
চৈতালী চক্রবর্তী
“যত কিছু ভালোমন্দ, যত কিছু দ্বিধাদ্বন্দ্ব কিছু আর নাই/বলো শান্তি, বলো শান্তি, দেহসাথে সব ক্লান্তি/হয়ে যাক ছাই”
ভাল-মন্দ, দ্বিধা-দ্বন্দ্বের ঊর্ধ্বে উঠে সকলের অগোচরে চলে যাওয়ার শেষ সম্বলটুকু আঁকড়ে ধরতে পারে ক’জন? আড়ম্বরের ব্যাপ্তি নয়, মনের প্রশান্তিই সেখানে কাম্য। এখানেই শেষ…আর নেই, এই শেষটুকু শব্দহীন হোক, কোলাহলকে অতিক্রম করার বাসনা খুব কম জনেরই হয়। ‘মরবার পরেও আমার দেহটা যেন তেমনি নীরবে, একটু ভদ্রতার সঙ্গে, সামান্য বেশে, নির্লিপ্তির সঙ্গে পুড়ে যেতে পারে’, মৃত্যুর আগে এমনটাই বলে গিয়েছিলেন শম্ভু মিত্র। বাবার সেই ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়েছিলেন মেয়ে শাঁওলি। আড়াই দশক পরে সেই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি হল। ফুলভারে সজ্জিত হয়ে নয়, নীরবে সকলের অগোচরে নিশ্চিন্ত শান্তির দেশে পাড়ি দিলেন ‘নাথবতী অনাথবৎ’।
বাবার মতোই শেষ ইচ্ছাপত্রে নির্লিপ্ত, নিভৃত বিদায় চেয়েছেন মেয়ে। আড়ম্বরের আতিশয্য নয়, গান স্যালুটের রাজকীয়তা নয়, নিজের সাম্রাজ্য ছেড়ে অনন্তের পথে একা পাড়ি দিলেন শাঁওলি মিত্র। রেখে গেলেন তাঁর ইচ্ছাপত্র যার স্বর অনেকটাই আলাদা। ‘ঐ শরীরটিকে প্রদর্শন করায় আমার নিতান্ত সংকোচ। ফুলভারের কোনও প্রয়োজন নেই। সামান্য ভাবে সাধারণের অগোচরে যেন শেষকৃত্যটি সম্পন্ন করা হয়”….একা নিঃশব্দে নিজেকে খুঁড়ে যে পরিসর নির্মাণ করেছিলেন শাঁওলি মিত্র সেখানে তিনিই সাম্রাজ্ঞী। তাঁকে ব্যক্ত করার জন্য আর কোনও আড়ম্বরের দরকারও ছিল না।
জীবনের সেরা প্রাপ্তিটুকু সময়ের কোটর থেকে নিঙড়ে নিয়েছেন যাঁরা, তাঁরা মনে হয় এমন জৌলুষহীন পরিসমাপ্তিই চান। যেখানে কোলাহল থাকবে না, চিরশান্তি থাকবে। যখন এক অন্তঃসারশূন্য কোলাহলের মধ্যে ‘ভয়ে আমাদের কান বধির হয়ে আছে, অন্ধ হয়ে আছে চোখ’, তখন মনে পড়ে শঙ্খ ঘোষের সাবধানবাণী, ‘চুপ করো, শব্দহীন হও’। নীরবে চলে যেতে চেয়েছিলেন কবি শঙ্খ ঘোষও। ‘… শব্দহীন হও, শষ্পমূলে ঘিরে রাখো আদরের সম্পূর্ণ মর্মর…’ লিখেছিলেন কবি। তাঁর শেষযাত্রাটুকুও তাই শব্দহীন করারই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল প্রশাসন।
চিত্রপরিচালক মৃণাল সেনও চেয়েছিলেন অনাড়ম্বর শ্রদ্ধার্ঘ্য। ফুলের মালা নয়, রবীন্দ্রসদন বা নন্দনে জনতার ভিড় নয়, তোপধ্বনিও নয়। নিতান্ত সাদামাঠা ভাবেই অনন্তের পথে পাড়ি দেওয়ার ইচ্ছাপ্রকাশ করেছিলেন। তাঁর শেষ ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়েছিলেন আপনজনেরা।
এই যে নিঃশব্দে সময় থেকে সময়োত্তরে পাড়ি দেওয়া তার জন্য মহৎ মনোবৃত্তির দরকার, এমনটাই মত বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডক্টর কেদার রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তিনি বললেন, অন্তিম শয্যা কেমন হবে তা ব্যক্তিবিশেষের ওপরেই নির্ভর করে। কেউ আতিশয্য পছন্দ করেন, কেউ করেন না। কেউ চান চন্দন কাঠের চিতা, কেউ মনের প্রশান্তি। তবে সকলের অগোচরে নিঃশব্দে চলে যাওয়ার ইচ্ছা সকলে পোষণ করতে পারেন না। এর জন্য মনের ব্যপ্তি দরকার। অপ্রাপ্তি বা একাকীত্ব থেকে এমন ভাবনা আসে না। এর সঙ্গে কোনওরকম মানসিক ব্যধির সম্পর্কও নেই। জনপরিসর বা ভিড়ে নয়, নীরব শান্ত উপস্থিতিতেই অবিচ্ছেদ্য বাঁধনের গল্প বলে যান এঁরা।
