Latest News

ধূসর অতীত, ঝাপসা বর্তমান, ভুলে যাওয়ার রোগ চিনবেন কীভাবে?

দ্য ওয়াল ব্যুরো: হাশিখুশি, মজাদার মানুষ হিসেবে বিশ্বাসবাবুকে চিনতেন পাড়ার লোকজন। আপদে বিপদে তাঁকে একবার ডাক দিলেই ছুটে যেতেন। ইদানীং মানুষটার মধ্যে অদ্ভুত এক পরিবর্তন দেখা গেছে। কিছুই মনে রাখতে পারেন না (Dementia)। বাড়ির লোক মজা করে বলতেন, ভুলো মন হয়েছে। কিন্তু ধীরে ধীরে দেখা গেল, চেনা মুখগুলোকেই আর চিনে উঠতে পারছেন না তিনি। নিজের স্ত্রী, সন্তানদেরও অপরিচিত ভাবলেন একদিন, ভুলে গেলেন নিজের নামটাও। তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী ঝকঝকে যুবক রাহুল (নাম পরিবর্তিত)। সারাদিন ল্যাপটপে বুঁদ, মাল্টি-টাস্কিং করছেন। এখন তিনিও এই ভুলো-রোগের শিকার। লোকজনের নাম, ধাম ভুলে যাচ্ছেন শুধু নয়, নিজের পরিচয়টাও এখন তাঁর কাছে ধোঁয়াশার মতো।

এই ভুলো-রোগ কিন্তু হাসিমজার ব্যাপার নয়। ভীষণ ভয়ঙ্কর মস্তিষ্ক ও স্নায়ুর এক অসুখ, যা নিজের অস্তিত্বকেও ভুলিয়ে দিতে পারে যে কোনও মুহূর্তে। মস্তিষ্কের অলিগলিতে চেনা পরিসরগুলোও হারিয়ে যেতে বসে। আপনজনরাও তখন অচেনা, অজানা হয়ে ওঠে রোগীর কাছে। একটা সময় স্মৃতি মুছে যায় পুরোপুরি। আমাদের চারপাশে এমন মানুষ হামেশাই দেখা যায়। মগজ থেকে স্মৃতিদের এই হারিয়ে যাওয়ার অসুখই হল ডিমেনশিয়া। সোজা কথায় স্মৃতিনাশ। সম্প্রতি আমাদের রাজ্যের এক রাজনীতিবিদের মধ্যেও এমন অসুখ দেখা গেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বের প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষ স্মৃতিনাশ বা ডিমেনশিয়া নিয়েই বেঁচে আছেন। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে সাড়ে সাত কোটির বেশি ডিমেনশিয়ার শিকার হবেন, অন্তত এমনটাই জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)।

6 Things that Could Cause Dementia to Worsen

স্মৃতির-বাক্সে জট, ধূসর অতীত, ঝাপসা বর্তমান

মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, এই স্মৃতি হল টেপ রেকর্ডারের মতো, বারে বারে চালিয়ে আমরা তা মনে রাখার চেষ্টা করি। ভাল স্মৃতি হলে তাকে বারে বারে মস্তিষ্ক থেকে রোমন্থন করে নিয়ে আসি, আর খারাপ স্মৃতি না চাইতেও অবচেতনে থেকে যায়। ভবিষ্যতে কোনও ভয়ঙ্কর ট্রমা হয়ে ফিরে আসে। কিন্তু স্মৃতিরা যদি একেবারেই হারিয়ে যেতে বসে, তাহলে বুঝতে হবে রোগ ধরেছে মগজে। ডাক্তাররা বলবেন ডিমেনশিয়া। টুকটাক ভুলে যাওয়া নয়, ডিমেনশিয়ার রোগীরা নিজেদের নাম-পরিচয় অবধি ভুলতে বসেন। এই অসুখটাই বড় ভয়ঙ্কর।

13 Types of Dementia, Symptoms, Causes, Stages & Treatment

ডিমেনশিয়া হল মস্তিষ্কের এমন এক জটিল রোগ যেখানে স্মৃতির বাক্সটাই পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। মস্তিষ্কে সব কাজের জন্যই আলাদা আলাদা কুঠুরি থাকে। স্মৃতি ধরে রাখার বাক্সও থাকে—একে বলে হিপ্পোক্যাম্পাস। এই এলাকা স্মৃতি তৈরি করে, স্মৃতি সঞ্চয় করে, আবেগ-ভাবনা নিয়ন্ত্রণ করে। মানুষের মস্তিষ্কের মধ্যে দু’টি হিপ্পোক্যাম্পাস থাকে। স্মৃতিকে বেঁধে রাখার কাজটি করে মাথার এই অংশটিই। আর ‘এনটোরিনাল কর্টেক্স’ নামে আর একটি অংশ হিপ্পোক্যাম্পাসের সঙ্গে যুক্ত থাকে। এই এলাকা স্মৃতির জাল তৈরি করে। মস্তিষ্কের স্নায়ুর মাধ্যমে একটা নেটওয়ার্ক তৈরি হয়। এই নেটওয়ার্ক মারফৎ সিগন্যাল বা সঙ্কেত বাহিত হয়ে আসে। মস্তিষ্ক ঠিক করে কোন ঘটনাকে সঞ্চয় করে রাখা হবে আর কোন ঘটনা মস্তিষ্কে ক্ষণস্থায়ী হবে।

