
দ্য ওয়াল ব্যুরো: চিনা গবেষণাগারে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র বনাম প্রাকৃতিক বিপর্যয়। করোনা ভাইরাসের উৎপত্তি নিয়ে এক বছর আগে বিভিন্ন মহলে বিতর্ক দানা বেঁধেছিল। প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও চক্রান্তের তত্ত্বকে সামনে টেনে এনে জিনপিং সরকারকে কোণঠাসা করার চেষ্টা চালিয়েছিলেন।
কিন্তু খোদ তাঁর দেশে, তাঁর সরকারি আধিকারিক মহলেই যে ঘরের শত্রু বিভীষণ থাকতে পারে, একথা হয়তো ঘুণাক্ষরেও টের পাননি তিনি। মার্কিন মুলুকে বাইডেন প্রশাসনের শীর্ষ স্বাস্থ্য উপদেষ্টা অ্যান্থনি ফসিকে নিয়ে ইমেল বিতর্ক সেই জল্পনা উস্কে দিয়েছে।
এখনও চূড়ান্ত নয় কিছুই। যবনিকা সবে উঠেছে। কিন্তু চিন-মার্কিন ‘সমঝোতা’র ইঙ্গিতে ইতিমধ্যে বিশ্ব রাজনীতি দুলে উঠেছে। উহানের ল্যাবকে ফসির পরোক্ষে সমর্থন জোগানো, ল্যাব-ষড়যন্ত্রের অভিযোগকে কার্যত নস্যাৎ করা, বিনিময়ে চিনের এক শীর্ষ চিকিৎসকের ধন্যবাদজ্ঞাপন— এতদিনকার দ্বিপাক্ষিক বৈরীতার অঙ্ককে এক ঝটকায় এলোমেলো করে দিয়েছে। যদিও চলতি বিতর্কে অ্যান্থনি ফসির পাশেই দাঁড়িয়েছে হোয়াইট হাউজ। সরকারি বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, এখন ১৭ মাসের পুরোনো কাসুন্দি ঘাঁটার সময় নয়। অতি মহামারী মোকাবিলায় ফসির যা ভূমিকা, তা কখনও ভোলা যাবে না।
কিন্তু মার্কিন জনতা এত সহজে সবকিছু ভুলে যেতে রাজি নয়। বিশেষত, গত এক বছরে যে ব্যাপক দুর্যোগ বয়ে গেছে, তারপর এমন চাঞ্চল্যকর অভিযোগকে সহজে হাতছাড়া করতে রাজি নয় কোনও পক্ষই। ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমে পড়েছেন ট্রাম্পও। নিজের অব্যর্থ অনুমানকে ফের সামনে এনেছেন তিনি। দাবি করেছেন, চিনের উচিত আমেরিকাকে ১০ ট্রিলিয়ন ডলার আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়া!
সম্প্রতি হাটে হাঁড়ি ভেঙে বিতর্কের সূত্রপাত করে ওয়াশিংটন পোস্ট, ফক্স নিউজের মতো সংবাদসংস্থা। ফসিকে মূল চক্রী ঠাউরে তারা একের পর এক পুরোনো ইমেল সামনে আনতে থাকে। সেখানে বলা হয়, দেশের কয়েক হাজার চিকিৎসক স্বাস্থ্য উপদেষ্টাকেই চিনের সঙ্গে হাত মেলানোর কাণ্ডারি মনে করেন।
তবে পালে হাওয়া জুগিয়েছে বিশেষ একটি মেল। যার প্রেরকের নাম ডা. পিটার ডাসজাক। তিনি ইকোহেলথ অ্যলায়েন্স নামে একটি অলাভজনক সংস্থার প্রধান। তাৎপর্যপূর্ণভাবে ওই সংস্থার সঙ্গে উহান ইন্সটিটিউট অব ভাইরোলজির গাঁটছড়া রয়েছে।
গত বছর ফসিকে পাঠানো ইমেলে পিটার লেখেন, ‘আপনি উহানের ল্যাব থেকে ভাইরাস ছড়ানোর সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করে যেভাবে বাদুড় থেকে মানুষের দেহে জীবাণু সংক্রমণের তত্ত্বকে সমর্থন করেছেন, তার জন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে আপনাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই।’ উল্লেখ্য, সে সময় কার্যত ট্রাম্পের উলটো সুরে হোয়াট হাউজে দাঁড়িয়ে ফসি ঘোষণা করেছিলেন, করোনার ছড়িয়ে পড়ার মূলে প্রাকৃতিক কারণ থাকতে পারে। কিন্তু এর পেছনে কোনওভাবেই বিশেষ কোনও গবেষণাগারকে দায়ী করা ঠিক নয়।
এরপর গবেষকদের একটা বড় অংশ ল্যাব-লিক থিয়োরিকে দূরে সরিয়ে অন্যান্য সম্ভাবনা কাটাছেঁড়া করতে শুরু করেন। এমনকী ‘ল্যান্সেট’-এর মতো বিখ্যাত সায়েন্স জার্নালও পিটার ডাসজাকের সঙ্গে একযোগে দাবি করে, কোনও ষড়যন্ত্র নয়৷ কোভিড-১৯-এর নিশ্চিতভাবে কোনও প্রাকৃতিক উৎস রয়েছে।
যদিও বিডেন প্রশাসন চলতি বিতর্কের মুখে ফসির পাশেই দাঁড়িয়েছে। বৃহস্পতিবার হোয়াইট হাউজের প্রেস সেক্রেটারি জেন সাকি বলেন, ‘উনি আমাদের দেশের কোভিড যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। আর তা ছাড়া আমি ১৭ মাস আগের ইমেল নিয়ে নতুন করে কিছু বলার উদ্যমও পাচ্ছি না। প্রেসিডেন্ট বাইডেনও তাই মনে করেন। ডা. ফসি যেভাবে বাড়তে থাকা সংক্রমণে রাশ টানার পরামর্শ কিংবা আমজনতার কাছে বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন, তা কখনও খাটো করা যায় না।’
অন্যদিকে ফসির প্রতিক্রিয়া? মার্কিন কোভিড উপদেষ্টা অবশ্য বিতর্ক গায়ে মাখতে নারাজ। বরং, সংবাদসংস্থাগুলির ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে তিনি জানিয়েছেন, পুরো ইমেল প্রকাশ না করে খাপছাড়াভাবে কোনও মন্তব্য সামনে আনলে গোটা বক্তব্যের অর্থ পরিষ্কার হয় না। উল্টে সেটা আরও অস্পষ্ট হয়ে পড়ে।
যদিও উহান ল্যাব সংক্রান্ত সবচেয়ে বিতর্কিত মেল নিয়ে ঘুরিয়ে জবাব দিয়েছেন ফসি। তাঁর দাবি, নির্দিষ্টভাবে ইমেলের বয়ান তাঁর মাথায় নেই। তবে চিনের সরকার কোনও একটি ল্যাবে ভাইরাস তৈরি করে নিজেদের ও অন্যদের মেরে ফেলবে— এটা সত্যিই কষ্টকল্পনা!
কোনটা কল্পনা, কোনটাই বা সত্যি— তার খোলাসা এখনও বাকি। যবনিকা উঠেছে মাত্র। তার পতনের জন্য আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।