কর্মের মধ্যে দিয়ে আনন্দ পেয়েছেন যাঁরা, খ্যাতির মধ্যে দিয়ে নয়, তাঁরাই এমন ভাবনার অধিকারী, এমনটাই মনে করছেন বিশিষ্ট ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট অনিন্দিতা মুখোপাধ্যায়। বলছেন, জীবনের প্রতি আঙ্গিক থেকে সবটুকু তৃপ্তি, প্রাপ্তি ছেঁকে নিয়েছেন যাঁরা, তাঁদের আর অনাবশ্যক আড়ম্বরের দরকার পড়ে না। কোনও রকম আতিশয্য তাঁদের পছন্দ নয়, সে জীবনযাপনে হোক বা শেষযাত্রায়। এই শব্দহীনতাতেই তাঁদের তৃপ্তি, মনের প্রশান্তি।
অনিন্দিতা বলছেন, ‘মন ও মানসিক স্থিতি কতটা গভীরে গেলে এমন ভাবনা আসে তা কয়েকজন স্বনামধন্য ব্যক্তিত্বই দেখিয়ে গিয়েছেন। নারায়ণ দেবনাথ বলেছিলেন, আমি চলে যাওয়ার পরে আমার সৃষ্ট চরিত্রগুলো যাতে নতুন করে তৈরি না হয়। কারণ এটা এখানেই শেষ..এই শেষটাই স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়েছেন তাঁরা।’ মৃত্যু তাঁদের কাছে সত্য, স্বাভাবিক। তাই মৃত্যুকে সাজিয়ে গুছিয়ে পরিবেশন করার বাসনা রাখেন না তাঁরা। জীবনের সবটুকু যদি পাওয়া হয়ে যায়, অপ্রাপ্তি বা দ্বন্দ্ব যদি মনে না থাকে, তাহলেই এমন ভাবনা আসে। স্বার্থহীনতা ও উদার মনোবৃত্তি থেকেই এমন ইচ্ছাপত্র লেখা যায়, যা শাঁওলি মিত্র করে দেখিয়েছেন। তাঁর মানস পুত্র ও কন্যাকে বলে গিয়েছেন ‘আসুরিক চিকিৎসা নয়, আমার বাড়িতে, আমার ঘরে, যতটুকু ভাল থাকা যায় ততটুকুই আমার সময়। এই শান্তিটুকুই শেষাবধি আমার কাম্য।’ এখানেই বোঝা যায়, জীবনকে ভালবেসে গিয়েছেন তাঁরা, মৃত্যুকেও তাই পরম স্নেহে আলিঙ্গন করেছেন।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ শর্মিলা সরকার বলছেন, অন্তরের শান্তিটুকুই তাঁদের কাম্য, বাহ্যিক আড়ম্বরকে গুরুত্ব দেন না তাঁরা। তাছাড়া কোভিড সংক্রমণ, আর্থিক ও সামাজিক নানা দিকের কথা ভেবেও এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন কিছু মানুষ। প্রচুর উদ্যোগ-আয়োজন খরচে তাঁদের প্রবৃত্তি নেই। বরং মৃত্যুর পরে তাঁদের সম্মানে জনসেবামূলক কোনও কাজ হোক, এমন ইচ্ছাও থাকে অনেকের।
ইচ্ছাপত্র কেমন হবে সে নিয়ে আমার আলাদা কোনও মতামত নেই, তবে এমন ভাবনা যিনি ভাবতে পারেন তাঁকে সম্মান জানাই’, এমনটাই বলেছেন প্রখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব দেবশঙ্কর হালদার। তাঁরও মত, মৃত্যুকে যিনি আড়ম্বরহীন করতে পারেন, তিনি অবশ্যই মহৎ মনের অধিকারী। সকলে এমন ভাবনা ভাবতে পারেন না।
‘তুমি যদি সত্যি আমার বন্ধু হও, তাহলে দেখো আমার যেন কলকাতার উন্মত্ত কোলাহলের মধ্যে, ‘জয় বিশ্বকবির জয়’, ‘জয় রবীন্দ্রনাথের জয়’, ‘বন্দেমাতরম’ – এই রকম জয়ধ্বনির মধ্যে সমাপ্তি না ঘটে। আমি যেতে চাই শান্তিনিকেতনের উদার মাঠের মধ্যে উন্মুক্ত আকাশের তলায়’…কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষ ইচ্ছা ছিল এমনই। কিন্তু তবুও অন্তিম যাত্রায় সাদা বেনারসির জোড়, কপালে চন্দনের ফোঁটা, গলায় গোড়ের মালা পরিয়ে ‘জয় বিশ্বকবির জয়’ ধ্বনিতে শেষ বিদায় জানানো হয় কবিগুরুকে।
প্রথা-ভাঙায় আমাদের বড় আপত্তি। কবিগুরু মৃত্যুকে আপন করেছিলেন একান্তে, বন্ধুর মতো। ‘যত বড়ো হও, তুমি তো মৃত্যুর চেয়ে বড়ো নও। আমি মৃত্যু-চেয়ে বড়ো এই শেষ কথা বলে যাব আমি চলে’, অহেতুক ভয় ভেঙে মৃত্যুকে শান্তির আশ্রয় বলে মনে করেন যাঁরা, তাঁদের কাছে মৃত্যু যেন সব পরিণতির এক অসীম আনন্দলোক, সেখানে নৈঃশব্দই পরম প্রাপ্তি।