
অমল সরকার
আগামী বছর ফেব্রুয়ারি-মার্চ নাগাদ করোনা পরিস্থিতির কি ফের অবনতি হতে পারে? বেড়ে যেতে পারে সংক্রামিতের সংখ্যা। এমন বহু সম্ভাবনার মাথায় রেখে উত্তরপ্রদেশে বিধানসভার ভোট কিছুদিনের জন্য পিছিয়ে দিতে নির্বাচন কমিশন ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে অনুরোধ করেছেন এলাহাবাদ হাইকোর্টের এক বিচারপতি। তিনি একটি মামলায় এই অভিমত ব্যক্ত করে রায় দিয়েছেন। আদালতের রায়ের প্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশনের ফুল টিম আগামী সপ্তাহে লখনউ যাচ্ছে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে। সোমবার কমিশন কর্তারা বৈঠক করবেন কেন্দ্রের স্বাস্থ্যসচিব রাজেশ ভূষনের সঙ্গে।
এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়, উত্তরপ্রদেশে যোগী আদিত্যনাথ সরকারের করোনা নিয়ে একের পর এক পদক্ষেপ, নাইট কার্ফু ফের জারি করা এবং সংক্রমণ বৃদ্ধি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর হুঁশিয়ারির মধ্যে বিরোধীরা অনেকেই ‘দুয়ে দুয়ে চার’ দেখতে পাচ্ছেন। দলকে অস্বস্তিতে ফেলে বিক্ষুব্ধ বিজেপি নেতা তথা সাংসদ সুব্রহ্মমনিয়ম স্বামীর বক্তব্য, উত্তরপ্রদেশে বিজেপির অবস্থা ভালো নয়। ভোট পিছনো ছাড়া উপায় নেই।
অন্যদিকে, প্রধান বিরোধী দল সমাজবাদী পার্টির সাংসদ রামগোপাল যাদব এলাহাবাদ হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বিচারপতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি তুলেছেন। তাঁর বক্তব্য, সুপ্রিম কোর্ট ওই বিচারপতিকে শো-কজ করুক। এটা দুর্ভাগ্যের যে গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক পদে আসীন ব্যক্তিরা এইভাবে প্রশাসনকে প্রভাবিত করছেন। তাঁরও বক্তব্য, হারের ভয়ে ভোট পিছতে চাইছে বিজেপি। তবে হাইকোর্টের বক্তব্য নিয়ে শাসক ও বিরোধী কোনও শিবিরই প্রকাশ্যে খোলসা করে নিজেদের অভিমত জানায়নি বিষয়টির স্পর্শকাতরতার কথা মাথায় রেখে। কারণ, চলতি পরিস্থিতিতে ভোট হলে মানুষের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে কেউ নিশ্চিত নয়।
সংশ্লিষ্ট মামলায় বিচারপতি শেখর যাদব অবিলম্বে মিটিং-মিছিল বন্ধ করার কথা বলেছেন। সেই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সতর্কবার্তার কথাও উল্লেখ করেছেন রায়ে। সেই মামলায় এ বছর এপ্রিম-মে মাস নাগাদ উত্তরপ্রদেশে পঞ্চায়েত ভোটের প্রসঙ্গ আসে। ভয়াবহ করানো পরিস্থিতির মধ্যে ভোট করে যোগী সরকার। তখন বিরোধীরা ভোট করাতে আপত্তি তুলেছিল। কিন্তু সরকার না মানায় ভোটের ডিউটিতে যোগ দিয়ে ১৬২১জন শিক্ষক কোভিড আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তখন বিজেপির পরিকল্পনা ছিল ভোট করিয়ে নিয়ে নতুন পঞ্চায়েতের হাত দিয়ে সরকারি সুবিধার বিলিবণ্টন।
এবার করোনা এবং ওমিক্রনের জন্য ভোট পিছতে হলে তখন কী হবে? উত্তরপ্রদেশের পাশাপাশি পাঞ্জাব, মণিপুর, গোয়াতেও বিধানসভার ভোটের প্রচার শুরু হয়ে গিয়েছে। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে ওই রাজ্যগুলির বিধানসভার মেয়াদ শেষ হবে। তার মধ্যে নতুন বিধানসভা গঠন করতে হবে।