Signs, Symptoms, Risk factors & Treatment of Dementia | Mindgram

স্মৃতির এই বাক্স যখন নানা কারণে অকেজো হয়ে যায়, তখন মানুষ আর কিছু মনে রাখতে পারে না। শুরুটা হয় রোজকার জীবনের কাজের মধ্যে দিয়ে, শেষে নিজের নাম, বাড়ির ঠিকানা, আত্মীয়-পরিজন সকলকেই ভুলে যেতে শুরু করে রোগী। আগে মনে করা হত ডিমেনশিয়া বুঝি বার্ধক্যেরই রোগ। কিন্তু আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান বলছে, স্মৃতিনাশ যে কোনও বয়সেই হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপ, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হলে বা অন্য কোনও জটিল রোগ থাকলে প্রথমে ডিমেনশিয়া ও তার থেকে পরবর্তীকালে অ্যালঝাইমার্সের আশঙ্কা অনেক বেড়ে যায়। বুদ্ধিমত্তা বা ‘কগনিটিভ ফাংশন’-এর উপর প্রভাব পড়ে, যা ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।

Dementia Action Week – 17th-23rd May 2021 | Tollers Solicitors

ডিজিটাল যুগে সবাই মাল্টি-টাস্কার, ফালাফালা হচ্ছে মগজ

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণাই বলছে, মস্তিষ্কের বিশ্রাম নেই মানুষের। মগজ ডুবে আছে ইন্টারনেটে, তার ওপরে স্ট্রেস-চিন্তা-অবসাদ-একাকীত্ব-উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আরও হাজারটা কারণ রয়েছে। হিসেব কষে দেখা গেছে, ২০৩০ সালের মধ্যে ৭ কোটি ৮০ লক্ষ মানুষ ও ২০৫০ সালের মধ্যে প্রায় ১৩ কোটি মানুষ ডিমেনশিয়ার শিকার হবেন।

কেন এই ভুলে যাওয়ার রোগ? ২০০৯ সাল থেকে স্ট্যানফোর্ড মেমরি ল্যাবে মস্তিষ্কের গতি-প্রকৃতি নিয়ে নানারকম গবেষণা চলছে। কীভাবে মস্তিষ্কের গতি বাড়বে, আইকিউ বাড়বে কীভাবে, কোন মানুষের স্মৃতির পর্দা কতটা চওড়া, কার মস্তিষ্কে অনুভূতিগুলো ঠিকমতো ডানা মেলতে পারে না, ইত্যাদি নানা রকম খোঁজ করতে গিয়েই মিডিয়া মাল্টিটাস্কিংয়ের ভয়ঙ্কর দিকটা নজরে পড়ে বিজ্ঞানী, মনোবিদদের। দফায় দফায় পরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা বুঝিয়ে দিতে চান যে চোখ, কান, মস্তিষ্কেরও আরাম দরকার। নানা কাজের বোঝা চাপালে তারা বিগড়ে যাবেই।

Do women really multitask better? Science has contradictory evidence -  Times of India

ডিজিটাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের নানা দিকে একসঙ্গে কাজ করাকে বলে মিডিয়া মাল্টিটাস্কিং। ধরা যাক, কেউ টিভি দেখছে, একই সঙ্গে মেসেজ করছে, আবার সেই সঙ্গেই ফোনে গান শুনছে। মাঝে মাঝে মোবাইলে ইমেল বা ফেসবুক অথবা অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ক্রল করে যাচ্ছে। দিবারাত্র যদি সবকিছু একই সঙ্গে চলতে থাকে, তাহলে মস্তিষ্কের কার্যকলাপে ব্যাঘাত ঘটে। বুদ্ধির প্রখরতা কমে যায়, স্মৃতিনাশের শঙ্কা বাড়ে।

 

মস্তিষ্কের বিশ্রাম দরকার

মানুষের মস্তিষ্ক একটা সময় একটাই কাজ করতে পারে। ফোকাস থাকে একদিকেই। তাকে যদি নানারকম কাজের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে সমস্যা শুরু হয়। স্নায়ুর মধ্যে দিয়ে বার্তা পৌঁছয় মস্তিষ্কে। এখন সেকেন্ডের তফাতে যদি কাজের ধরন বদলে যায়, চোখ আর কানকে ভিন্ন ভিন্ন কাজে ব্যস্ত রাখা হয়, তাহলে কোন বার্তা আগে মস্তিষ্কে পৌঁছবে সেটা ঠিক করতে পারে না স্নায়ুতন্ত্র বা নার্ভাস সিস্টেম। যার ফলে সব মিলেমিশে জট পাকিয়ে যায়। মস্তিষ্কের স্বাভাবিক ক্ষমতা লোপ পায়। অপ্রয়োজনীয় তথ্যের মধ্যে থেকে মস্তিষ্ক সঠিক তথ্য বাছাই করে ছেঁকে নিতে পারে না। যে কারণেই মস্তিষ্কের নানা রোগ ধরা পড়তে থাকে।

Kids & Digital Dementia

কী কী করতে হবে

মস্তিষ্ককে বিশ্রাম দিতে হবে। তার জন্য বিভিন্ন কাজের মধ্যে সময়ের ফারাক রাখা উচিত।

ভাবনাচিন্তা করার জন্যও মস্তিষ্ককে সময় দিতে হবে। তার জন্য সময়ান্তরে মেডিটেশন খুব দরকার।

নিয়মিত যোগব্যায়াম, ডিপ ব্রিদিংয়ে স্ট্রেস রিলিফ হয়। মস্তিষ্কে চাপ পড়ে না।

ব্রেনকে চাঙ্গা করতে প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট কার্ডিওভ্যাসকুলার এক্সারসাইজ যেমন, হাঁটা, জগিং, সাঁতার বা সাইক্লিং খুবই জরুরি৷

রাতে ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা টানা ঘুম দরকার।

পড়ুন দ্য ওয়ালের সাহিত্য পত্রিকাসুখপাঠ

You might also like