
অঙ্গীরা চন্দ
রাস্তায় ট্রাফিক জ্যামে থমকে আছে শহর। ঘড়ির কাঁটা পেরিয়ে যাচ্ছে সেকেন্ড, মিনিট, ঘণ্টা। একটা গাড়িও নড়ছে না। পথে আটকে থেকে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছে চালক, আরোহীর। এমন ছবি প্রায় রোজই দেখা যায় বিশ্বের বেশিরভাগ শহর, মফঃস্বলে।
হঠাৎ এই দমবন্ধকর পরিবেশে যদি দেখেন মাথার উপর দিয়ে কী যেন একটা উড়ে গেল! পাখি নয়, তার চেয়েও বড় কিছু! আজকাল প্রায়ই চোখে পড়ে ড্রোন। নজরদারি ছাড়াও তা ব্যবহৃত হচ্ছে ছোটখাটো মালপত্র আনা নেওয়ার কাজে। হয়তো কোনও দিন চোখে পড়বে মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল একটি গাড়ি। হেলিকপ্টারে চেপে অল্প দূরত্ব উড়ে যাওয়া তো সেই কবেই জলভাত হয়ে গেছে। বিমানে সাগর পাড়ি দেওয়াও হাতের মুঠোয়। কিন্তু সে সবই বিপুল খরচ আর প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ। পথে চলার মত আকাশেও যদি উড়ে চলা যায় নিজের গাড়িটি নিয়ে, কেমন হয় তাহলে?
গল্প নয়, বাস্তবেও এমন হতে পারে। সে দিন আসতে আর বেশি দেরি নেই। উড়ন্ত গাড়ি বানিয়ে ফেলেছে মানুষ। প্লেন, হেলিকপ্টার নয়, বাড়ি থেকে বাজার কিংবা অফিস যাওয়ার জন্যে ব্যবহার করা যাবে সেই গাড়ি। এখন কিনলে খরচ পড়বে ৯২ হাজার ডলার, ভারতীয় মুদ্রায় ৬৮ লাখ টাকার কিছু বেশি। ট্যাঁকে কড়ি থাকলে ভবিষ্যতে উড়ন্ত সেই গাড়ি কিনে ফেলতেই পারেন আপনিও। উড়ে উড়েই চলে যেতে পারেন এখানে সেখানে।
রোড স্পেস কমে আসছে
কলকাতা শহরের ট্রাফিক জ্যামের যথেষ্ট কুখ্যাতি আছে। তবে জ্যামের নিরিখে মুম্বই থেকে শুরু করে বেঙ্গালুরু, মস্কো কিংবা লন্ডন, কম যায় না। সভ্যতা যতই এগিয়েছে, পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মানুষের ব্যস্ততা। দিনরাত সে কেবল ছুটছে। আর তাকে গন্তব্যে পৌঁছে দিচ্ছে চাকার কেরামতি।
শুধু ডাঙাতেই নয়, জল-আকাশ তোলপাড় করে আধুনিকতার সিঁড়িতে এগিয়ে যাচ্ছে মানুষের বানানো গাড়ি। সারা বিশ্বে এই মুহূর্তে দশ-বারো রকমের গাড়ি রয়েছে। তার রয়েছে ৪০০ থেকে ৫০০ রকম ভ্যারাইটি। এই সমস্ত গাড়ির সংখ্যা দিন দিন যত বাড়ছে, রাস্তাঘাটের অবস্থা ততই শোচনীয় হচ্ছে। শহরের রাস্তায় এত রকমের এত গাড়ির স্থান সংকুলানই হচ্ছে না। কমে আসছে রোড স্পেস।
রোড স্পেস কমে আসায় আগামীদিনে পৃথিবী যে বড়সড় সমস্যার সম্মুখীন হতে চলেছে সেকথা মানছেন বিজ্ঞানী এবং শহর পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞরা।
কেন কমছে রোড স্পেস?
