
সোহিনী চক্রবর্ত্তী
সুন্দর বলতে আম জনতা ঠিক কী বোঝে বলুন তো? লম্বা-ছিপছিপে গড়ন, টানাটানা চোখ, টিকালো নাক, একঢাল সুন্দর ঘন চুল, সাজানো দাঁতের পাটিতে হাজার ওয়াটের ঝলকানো হাসি, আর হ্যাঁ অবশ্যই ফর্সা গায়ের রঙ। সাধারণ মানুষের অধিকাংশের কাছে এই তো হল প্রকৃত সুন্দরের সংজ্ঞা। প্রকাশ্যে হাজার বুলি আওড়ালেও এমনটাই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন অনেকে।
তবে চেনা ছকের বাইরেও যে কেউ সুন্দর হতে পারে তেমনটাও ভাবেন অনেকে। তাঁদের মধেই একজন কলকাতার ফ্যাশন ডিজাইনার সুজয় দাশগুপ্ত। তাঁর কথায়, “সৌন্দর্য তো মানুষের মনে। বাহ্যিক সৌন্দর্য দিয়ে কী হবে!” র্যাম্পে হাঁটবে মানেই তাঁকে যে ডানাকাটা পরী হতে হবে এমনটা বিশ্বাস করেন না সুজয়। বরাবরই তিনি চান বাঁধাধরা র্যাম্প ওয়াকের কনসেপ্ট থেকে বেরোতে। আর তাই চলতি মরশুমে দেরাদুন ফ্যাশন উইকে মনীষা পৈলানকেই নিজের শোয়ের শো-স্টপার হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন সুজয়।
এ রাজ্যে মনীষাকে চেনেন না এমন লোকের সংখ্যা নেহাতই হাতে গোনা। সমাজের চোখে ওর পরিচয় ‘অ্যাসিড অ্যাটাক সারভাইভার’। ঘটনা অনেকদিনের পুরনো হলেও প্রতিদিন এই সমাজের একাংশ মনীষাকে মনে করিয়ে দেয় তাঁর জীবনের সবচেয়ে খারাপ দিনগুলোকে। তবে যাঁরা দীর্ঘদিন মনীষাকে চেনেন, তাঁরা জানেন যে ও ঠিক কী। তবে সেই চেনা মানুষগুলোও এ বার এক অন্য রূপে দেখেছেন ওঁকে। আর পাঁচটা তাবড় প্রফেশনাল মডেলের মতোই র্যাম্প মাতিয়েছেন মনীষা। সাবলীল হাঁটাচলা, দৃপ্ত ভঙ্গি, বুদ্ধিদ্বীপ্ত কথাবার্তা বারবার বুঝিয়ে দিচ্ছিল শুধু অ্যাসিডের জ্বালাপোড়ার সঙ্গে লড়াই করা নয়, এ মেয়ে চাইলে সব পারে, সব।
কিন্তু প্রথমে সুজয়ের এই ফ্যাশন শো-তে যেতে রাজিই হননি মনীষা। অপমানিত হওয়ার ভয়ে। ছোট থেকে সাজগোজ করতে ভালোবাসা মেয়েটারও কোথাও যেন মনে হয়েছিল র্যাম্প ওয়াক মানেই শুধু তাবড় সুন্দরীদের রমরমা। মনীষার কথায়, “এর আগে বহু অনুষ্ঠানে গিয়েছি। কোথাও ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যাক স্টেজে বসিয়ে রেখেছে। কোথাও বা জলটুকুও অফার করেনি। আর পরিশ্রমের পারিশ্রমিক, সে তো ছেড়েই দিন।”
তা হলে কি সম্মান পাননি মনীষা!
