কবল মুক্ত করে জওয়ানদের টিম ইন্ডিয়া।
অন্যদিকে, পাকিস্তান যুদ্ধ দুটিতে শুধু পরাজয় স্বীকার করেনি, দেশে প্রশ্নের পদে পদে মুখে পড়েছে সে দেশের সেনা। আজও তাই পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ সেনাকে নিয়ে গর্ব করার থেকে সন্দেহ করে বেশি। রবিবার প্রয়াত সে দেশের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট তথা সাবেক সেনাকর্তা পারভেজ মোশারফের মৃত্যুতে শোকের আবহেও দেশের মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে সেনার অপকর্ম নিয়েও চর্চা চলছে।
মোশারফ পাক সেনার প্রধান হওয়ার আগে পর্যন্ত আর এক প্রাক্তন সেনাকর্তা তথা দেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউল হককে বলা হত সবচেয়ে ক্ষমতালোভী, তীক্ষ্ম বুদ্ধির মানুষ। প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ সেনাপ্রধানের পদে মোশারফকে বসানোর পর বোঝা যায়, ক্ষমতার লোভ এবং চতুর বুদ্ধি কাকে বলে।
পাকিস্তানে ফের নাশকতা! বালুচিস্তানের সেনা ছাউনির কাছে ভয়াবহ বিস্ফোরণ, আহত অনেকে
নওয়াজ শরিফ তাঁকে সেনা প্রধানের পদ থেকে সরাতে চান, জেনেই অনুগত অফিসারদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে শ্রীলঙ্কা সফরে গিয়েছিলেন মোশারফ। চতুর মোশারফে আশঙ্কা এবং অঙ্ক দুই-ই মিলে যায়। কলম্বো থেকে মোশারফের ফিরতি বিমান পাকিস্তানের দিকে উড়তে শুরু করলে নওয়াজ সেনা প্রধানকে পদচ্যুত দেশের মাটিতে তাঁর বিমান নামতে দিতে অস্বীকার করেন। সেনা প্রধানকে নিয়ে বিমান যখন আকাশে চক্কর কাটছে তখনই মোশারফের অনুগত এক উপ সেনাকর্তা প্রধানমন্ত্রীকে গৃহবন্দি করে দেশের নিয়ন্ত্রণ হাতে নিয়ে নেন। নিরাপদে নেমে আসে মোশারফের প্লেন।
দুই সিনিয়র সেনাকর্তাকে বাদ দিয়ে সেনাপ্রধানের পদে মোশারফকে বেছে নিয়েছিলেন নওয়াজই। কিন্তু কার্গিলে যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ার পর তিনি টের পান কত বড় ভুল হয়ে গেছে তাঁর। আর তখন থেকেই সময় আর সুযোগ খুঁজছিলেন নওয়াজ সেনার শীর্ষপদ থেকে মোশারফকে সরাতে।
পাক সেনার একাধিক অফিসার আত্নজীবনীতে জানিয়েছেন, কারগিল সীমান্ত দিয়ে সেনা পাঠিয়ে ভারতের ভূখণ্ড দখল করার পরিকল্পনাটি ছিল একান্তভাবেই সেনা প্রধান মোশারফের। সেই পরিকল্পনা তিনি প্রতিরক্ষামন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী, এমনকী নৌ ও বিমান বাহিনীর প্রধানদের কাছেও গোপন রেখেছিলেন।
কেন এমন পরিকল্পনা করেছিলেন মোশারফ? আসলে ১৯৬৫ এবং ১৯৭১-এর যুদ্ধে পাক সেনার পরাজয়ের গ্লানি মোশারফের গায়েও লেগে ছিল। ওই দুটি যুদ্ধ ছাড়াও ভারতীয় সেনার সঙ্গে একাধিক সংঘর্ষে পাক সেনাকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। প্রত্যেকটিতেই পিছু হটতে হয় পাক সেনাকে। বদলা নিতে মোশারফ তাই প্রধানমন্ত্রী পদে নওয়াজের পূর্বসূরি বেনজির ভুট্টাকেও কাশ্মীর দখলের পরিকল্পনা বাতলেছিলেন। রাজি হননি বেনজির।
নওয়াজের অধীনে কাজ করার সময় স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর কাছেও মোশারফ গোপন করে যান পরিকল্পনা। তাঁর পরিকল্পনা ছিল পাক সেনার হানাদারিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জেহাদিদের মাতৃভূমি দখলমুক্ত করার চেষ্টা বলে চালানো। তাই কার্গিলের ভারতীয় বাসিন্দারা দেশের সেনা ছাউনিতে এসে অচেনা লোকের আনাগোনার খবর দিয়েছিল। ভারতীয় গোয়েন্দারা তদন্ত চালিয়ে জানতে পারেন সাধারণ পাক নাগরিকের পোশাক পরা লোকেদের হাতে হাতে ঘুরছে আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। যুদ্ধে তাদের উপযুক্ত জবাব দেয় ভারতীয় বাহিনী।
নিজের অজান্তে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া এবং পরাজয়ের গ্লানিতে ক্ষুব্ধ নওয়াজ শরিফ সেনা প্রধানের পদ থেকে মোশারফকে সরাতে গিয়ে নিজেই গদি হারান। ১৯৯৯-এর ১২ অক্টোবর রক্তরাতহীন অভ্যুত্থানে দেশের শাসনভার নওয়াজের হাত থেকে কেড়ে নেয় মোশারফের সেনা। পরে তিনি দেশের প্রেসিডেন্ট হন।