Latest News

‘সিকল সেল অ্যানিমিয়া’ কী, কেন এত বাড়ছে? কেন্দ্রীয় বাজেটে কেন আলাদা গুরুত্ব এই অসুখকে?

চৈতালী চক্রবর্তী

সাধারণ অ্যানিমিয়া বা রক্তাল্পতার থেকে আলাদা। সিকল সেল অ্যানিমিয়া (Sickle Cell Disease) নিয়ে সচেতনতা খুবই কম। রোগের (Sickle cell anemia) প্রচার নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের আদিবাসী বিষয়ক মন্ত্রকের ওয়েবসাইটে সচেতনতার বার্তা থাকলেও সেই নিয়ে চর্চা খুবই কম হয়। রোগের নামই শোনেননি অনেকে। এ বছর কেন্দ্রীয় বাজেটে (Budget2023) অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন এই সিকল সেল অ্যানিমিয়া রোগ দূরীকরণে বিশেষ কর্মসূচি নেওয়ার কথা বলেছেন। ২০৪৭ সালের মধ্যে এই রোগ নির্মূল করার পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেছেন।

সিকল সেল অ্যানিমিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দেশে ক্রমে বাড়ছে। ২০১৮ সালে এই রোগে আক্রান্ত ছিলেন দেশের প্রায় ৫ শতাংশ নাগরিক। আর এখন তা বেড়ে ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। যে রাজ্যগুলিতে এই রোগের প্রকোপ বেশি, তার মধ্যে প্রথম সারিতেই আছে পশ্চিমবঙ্গ। মূলত আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যেই এই রোগ বেশি ছড়ায়। বাঁকুড়া, পশ্চিম বর্ধমান, বীরভূম, দক্ষিণ দিনাজপুর, দার্জিলিং, হাওড়া, হুগলি, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, মালদহ ও মুর্শিদাবাদে সিকল সেল অ্যানিমিয়ার প্রকোপ বেশি। এই রোগ নির্মূল করতে নানা পরিকল্পনা নিয়েছে কেন্দ্র। যার অন্যতম হলো, আক্রান্তের যথাযথ সংখ্যা জানতে সমীক্ষা, রোগ নির্ণয়ের জন্য পরীক্ষার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি। এবারের বাজেটে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, সিকল সেল অ্যানিমিয়ার মতো রোগ দূর করার জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। সচেতনতার প্রচারও করা হচ্ছে।

সিকল সেল অ্যানিমিয়া কী (Sickle cell anemia)?

সিকল সেল অ্যানিমিয়া বা সিকল সেল ডিজিজ (SCD) হল থ্যালাসেমিয়া ও হিমোফিলিয়ার মতো জিন বাহিত অসুখ। এই অসুখে রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে যায়, ফলে রক্তাল্পতা দেখা দেয়। তাই সিকল সেল ডিজিজকে সিকল সেল অ্যানিমিয়াও (Sickle cell anemia) বলা হয়।

What is Sickle Cell Disease? | CDC

আমাদের দেশে এই রোগ নিয়ে তেমন চর্চা নেই। রক্তাল্পতা নিয়ে যতটা সচেতনতার প্রচার করা হয়, সিকল সেল অ্যানিমিয়া সেখানে অনেকটাই অন্ধকারে। এই বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ (সিনিয়র পাবলিক হেলথ স্পেশালিস্ট) ডাক্তার সুবর্ণ গোস্বামী বলেছেন, এটি জিনঘটিত রোগ। বংশপরম্পরায় বাহিত হতে পারে। এক্ষেত্রে রক্তে হিমোগ্লোবিন কমে যায় একটি বিশেষ কারণের জন্য।

Sickle Cell Disease Symptoms, Types and Complications

ডাক্তারবাবু বলছেন, আমাদের লোহিত রক্তকণিকার (Red Blood Cell) আকার গোল হয়। কিন্তু সিকল সেল ডিজিজ হলে হিমোগ্লোবিনের আকার বিকৃত হয়। সেটি দেখতে অনেকটা ‘Sickle’ বা কাস্তের মতো দেখতে হয়। লোহিত রক্তকণিকার গঠন বিকৃত হয়ে যায় বলে এর মধ্যেকার হিমোগ্লোবিন (Hemoglobin) প্রোটিনের পরিমাণও কমে যায়। হিমোগ্লোবিনকে বলে মেটালোপ্রোটিন যা শরীরের কোষে কোষে অক্সিজেন বয়ে নিয়ে যায়। হিমোগ্লোবিনের জন্যে রক্ত যেমন ঘন হয়, তেমনি লালও হয়। হিমোগ্লোবিনের মূল কাজ শরীরে অক্সিজেন পরিবহণ করা। এটি মানুষের শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন পৌঁছে দেয়। রক্তে হিমোগ্লোবিন কমে গেলে যেসব সমস্যা হয় তার মাঝে প্রধাণতম বিষয়টি হচ্ছে অক্সিজেন স্বল্পতা।

