
শোভন চক্রবর্তী
এমনটা তো ছিল না! এমন বিনয়ী, এমন অনুতাপ, মুখমণ্ডল থেকে এমন অপরাধবোধ বিচ্ছুরিত হওয়া, এমন মাথা নিচু করা তো তাঁদের ধাতে নেই। তাহলে হলটা কী নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহের!
১৯ নভেম্বর নরেন্দ্র মোদী। তারপর ৬ ডিসেম্বর অমিত শাহ। কৃষি আইন নিয়ে জাতির উদ্দেশে ভাষণে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ক্ষমা চাইলেন। তারপর সংসদে দাঁড়িয়ে নাগাল্যান্ডের গণহত্যা নিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দুঃখপ্রকাশ করলেন। অনেক কথার মধ্যেও ওটাই ছিল মূল। দুঃখপ্রকাশ। নতজানু হয়ে দুঃখপ্রকাশ। অন্নদাতাদের উদ্দেশে ক্ষমাও চেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী।
মোদী-শাহের বিজেপি সরকার চালাচ্ছে সাড়ে সাত বছর। অসংখ্য ঘটনায় দেশ তোলপাড় হয়েছে। কিন্তু মোদী-শাহ হয় চুপ থেকেছেন নইলে এমন ভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, যার মোদ্দা কথা, যা হয়েছে বেশ হয়েছে। চুপ করে বসে থাকুন।
বিজেপি ত্রিপুরা প্রদেশের প্রভারী (পর্যবেক্ষক) বিনোদ সোনকর গত নভেম্বরে দায়িত্ব পেয়েছিলেন। তাঁর প্রথম ত্রিপুরা সফরে আগরতলার স্টেট গেস্ট হাউসে সাংবাদিকদের সঙ্গে নৈশভোজে মিলিত হয়েছিলেন। সেইসময়ে ত্রিপুরার এক প্রথম শ্রেণির বাংলা দৈনিকের নিউজ এডিটর অনুযোগের সুরেই তাঁকে বলেছিলেন, দলের রাজ্য নেতাদের সবসময় ফোনে পাওয়া যায় না। খবরের ক্ষেত্রে, প্রতিক্রিয়া পাওয়ার ক্ষেত্রে যা একটু অসুবিধার। এ ব্যাপারে ঘরোয়া আড্ডায় মহারাষ্ট্রের এই সাংসদ বলেছিলেন, বিজেপি একটা স্টাইলেই গোটা দেশে চলে। মহারাষ্ট্রেও যা, ত্রিপুরাতেও তাই।
কেমন সেই স্টাইল? তিনি বলেছিলেন, অনেক সময়ে নেতারা ইচ্ছে করেই ফোন ধরেন না। প্রতিক্রিয়া দেন না। কিন্তু তাতে বিজেপির প্রতিক্রিয়া আটকে থাকে না। দলের আইটি সেল যে প্রোপাগন্ডা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়াচ্ছে, সেটাকেই দলের মনোভাব হিসেবে ধরে নিতে হবে। সোনকর আসলে বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, তাঁদের আইটি সেল এতটাই সংগঠিত।
