
দ্য ওয়াল ব্যুরো: নাগাড়ে বৃষ্টি চলছে। আরও কিছুদিন ভারী বর্ষণের পূর্বাভাস দিয়েছে আলিপুর হাওয়া অফিস। একেই করোনা সংক্রমণ তার ওপর লাগাতার বৃষ্টিতে জল জমে নাভিশ্বাস উঠছে মানুষজনের। সেই সঙ্গেই জ্বরজারি ও নানা জলবাহিত রোগ, পেটের রোগ, সংক্রমণজনিত অসুখের আশঙ্কও বাড়ছে। বর্ষার সময় আবার ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গি, চিকুনগুনিয়ার মতো মশা বাহিত রোগের উপদ্রবও বাড়ে। সেই সঙ্গে নানা ছত্রাক ও প্রাণী ঘটিত সংক্রমণের ঝুঁকিও থাকে। পানীয় জল বিশুদ্ধ না হলে তার থেকেও ছড়াতে পারে রোগ। সকলের বাড়িতেই যে ওয়াটার ফিল্টার বা জল শুদ্ধিকরণের আধুনিক মেশিন আছে তা নয়। তাই সার্বিক স্তরে সুরক্ষার জন্য সচেতনতা ও সতর্কতা সবচেয়ে আগে দরকার।
বর্ষার এই সময় কী কী বিষয়ে সাবধান থাকবেন, কী কী নিয়ম মানবেন তা জেনে রাখা ভাল। বাচ্চাদের এই সময় সর্দিকাশি, জ্বর লেগেই থাকে। তাই বাড়ির ছোটদেরও আগলে রাখতে হবে। বাড়ঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার দিকে নজর দিতে হবে। জানুন এই বর্ষায় সুরক্ষিত থাকতে কী কী টিপস দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা—
কী কী রোগ থেকে সতর্ক থাকবেন, কী নিয়ম মানবেন
বৃষ্টি, জমা জল, স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়াদের উপদ্রব বাড়ে। বৃষ্টির জলে ভিজে সর্দিকাশি হওয়ার সম্ভাবনাও বেশি। তাছাড়া এই কোভিডের সময় ঠান্ডা লাগালে বিপদ বাড়বে। তাই বৃষ্টিতে ভিজে গেলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভেজা জামা কাপড় ছেড়ে ফেলুন। বাড়ি ফিরে আগে উষ্ণ গরম জলে স্নান সেরে নিন। গ্রিন টি বা আদা-এলাচ-লবঙ্গ দিয়ে চা খেতে পারেন, অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল হিসেবে কাজ করে। ঠান্ডা লেগে সর্দিকাশি ধরে গেলে নুন-গরম জলে গার্গল করুন।
বর্ষায় সবচেয়ে বেশি যে রোগ দেখা যায় তা হল ম্যালেরিয়া। বর্ষার জমা জল থেকে মশাবাহিত রোগ ম্যালেরিয়া বাচ্চা থেকে বড় সকলেরই হতে পারে। এই ম্যালেরিয়ায় যদি ম্যালিগন্যান্ট হয়ে যায় তা থেকে মৃত্যুও হতে পারে।
বর্ষার সময় ডেঙ্গির উপদ্রব বাড়ে। জ্বর, গায়ে ব্যথা, র্যা শ, দুর্বলতা বড় সমস্যা ডেকে আনতে পারে। লক্ষণ দেখলেই সতর্ক হন, ডাক্তারের পরামর্শ নিন। বাড়ির আশপাশে কোথাও জল জমতে দেবেন না। প্রয়োজনে মশারি টাঙান ও মশার কামড় থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চলুন।
বর্ষায় জলবাহিত নানা রোগ থেকে সাবধান থাকতে হবে। বিশেষ করে টাইফয়েড, কলেরা, ডায়ারিয়া খুব ভোগায় এই সময়। বাইরের খোলা খাবার, জাঙ্ক ফুড না খাওয়াই ভাল। অপরিশোধিত জল থেকে ডায়ারিয়ার প্রকোপ বাড়ে। শিশুদের ডায়ারিয়া থেকে ডিহাইড্রেশন হয়ে বড় বিপদ হতে পারে।
পেটের সমস্যা দেখা দিলে জল ফুটিয়ে খাওয়ার চেষ্টা করুন। পানীয় জল ফুটিয়ে ঠান্ডা করে ঘরের তাপমাত্রায় এনে খান। বাচ্চাদেরও খাওয়ান। জলে একগাদা ওষুধ দিয়ে খাওয়া ঠিক নয়, কারণ এইসব ওষুধ থেকে নানারকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে।
খাবার ও জল থেকে বর্ষায় টাইফয়েড ও হেপাটাইটিস এ-র মতো রোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। হেপাটাইটিস এ-র ফলে লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জ্বর, বমি ও চুলকানির মতো উপসর্গও দেখা দিতে পারে। হেপাটাইটিসের সংক্রমণে রক্তের বিলিরুবিনের মাত্রে বেড়ে গিয়ে জন্ডিস দেখা দেয়। এই সময় বাইরের জল ভুলেও খাবেন না। বাইরের খাবার কম খান। বাড়িতে পুষ্টিকর খাবার খান। প্রচুর পরিমাণে জল খেতে হবে। ফল ও সবুজ সব্জি বেশি করে খান।
খাবার ও পানীয় জলে সতর্কতা