নিশ্চয় পেয়েছি। ভালো অভিজ্ঞতা রয়েছে প্রচুর। অনেক মানুষ আমার পাশে দাঁড়িয়েছেন বলেই আমি লড়াইটা লড়তে পেরেছি। কিন্তু বেশ কিছু ঘটনা আমায় বারবার আমার অতীতটাই মনে করিয়ে দিয়েছে। যেমন র্যাম্পে হাঁটতে হয়েছে কোনও সুন্দরী মডেলের হাত ধরে। একটা সময়ের পর খুব মেকি লাগত এ সব। কেন আমি একা নই বলতে পারেন? আরে বাবা অ্যাসিডে পুড়ে চোখ-মুখের যাই হোক না কেন, আমি মানুষটা তো জীবিত। তাহলে আমি কোন শাড়ি পরব, কী ভাবে পরব, কী ভাবে চলব-হাঁটব, স্টেজে কী বলব সব কেন তোতা পাখির বুলির মতো আমায় শিখিয়ে দেবে বলুন তো? একবার জিজ্ঞেস পর্যন্ত করে না যে চড়া আলোয় আমার শারীরিক ভাবে কোনও অসুবিধে হবে কি না। আমার উপর ভরসা না করা গেলে আমায় ডাকারই বা কী দরকার…
বেশ কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতার পর নিজেকে এ ধরনের ইভেন্ট থেকে একেবারেই সরিয়ে নিয়েছিলেন মনীষা। সেই সময়েই সুজয়ের সঙ্গে আলাপ হয় তাঁর। প্রথমেই সুজয়কে সবটা খুলে বলেন তিনি। মনীষা বলেন, “সুজয়দাকে সবটুকু খুলে বলার পর মানুষটা আমায় বলেছিলেন তুমি তোমার মতো করে শো-তে আসবে। উনি বুঝেছিলেন আমার ভাবনাগুলো। এটাই আমার পাওনা। তারপরেই রাজি হই।” সুজয়ও বলেন, “ওঁকে বোঝাতে পেরেছিলাম যে আমি আর পাঁচজনের থেকে একটু হলেও আলাদা ভাবি।” সৌন্দর্যের সংজ্ঞা মনীষার মনেও ছিল একদম অন্যরকম।
এরপরেই শুরু জার্নি। প্রথমবার বিমান যাত্রা। উত্তেজনা-আনন্দ-বিশ্বাস সব নিয়েই মনীষা পৌঁছেছিলেন দেরাদুনে। বাকিটা শুনতে সিনেমার মতো হলেও এক্কেবারে বাস্তবের ঘটনা। একদম পেশাদার মডেলের মতোই র্যাম্পে দাপিয়ে এসেছেন এই তরুণী। আত্মবিশ্বাসে কমতি ছিল না এতটুকুও। ক্যামেরার ফ্ল্যাশের ঝলকানি, আর হাজার আলোর ভিড়েও নজর কেড়েছিল শুধুই মনীষার হাসি।
শো-স্টপার হিসেবে মনীষাকে পেয়ে দারুণ খুশি সুজয়ও। বলছেন, “অন্যরকম কিছু করার চেষ্টা করি সবসময়। গত বছর এই ফ্যাশন শো-তে আমার থিম ছিলেন সোনাগাছির মহিলারা। ওঁদের জীবনের নানা রঙ নিয়েই পোশাক বানানোর চেষ্টা করেছিলাম। একটাই দুঃখ ছিল ওখানকার কোনও মহিলাকে শো-স্টপার করতে পারিনি। তবে এ বার আমার নতুন ভাবনায় মনীষা আমার অনুরোধ ফেরায়নি। আমরা এখন দারুণ ভালো বন্ধুও হয়ে গিয়েছি।”
সুজয়ের সঙ্গে কাজ করে আনন্দ পেয়েছেন মনীষাও। তাঁর কথায়, “সুজয়দা আমায় একটুও ইনস্ট্রাকশন দেননি। এমনকি কোন শাড়ি কী ভাবে পড়ব, কেমন করে র্যাম্পে হাঁটব, কী বলব সব কিছু আমিই ভেবেছি। শুধু গোটা টিম আমার পাশে থেকেছে। ছোট থেকেই সাজতে খুব ভালোবাসতাম। এখনও সাজি। তবে সেদিন র্যাম্পের ব্যাকগ্রাউন্ডে যখন মর্দানি ছবির গানটা বাজছিল, তখন একটা আলাদা ফিল হচ্ছিল। এতদিন ঘরের আয়নায় দেখে বেখেয়ালে যা যা করতাম, সে দিন র্যাম্পেও ঠিক তাই-ই করেছি। ধন্যবাদ সকলকে যাঁরা আমায় শুভেচ্ছা জানিয়েছেন, পাশে থেকেছেন। সে দিন র্যাম্প ওয়াকের সময় প্রতি মুহূর্তে ফিল করেছিলাম, ওটা আমার নিজের রাজত্ব। আর আমিই ওখানকার রানি।”