
দ্য ওয়াল ব্যুরো: সোমবার প্রয়াত হয়েছেন কেরলের অবিসংবাদিত বামপন্থী নেত্রী কেআর গৌরী। লোকমুখে যিনি ‘গৌরী আম্মা’ নামেই পরিচিত ছিলেন। দীর্ঘ আট দশকের বর্ণময় রাজনৈতিক জীবন। পিছিয়ে পড়া এজহাবা জনজাতি থেকে উঠে এসেছিলেন গৌরী। শূন্য থেকে শুরু। তাই মাটির গন্ধ চিনতেন। বুঝতেন মাটিঘেঁষা মানুষের নাড়ির টান। দুর্বার জমি আন্দোলন থেকে ছাত্র আন্দোলন— সবেতেই সমান সাবলীল ছিলেন তিনি। জড়িয়ে পড়েছিলেন বিয়াল্লিশের ভারত ছাড়ো আন্দোলনেও।
দুর্দম জেদ যদি তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের একটা দিক হয়, তাহলে এর অন্য পিঠে রয়েছে সাবলীলতা, নমনীয়তা। যুগের কথা শুনতে পছন্দ করতেন গৌরী। বিলক্ষণ বুঝেছিলেন, সময় পাল্টাচ্ছে। এখন বিজ্ঞানের যুগ, প্রযুক্তির যুগ। তাই উঠতি তরুণদের হাতে কাজ তুলে দিতে রাজ্যে আইটি পার্ক তৈরি করা জরুরি। যেখানে এক ছাতার তলায় বসবে দেশ ও আন্তর্জাতিক একাধিক সংস্থা। কাজ পাবে সারা দেশের কলেজ-পেরোনো ছেলেমেয়েরা।
এই লক্ষ্যেই তিরুঅনন্তপুরমে আইটি পার্ক নির্মাণের দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নেন গৌরী আম্মা। তখন তিনি রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী। জানতেন, টেকনো পার্ক তৈরি হচ্ছে কলেজ পড়ুয়াদের জন্য। তাই এই প্রকল্পে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত৷ ভুল কিছু ভাবেননি গৌরী। রাজ্যের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে নিয়মিত বৈঠকে বসেন। একেবারে আনকোরা প্রস্তাব। শুধু রাজ্যে নয়, দেশে এমন উদ্যোগ প্রথম নেওয়া হচ্ছে। তাই রাজি করাতে একটু সময় লাগে।
সেই সময় এগিয়ে আসেন সরকারের মুখ্য উপদেষ্টা কেপিপি নাম্বিয়ার। তাঁর বাসভবনে চা-চক্রের আয়োজন করা হয়। হাজির হন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের সদস্য ও অন্যান্য প্রতিনিধিরা। তাঁদের সামনে নতুন কেরল বানানোর ব্লু-প্রিন্ট পেশ করেন খোদ নাম্বিয়ার। জানান, ৫০ একরের এই প্রজেক্ট কীভাবে রাজ্যের খোলনলচে বদলে ফেলতে পারে৷
তাঁর বক্তব্যের মূল সুর ছিল একটি। প্রযুক্তিকেন্দ্র যদি তৈরি করতে হয়, তাহলে উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির এগিয়ে আসাটা জরুরি। আইটি পার্ক আর কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় হাতে হাতে ধরে এগিয়ে চলে। বিদেশে এটাই দস্তুর। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। তখন থেকেই তথ্যপ্রযুক্তির পীঠস্থান এই দেশ। যেখানে সিলিকন ভ্যালির সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি। কিংবা টেক্সাস ইউনিভার্সিটি টেক্সাস ইনস্ট্রুমেন্টস-কে আর্থিক অনুদান দিয়ে সাহায্য করে।
দৃষ্টান্তের তালিকা যত বাড়ে, দৃষ্টি তত স্বচ্ছ নয়৷ বরফ গলে। সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একযোগে এগিয়ে আসে৷ প্রথমে ৫০ একর, তারপর ২০০ একর জমি তুলে নেয় সরকার৷ তৈরি হয় দেশের প্রথম অত্যাধুনিক আইটি পার্ক।
১৯৯১ সালের ৩১ মার্চ। পার্কের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের অনুষ্ঠানে সভাপতির আসনে বসেন গৌরী আম্মা। অনুষ্ঠানে যোগ দেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ইকে নায়ানার৷ টেকনোপার্কের প্রথম চেয়ারপার্সন নিযুক্ত হন নাম্বিয়ার। এরপর চার বছরের অপেক্ষা। অবশেষে ১৯৯৫ সালের নভেম্বর মাসে দ্বারোদঘাটন। ফিতে কেটে কেরলের নতুন যাত্রার সূচনা করেন প্রধানমন্ত্রী পিভি নরসিমা রাও।
এরপর দিন গড়িয়েছে। কালে কালে কলেবরে বেড়েছে আইটিপার্ক। ২০০ থেকে এখন ৭৫০ একর জমিতে দাঁড়িয়ে যা রাজ্যের বিনিয়োগে নয়া দিশা দেখাচ্ছে। এতকিছুর পরেও নেপথ্যের কারিগরকে কিন্তু কেরলের মানুষ ভোলেনি। গৌরী আম্মার প্রয়াণে তাই একটা যুগের অবসান হল। মেনে নিয়েছেন সকলে৷