অনেকেই মনে করছেন ব্যক্তিগত মালিকানাধীন গাড়ির সংখ্যা বেড়ে যাওয়াতেই দিন দিন রাস্তা উপচে পড়ছে। কলকাতা হোক কিংবা ক্যালিফোর্ণিয়া, গাড়ির ছড়াছড়ি সর্বত্র। এর ফলে গাড়ি পার্কিংয়ে যেমন সমস্যা হচ্ছে, তেমন বাড়ছে ট্রাফিক জ্যাম।
কম যাচ্ছে না যাত্রীবাহী গাড়িও। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির ওয়ার্ল্ড এনার্জি আউটলুক (ডব্লিউইও) রিপোর্টে বলা হয়েছে, যাত্রীবাহী গাড়ির মালিকানা সারা বিশ্বে এখন রয়েছে প্রতি ১০০০ জনে ২০টিরও কম। কিন্তু আগামীদিনে তা বাড়তে বাড়তে ২০৪০ সালের মধ্যে প্রতি ১০০০ জনে হয়ে যাবে ১৭৫টির বেশি। অর্থাৎ এই পুর্বাভাস অনুযায়ী আগামী ২১ বছরে রাস্তায় চলা যাত্রীবাহী গাড়ির চাপ বাড়বে প্রায় ৬ গুণ, যা নিঃসন্দেহে উদ্বেগের। যাত্রীবাহী গাড়ির এই ব্যাপকতা বেশি দেখা যাবে এশিয়া আর আফ্রিকার দেশগুলিতে, রিপোর্টে বলা হয়েছে তেমনটাই।
গাড়ি বেড়ে যাওয়ার বিপদ
রাস্তাঘাটে গাড়ির সংখ্যা হু হু করে বেড়ে যাওয়ায় আগামীদিনে সংকটময় পরিস্থিতি তৈরি হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এই গাড়ি ঠিকমতো ব্যবহার করতে না পারলে বাড়বে পথ দুর্ঘটনা। ইতিমধ্যে যার সংখ্যা কিছু কম নেই। একটি পরিসংখ্যান বলছে, পৃথিবীর মোট গাড়ির ৬০ শতাংশ রয়েছে গরিব আর মধ্যবিত্ত দেশগুলিতে। তবু ৯৩ শতাংশ দুর্ঘটনা হয় এসব দেশের রাস্তাতেই। প্রতিবছর পথদুর্ঘটনার জেরে পৃথিবী থেকে মুছে যায় ১৩ লক্ষ প্রাণ।
অত্যধিক গাড়ির ফলে বাড়ছে বায়ুদূষণও। পরিবেশের উপর এর ভয়ানক ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ছে। গাড়ির ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় বিষাক্ত হয়ে উঠছে পৃথিবীর জল-হাওয়া। পরিসংখ্যান বলছে শুধুমাত্র ২০২০ সালেই যাত্রীবাহী গাড়ি থেকে ৩০০ কোটি মেট্রিক টন কার্বন ডাই অক্সাইড মিশেছে বাতাসে। এই দূষণেও মৃত্যু কম হয়নি।
সমাধান কি আকাশে?
মাটির পৃথিবীতে চাকা ঘুরিয়ে গড়গড়িয়ে যেসব গাড়ি মানুষ আর তার মালপত্রকে বহন করছে, তার সমস্যা বিস্তর। সৃষ্টির আদি কালে মানুষ গাছের গুড়ি ঘুরিয়ে চাকা আবিষ্কারে বিপ্লব ঘটিয়েছিল। সেই চাকা এখন দাঁড়িয়েছে কাল হয়ে। মানুষ না পারছে ফেলতে, না পারছে গিলতে। এমন পরিস্থিতিতে বিকল্প সন্ধান অনিবার্য। সেই বিকল্প কি আকাশে লুকিয়ে আছে? রাস্তায় জায়গা না পেয়ে গাড়ি কি তবে আকাশে উড়বে?
৯২ হাজার ডলারের যে উড়ন্ত গাড়ি বাজারে এনেছে সুইডিশ কোম্পানি, তার নাম জেস্টন ওয়ান। সে গাড়ি এখনও পর্যন্ত খেলার কথা মাথায় রেখেই ডিজাইন করা হয়েছে। তবে নির্মাতাদের ভাবনায় রয়েছে সেই ভবিষ্যৎ, যেখানে মানুষ গাড়িতে চড়ে উড়ে উড়ে যাতায়াত করবে আকছার। রাস্তায় চলা গাড়ির বিকল্প হতে চলেছে এই উড়ন্ত গাড়ি, আশা করছেন জেস্টন ওয়ানের নির্মাতারা।
জেস্টন ওয়ানের খুঁটিনাটি
দ্য সুইডিশ এভটোল ফার্ম (The Swedish eVTOL firm) উড়ন্ত জেস্টন ওয়ান তৈরি করেছে। এই গাড়ির দাম ৯২ হাজার ডলার। বিশ্বের যে কোনও প্রান্তেই চাইলে মানুষ এই গাড়ি কিনতে পারছেন। ব্যাটারিচালিত এই গাড়ি এখনও সর্বসাধারণের ব্যবহারের জন্য চালু হয়নি। এতে যে ব্যাটারি রয়েছে তাতে ১৫ মিনিট এই গাড়ি আকাশে উড়তে পারবে। এই গাড়ি একজনের বসার উপযোগী, তা চালাতে পাইলট লাইসেন্সের প্রয়োজনও হবে না। গাড়ি ওড়ানো শিখতে লাগবে মাত্র ১৫ মিনিট, তেমনটাই দাবি নির্মাতাদের। একটি মাত্র জয়স্টিক আর একটি থ্রটল লিভার থাকে এই গাড়িতে, তা ঘুরিয়ে পেঁচিয়েই রপ্ত করতে হবে জেস্টন ওয়ান চালানোর কেরামতি। যাঁরা এই গাড়ি চালিয়েছেন, তাঁরা বলছেন গাড়িটি ওড়ানো খুবই সহজ আর কার্যকরী।
দিন দিন রাস্তাঘাটের যে পরিস্থিতি, তাতে উড়ন্ত গাড়িকে ভবিষ্যৎ ঠাউরে এগিয়ে যাওয়া মন্দ নয়, কী বলেন?