নির্বাচন কমিশন গত বছর বিহার এবং এ বছর বাংলা-সহ পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা ভোটের আগেই জানিয়ে দিয়েছিল তারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের অতিমারী নিয়ন্ত্রণ বিধি অক্ষরে অক্ষরে পালন করে ভোট করার চেষ্টা চালাবে। সংবিধানের ৩২৪ নম্বর অনুচ্ছেদে নির্বাচনের ব্যাপারে কমিশনকে সর্বোচ্চ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
ওই সাংবিধানিক ক্ষমতার কথা মাথায় রেখেই সুপ্রিম কোর্ট ভোট সংক্রান্ত মামলায় কমিশনের সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করে না। কিন্তু কমিশন যদি ভোট পিছিয়ে দিতে বাধ্য হয় তখন কী হবে? তাছাড়া, উত্তরপ্রদেশে ভোট পিছলে অদূরে পাঞ্জাবেও পিছিয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিরোধীদের বক্তব্য, তাতে লাভ হবে বিজেপি। কারণ, কংগ্রেস শাসিত পাঞ্জাবে তারা রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করে ভোট করাতে পারবে।
সাংবিধানিক বিধান অনুযায়ী কমিশন লোকসভা (অনুচ্ছেদ ৮৫ (১)) এবং বিধানসভার (অনুচ্ছেদ ১৭৪ (১)) ভোট সর্বোচ্চ ছ’ মাস পিছতে পারে। এই দুই আইনসভার ক্ষেত্রেই দুটি অধিবেশনের মধ্যে সর্বোচ্চ ছ-মাসের ব্যবধান থাকতে পারে।
কিন্তু তার মধ্যেও যদি পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হয় তখন কী হবে? কমিশনের কর্তারা মনে করছেন সম্ভাব্য পরিস্থিতির নিরিখে যে দুটি সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে তাতে তাদের পরামর্শ দেওয়া ছাডা আর কিছু করনীয় থাকবে না। এক, জরুরি অবস্থা জারি। দুই, রাষ্ট্রপতির শাসন।
সংবিধানের ১৭২ (১) অনুচ্ছেদ অনু়যায়ী জরুরি অবস্থার মধ্যে সর্বোচ্চ এক বছর এবং তা প্রত্যাহারের পর আরও ছয় মাস অর্থাৎ মোট দেড় বছর পর্যন্ত কমিশনের হাতে ভোট স্থগিত রাখার ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু সংবিধানে মহামারী, অতিমারীর কারণে জরুরি অবস্থা জারির সংস্থান নেই। সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার মতো পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্যই শুধুমাত্র জরুরি অবস্থা জারি করতে পারে কেন্দ্র। ফলে তৃতীয় সম্ভাবনা হিসাবে থাকছে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি, যা তুমুল রাজনৈতিক জটিলতা ও সংঘাতের জন্ম দেবে। বিরোধীরা মনে করছে, উত্তরপ্রদেশ ও পাঞ্জাবে ভোট পিছলে লাভ হবে বিজেপির। সেখানে এখনও পরিস্থিতি পুরোপুরি বিজেপির অনুকূলে নয়। ফলে ঘন ঘন যোগীর রাজ্যে ছুটছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
ওই রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় থাকায় সেখানে রাষ্ট্রপতি শাসনে ভোট হলেও লাভ হবে শাসক দলের। অন্যদিকে, পাঞ্জাবে অমরিন্দর সিংহের পার্টির সঙ্গে বিজেপি বোঝাপড়া করলেও এখন তারা পুরোপুরি গুছিয়ে উঠতে পারেনি। পাঞ্জাবে মুখ থুবড়ে পড়লে গোটা দেশেই কৃষকদের মধ্যে বিজেপি বিরোধী হাওয়া জোরদার হবে, আশঙ্কা দলের। তাই পাঞ্জাবে আরও সময় নিয়ে ভোটে যেতে যায় গেরুয়া শিবির।