সহজ করে বললে, আমরা যখন বাতাস থেকে নিশ্বাসের সঙ্গে অক্সিজেন গ্রহণ করি, তখন এটি প্রথমে আমাদের ফুসফুসে যায়। আর ফুসফুস থেকে এই অক্সিজেন শরীরের প্রতিটি টিস্যুতে, প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে পরিবহণের দায়িত্বটি পালন করে হিমোগ্লোবিন। শুধু তাই নয়, এই হিমোগ্লোবিনই অক্সিজেনের সাথে কার্বণ ডাই অক্সাইড বিনিময় করে। অর্থাৎ, ফুসফুস থেকে অক্সিজেন নিয়ে শরীরে পাঠায় আর শরীর থেকে বিষাক্ত কার্বণ ডাই অক্সাইড নিয়ে ফুসফুসে পাঠিয়ে দেয়। অতপর ফুসফুস সেটাকে আমাদের নিঃশ্বাসের মাধ্যমে বাইরে পাঠিয়ে দেয়। কাজেই হিমোগ্লোবিনের অভাব হলে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কমতে থাকে।

What is sickle cell anemia? The blood disorder India plans to eliminate by  2047 - India Today

সিকল সেল অ্যানিমিয়া হলে রক্তে হিমোগ্লোবিন নষ্ট হতে শুরু করে, লোহিত রক্ত কণিকা বিকৃত হয়ে ভেঙে যায় ফলে রক্তাল্পতা দেখা দেয়।

কাদের হয় এই অসুখ?

সিকল সেল অ্যানিমিয়া (Sickle cell anemia) জিন ঘটিত অসুখ। ডাক্তার সুবর্ণ গোস্বামী বলছেন, বংশানুক্রমিকভাবে বাহিত হতে পারে। সাধারণত ছয় থেকে সাত মাস বয়স পর্যন্ত শিশুদের মধ্যে এই রোগের উপসর্গ দেখা যায় না। ৮-৯ মাস বা ১ বছরের পর থেকে এই রোগের উপসর্গ দেখা দেয়। তবে চার মাসের শিশুদের মধ্যেও অনেক সময় এই রোগ দেখা দেয়। বাবা বা মায়ের মধ্যে যেকোনও একজনের শরীরে এই রোগ থাকলে তার সন্তানেরও রোগের আশঙ্কা থেকে যায়।

3 Children of a Poor Family suffer from Sickle Cell Disease - Odisha News  Insight

কী কী লক্ষণ দেখা দেয়? ডাক্তারবাবু বলছেন অনেক সময়েই রোগের লক্ষণ বোঝা যায় না। সাধারণ অ্যানিমিয়া ভেবে বসেন অনেকে।

শরীরে ক্লান্তিভাব থাকতে পারে।

বুকে-পেটে ও বিভিন্ন জয়েন্টে ব্যথা হতে পারে। এই ব্যথা কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।

শিশুদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।

বিরক্তিবোধ, মেজাজ খিটখিটে, খিদে কম, হাত-পা ফুলে যেতে পারে।

প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গিয়ে ঘন ঘন বিভিন্ন রোগে সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়।

কিডনির সমস্যা হয় ও ত্বকে হলদে ভাব দেখা দিতে পারে।

এই রোগ বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে – ১) হিমোগ্লোবিন এসএস ডিজিজ। ২) হিমোগ্লোবিন এসসি ডিজিজ। ৩) হিমোগ্লোবিন SB+ (বিটা) থ্যালাসেমিয়া। ৪) হিমোগ্লোবিন SB 0 (বিটা-জিরো) থ্যালাসেমিয়া। ৫) হিমোগ্লোবিন SD, হিমোগ্লোবিন SE, হিমোগ্লোবিন SO ৬) সিকল সেল ট্রেট ( Sickle Cell trait)। সাধারণত আদিবাসীদের মধ্যে এই রোগ বেশি দেখা যায়।

আদিবাসীদের মধ্যে কেন বেশি দেখা যায় এই অসুখ? প্রতিকার কী?

আইসিএমআর-নাইসেডের প্রাক্তন বিজ্ঞানী জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডাঃ দীপিকা সুর বলছেন, আমাদের দেশে একটা সময় সিকল সেল অ্যানিমিয়া নিয়ে জন সচেতনতা প্রায় ছিল না বললেই চলে। যেহেতু সবক্ষেত্রে এই রোগের

The Good Fight: Dr. Dipika Sur Battling Prejudices And Parasites | Feminism  in India

লক্ষণ আলাদা করে বোঝার উপায় নেই, তাই গ্রামে গ্রামে চিকিৎসাও তেমন হত না। রোগ ধরাই পড়ত না, ফলে বাবা-মায়ের থেকে অসুখ বাচ্চাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ত। এখন কেন্দ্রীয় সরকারের আদিবাসী বিষয়ক মন্ত্রক এই রোগ দূরীকরণ নিয়ে অনেক কাজ করছে।