বছর চারেক আগে রাজস্থানে মালদহের এক শ্রমিককে লাভ-জিহাদের জিগির তুলে পিটিয়ে মারা হয়েছিল। স্থানীয় এক বজরং দলের নেতা শম্ভুলাল ছিলেন সেই ঘটনায় অভিযুক্ত। মালদহের সেই সংখ্যালঘুকে পিটিয়ে মারা নিয়ে যখন বাংলার অনেকেই সরব, হিন্দুত্ববাদীদের সমালোচনা হচ্ছিল তখন গেরুয়া আইটি সেল প্রোপাগন্ডা নামিয়েছিল, যা হয়েছে বেশ হয়েছে। হিন্দুত্বকে রক্ষার প্রশ্নে এই উগ্রতাই প্রয়োজন। সোনকরের কথা ও অনুযায়ী ধরে নিতে হয় সেটাই দলের ভাবনা।
সাম্প্রতিক সময়ে সিএএ নিয়ে যখন দিল্লির শাহিনবাগ বা কলকাতার পার্কসার্কাসে নাগরিক জমায়েত হচ্ছে, জাতীয় পতাকা উড়িয়ে প্রতিবাদ হচ্ছে, কোলে শিশু নিয়ে শীতের কুয়াশা ভেঙে মা পড়ে থাকছেন সারারাত—তখন গেরুয়া শিবির প্রায় হামলে পড়ে বলেছিল, এ হল জাতীয় পতাকা হাতে দেশদ্রোহীদের জমায়েত। কলকাতায় তেমন কিছু না হলেও পূর্ব দিল্লির শাহিনবাগকে ঘিরে দাঙ্গার ক্ষত এখনও টাটকা। মোদী বলেছিলেন, পোশাক দেখলেই বোঝা যায় ওরা কারা! অমিত শাহ হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, আন্দোলন করতে হলে, ইসলামাবাদের চলে যান। এমন একটা ভাব, তাঁরাই ঠিক। তাঁরাই দেশ। তাঁদের বিরোধিতা মানেই দেশদ্রোহিতা। ভারতমাতার অপমান। কিছুতেই তাঁরা এসব সইবেন না।
কত ছবিই তো বেরিয়েছে সংবাদমাধ্যমে। বৃদ্ধার পিঠে পুলিশের বুট, ধর্ষিতা তরুণীর লাশ সরকারি পৃষ্ঠকোষতায় ছিনতাই করে পরিবারের অনুমতি না নিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া, কালো পিচের রাস্তায় চাপ চাপ রক্ত, অন্তঃস্বত্তা মায়ের লকডাউনের ভয়ে হেঁটে যাওয়া, রেললাইনে পড়ে থাকা রুটির গোছার পাশে শ্রমিকের দেহের টুকরো, কৃষক আন্দোলনের শুরুর দিকে পুলিশি হামলায় অন্নদাতাদের ক্ষতবিক্ষত হওয়া—এসব কোনও কিছুই মোদীর হৃদয়ে দাগ কাটতে পারেনি। আইটি সেল সোচ্চারে বলে গিয়েছে ৫৬ ইঞ্চি। ভেসে এসেছে হিম্মতের ঢক্কানিনাদ। আর অমিত শাহ বরাবরই কম কথার মানুষ। সচরাচর এই সমস্ত ঘটনায় তাঁর প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায় না।
কিন্তু এই দেশ চালানোর দুই মাথাই মাথা ঝোঁকালেন। ক্ষমা চাইলেন। এবং তা ঘটল পক্ষকালের ব্যবধানে। একটির ক্ষেত্রে কৃষকদের লাগাতার আন্দোলন। অন্যটি সেনাবাহিনীর গুলিতে মুড়িমুড়কির মতো মানুষের মরে যাওয়া। তাঁরা আবার উত্তর-পূর্বের। তাঁরা আবার জনজাতি গোষ্ঠীর।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে কেন এমন করলেন তাঁরা?