বর্ষার সময় বেশি জাঙ্ক ফুড বা ভাজাভুজি না খাওয়াই ভাল। আর্দ্র আবহাওয়ায় বিপাকের ক্ষমতা কমে যায়। এইসময় বেশি তেলমশলাদার খাবার খেলে বদহজম হতে পারে, তার থেকে পেটের রোগ দেখা দিতে পারে।
কাঁচা শাকসবজি খাবেন না, কারণ ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণের ঝুঁকি থাকবে। বাইরে থেকে ফল কিনে এনে খেলে ভাল করে ধুয়ে নিন। শাকসব্জি ভাল করে সিদ্ধ করে রান্না করুন।
বেশি করে জল খেতে বলছেন বিশেষজ্ঞরা। সুষম খাবার বা ব্যালান্সড ডায়েট মেনে চলুন। খাওয়ার আগে ভাল করে হাত ধুযে নেবেন। করোনা কালে ঘন ঘন হাত দুতে, স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে বলছেন ডাক্তাররা। বর্ষার সময় যে কোনও ভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ে। তাই সবদিক থেকেই সতর্ক থাকতে হবে।
ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার বেশি খান, এতে শরীরে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট ঢুকবে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়বে। ভিটামিন সি খেলে রোগজীবাণু সংক্রমণের ঝুঁকিও কমে। লেবু জাতীয় ফল, পেয়ারা বেশি করে খান। খাবারে ওমেগা-থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড থাকলে ভাল। রেড মিটের বদলে লিন মিট বেশি করে খান।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিয়মিত উষ্ণ গরম জল খেলে ফুসফুস ভাল থাকে। গলা ও ফুসফুসে জীবাণু বাসা বাঁধলেও সংক্রমণ ছড়াতে পারে না। নিয়মিত উষ্ণ গরম জল খাওয়ার অভ্যাস করুন। প্রতিদিন গ্রিন-টি খান। গ্রিন-টি তে শরীরের রোগ প্রতিরোধ বাড়ে, হজমের সমস্যা কমে, টক্সিন দূর হয়।
সাবধানে রাখুন ছোটদের
বাচ্চাদের সবসময় ফোটানো জল খাওয়ান। বাইরের জল, নরম পানীয় এই সময় একদম নয়।
বৃষ্টিতে ভিজে গেলে জামা-কাপড় দ্রুত ছাড়িয়ে দিন। ভেজা জামা বা মোজাতে বেশিক্ষণ থাকলে বাচ্চাদের শরীরে ছত্রাকের সংক্রমণ হতে পারে। তাই সতর্ক থাকতে হবে।
ডায়ারিয়া ও পেটের গোলমাল খুব ভোগায় বাচ্চাদের। শুধু খাবার বা পানীয় থেকেই নয়, অপুষ্টির কারণে ভিটামিন এ ও জিঙ্কের অভাবও অসুখ ডেকে আনে। কৃমি ও বদহজমেও ভোগে বাচ্চারা। তাই পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতে হবে। ভাজাভুজি বা বাইরের খাবার একেবারেই দেওয়া চলবে না। পেটে ব্যথা হলে আগে ঘরের স্যালাইন ওয়াটার দিন। তারপর দেরি না করেই ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
বাচ্চারা যে ঘরে থাকছে সেটা যেন পরিচ্ছন্ন থাকে সবসময়। বিছানার চাদর বদলে দিন নিয়মিত। বালিশ রোদে দিতে পারলে ভাল। বাচ্চা খাওয়ার আগে হাত ধুচ্ছে কিনা খেয়াল রাখুন। দিনে দুবার ব্রাশ করতেই হবে। মাস্ক ও স্যানিটাইজার সঙ্গে রাখুন মায়েরা।
পরিষ্কার রাখুন বাড়িঘর
বর্ষায় আর্দ্র পরিবেশ পোকামাকড় বাড়ে। তাই বাড়িতে এদের উৎপাত যাতে না ঘটে সেই চেষ্টা করতে হবে। খোলা জায়গায় জল জমতে দেবেন না, মশার বংশবৃদ্ধিতে তা সহায়ক। পারলে জানলায় জাল লাগান এবং মশা নিরোধক রাসায়নিক ব্যবহার করুন। এই সময়ে কাঠের আসবাবে ঘুণ ধরার প্রবণতা থাকে। ঘুণপোকা থেকে বাঁচতে আসবাবে বোরিক অ্যাসিড, টার্মিসাইড ইত্যাদি রাসায়নিক প্রয়োগ করতে পারেন।
ঘরের ছাদ, দেওয়াল ও কোণে ভিজে ভাব থাকলেই বুঝবেন কোনও ভাবে নিকাশী ব্যবস্থার সমস্যা দেখা দিয়েছে। অতিরিক্ত আর্দ্রতা এড়াতে ঘরে জলরোধ করতে পারে এমন প্রলেপ লাগানো প্রয়োজন।
ভেজা, স্যাঁতস্যাঁতে দেওয়ালে ছত্রাক জমতে পারে। তার থেকে সংক্রমিত হতে পারেন আপনিও। তাই সতর্ক থাকুন।
বাড়িতে টব থাকলে তাতে যেন জল না জমে থাকে খেয়াল রাখুন। বাথরুম পরিষ্কার রাখুন নিয়মিত।