ডাক্তার দীপিকা বলছেন, এই রোগে মৃত্যুর আশঙ্কা খুবই কম। তবে শুরু থেকেই চিকিৎসা জরুরি। তা হলে বিশেষ ক্ষতির আশঙ্কা থাকে না।

কীভাবে বিকৃত হয় হিমোগ্লোবিন? ডাক্তার সুবর্ণ গোস্বামী ও ডাক্তার দীপিকা বললেন, লোহিত রক্ত কোষগুলির এমন বিকৃতির কারণ হল হিমোগ্লোবিন-এস। এর একটি অংশ আঠালো হয়ে যাওয়ার কারণে পাশাপাশি অনেক হিমোগ্লোবিন জুড়ে গিয়ে দড়ির মত জট পাকিয়ে যায়। হিমোগ্লোবিন-এস একটি জিনগত ভাবে বিকৃত (মিউটেটেড-Mutated) হিমগ্লোবিন যার বিটা জিনের ষষ্ঠ অ্যামাইনো অ্যাসিডটি রাসায়নিক বদলের কারণে গ্লুটামিনের বদলে ভ্যালিনে পরিবর্তিত হয়। ভ্যালিন হাইড্রোফোবিক তাই আঠালো। ফলে লোহিক রক্তকণিকার আকার এমন বিকৃত হয়ে কাস্তের মতো হয়ে যায়। যেহেতু কাস্তের ফলা ধারালো তাই আশপাশে অন্য লোহিত কোষগুলিকে বিকৃত কোষটি কাটতে শুরু করে। এইভাবে লোহিত রক্তকণিকা নষ্ট হতে থাকে ও রক্তাল্পতা দেখা দেয়।

এই রোগ হওয়ার অন্যতম কারণ হল অপুষ্টি। দীর্ঘকালীন অপুষ্টি জিনগত ও শারীরিক নানা সমস্যার কারণ। তাছাড়া আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে একই রক্তের সম্পর্কে বিয়ে হওয়ার রীতি রয়েছে। এই কারণেও তাদের মধ্যে সিকল সেল অ্যানিমিয়ার প্রাদুর্ভাব খুব বেশি। ডাক্তারবাবুরা বলছেন, এই রোগ দু’ভাবে ছড়াতে পারে–১) ক্যারিয়ার বা বাহক এবং ২) রোগী নিজে। অনেক সময় দেখা যায় বাবা-মা রোগের বাহক কিন্তু তাদের সিকল সেল অ্যানিমিয়া নেই। অথচ সন্তান জন্মের পরে তার শরীরে রক্তের অসুখ ধরা পড়তে পারে। আবার এমনও হতে পারে যারা রোগের বাহক তাদের মৃদু অ্যানিমিয়া রয়েছে, অথচ সন্তানের মধ্যে পুরোদস্তর রোগের প্রকোপ দেখা যেতে পারে।

সিকল সেল অ্যানিমিয়া নানা রোগ ডেকে আনে— একটি অসুখ থেকে আরও নানা রোগের জন্ম হয়। প্লীহা শুকিয়ে যেতে পারে, বুকে ব্যথা হতে পারে, স্ট্রোক, অ্যাকিউট চেস্ট সিনড্রোম, অন্ধত্ব, গলব্লাডারে স্টোন, পায়ের আলসার, থ্রম্বোসিস বা রক্ত জমাট বাঁধা, গর্ভকালীন নানা জটিলতা হতে পারে।

সিকল সেল অ্যানিমিয়া রোগ নির্মূল করতে হলে আগে এর সঠিক পরীক্ষা নিরীক্ষা করা দরকার। হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রোপোরেসিস (Hemoglobin electrophoresis), এইচপিএলসি (HPLC) এবং আইইএফ (IEF) পরীক্ষা করলে রোগ ধরা পড়ে।  পাশাপাশি রুটিন রক্ত পরীক্ষার উপর ভিত্তি করে ডায়াগনোসিস করা হয়।

এই রোগ একেবারে সারিয়ে তোলার কোনও চিকিৎসা পদ্ধতি এখনও জানা নেই। তবে রোগের প্রকোপ কম রাখতে নানারকম থেরাপি আছে। যেমন–স্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্টেশন করা যেতে পারে, অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনে রোগের ট্রিটমেন্ট হতে পারে, ব্লাড ট্রান্সফিউশনের মাধ্যমে রক্তে লোহিত রক্তকণিকার মাত্রা বাড়িয়ে এই রোগের চিকিৎসা করা হয়। তাছাড়া কিছু ওষুধপত্র আছে। সেই সঙ্গেই সঠিক ডায়েট জরুরি। এই রোগের সবরকম থেরাপিই খুব জটিল ও ব্যায়সাপেক্ষ। তাই প্রত্যন্ত এলাকার মানুষজনের জন্য এই রোগের নির্ণয় ও চিকিৎসার জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেওয়ার চেষ্টাই করছে কেন্দ্রীয় সরকার।

You might also like