বিজেপির কেউ কেউ বলছেন, এটাই হল গণতান্ত্রিক বোধ। এই যে বিরোধীরা স্বৈরাচারের কথা বলেন তা যে আসলে মিথ্যে তা প্রমাণ হয়ে গিয়েছে। আবার অনেকে বলছেন, দুষ্টু লোকের ছলের অভাব হয় না। পাঁচ রাজ্যের ভোট আসছে। সেটাই হয়তো মোদীর ক্ষমা চাওয়া ও দুঃখপ্রকাশের মূল কারণ। কারণ, যে পাঁচ রাজ্যে বাইশের গোড়ায় ভোট হবে সেগুলির মধ্যে পাঞ্জাব বাদে সব রাজ্যেই বিজেপির সরকার। সেখানে যেমন রাজ্য সরকারগুলিকে নিয়ে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা রয়েছে তেমন কেন্দ্র নিয়েও রয়েছে। কারণ, মোদীই মুখ। তিনিই বিশ্বগুরু। তা ছাড়া কৃষকদের ভোটও উল্টে গেলে অনেক হিসেব পাল্টে যেতে পারে। তাই সংসদে আলোচনা ছাড়া পাশ হওয়া আইনও আলোচনা ছাড়াই প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হতে হয়েছে মোদী সরকারকে।
নাগাল্যান্ডের ঘটনাও বিজেপি বা অমিত শাহের পক্ষে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। কারণ উত্তর-পূর্বে জনজাতি সেন্টিমেন্টে আঘাত লাগলে অন্য অশান্তি দানা বাঁধতে পারে। সেসব আশঙ্কা থেকেই হয়তো নতজানু হয়েছেন শাহ। সংসদে হাটের মাঝে দুঃখপ্রকাশ করেছেন। অধিবেশন এড়িয়ে গিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। কারণ উত্তর-পূর্ব ক্ষেপে উঠলে কী হয় তা মোদী জানেন। এনআরসি বিরোধী আন্দোলনের সময়ে অসমে যা ঘটনা ঘটেছিল তাতে মোদীকেই ওই রাজ্যের সফর বাতিল করতে হয়েছিল। সর্বানন্দ সোনেয়াল, হিমন্ত বিশ্বশর্মাদের মুরোদে কুলোয়নি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার।
সপ্তম বামফ্রন্ট ক্ষমতায় এসেছিল ২৩৫ আসন নিয়ে। ব্রিগেডের মাঠ থেকে বুদ্ধদেব ভট্টচার্যের দম্ভের অনুরণনে শোনা গিয়েছিল, আমরা ২৩৫, ওরা ৩০। নন্দীগ্রাম পুনর্দখল হয়েছিল ২০০৭ সালের ৯-১০ জানুয়ারির মাঝের রাতে। যাকে সিপিএম বলেছিল অপারেশন সূর্যোদয়, যাকে তৃণমূল বলেছিল রক্তস্নাত সূর্যোদয় আর যাকে সেই সময়ের রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধী বলেছিলেন হাড় হিম করা সন্ত্রাস। পরের দিন রাইটার্সের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বুদ্ধবাবুর উক্তি ছিল, “দে হ্যাভ বিন পেড ব্যাক বাই দেয়ার ওউন কয়েন।” তারপর বুদ্ধবাবুকেও বারবার দুঃখপ্রকাশ করতে হয়েছিল বিভিন্ন ঘটনায়। যে কারণে তাঁকে অনেক বিদ্রুপ করে সরি চিফ মিনিস্টারও বলতেন। উনিশের ভোটে একাই ৩০০ পার করা বিজেপির দম্ভও কম নয়। সংখ্যার তাকতে সব বদলে দেওয়ার মেজাজ।
এসবের পরেও শেষ পর্যন্ত যা দেখা গেল তা হল, মোদী-শাহকেও দুঃখপ্রকাশ করতে হয়। বামপন্থীরা এসব ক্ষেত্রে রুশ বিপ্লবের প্রাণপুরুষ ভিআই লেনিনকে উদ্ধৃত করে বলেন, ‘এক পা আগে, দুই পা পিছে।’ হতে পারে বিজেপির সিলেবাসেও গুরু গোলওয়ালকর বা ‘বীর’ সাভারকারের এমন কোনও তত্ত্ব থাকতে পারে। যাকে হয়তো কৌশল হিসেবে ব্যবহার করছেন মোদী-শাহরা। কিন্তু যে ধারণা নির্মিত হয়েছিল, তা যেন ভেঙে গিয়েছে এই ১৫ দিনে।