Latest News

মোদী জমানায় লকডাউনে রেল লাইনেই স্রেফ মারা গিয়েছেন ৯ হাজার শ্রমিক, বলছে রেলই

দ্য ওয়াল ব্যুরো: ২০২০ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও যা হয়নি, তাই করে দেখাল কোভিড (Covid)। দেড়শ বছরের ইতিহাসে প্রথমবার থমকে গেল ভারতীয় রেল। ঘোষণা হল লকডাউন (lockdown)। আর সেই ঘোষণা হতেই দেখা গেল, দেশের বিভিন্ন বড় শহর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে বেরিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন পরিযায়ী শ্রমিকের দল (Migrant Workers)। সম্বল যৎসামান্য। সঙ্গে মধ্য ভারতের বিরাট দাবদাহ! যেন ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ ছবিতে অবধূতের সেই গান, ‘মা গো, বলো কবে শীতল হব… কতদূর… আর কতদূর… বলো মা…’।

তাই হয়েছিল। কোথাও ট্রেনের লাইনে, কোথাও প্ল্যাটফর্মেই শীতল হয়ে গিয়েছিল নামহীন, পরিচয়হীন, সম্বলহীন শরীরগুলো। কেউ তাদের কথা শোনেনি, কেউ বিচার করেনি। কেউ সেই হিসেব দেয়নি। মুজফফরপুর স্টেশনে সেই মর্মান্তিক দৃশ্য, প্ল্যাটফর্মে বৈশাখের তীব্র গরমে নিথর পড়ে রয়েছেন মা, তার একরত্তি শিশুটি বারবার চাদর টেনে মায়ের ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা করছে। মনে পড়ে যায় রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘দুর্ভাগিনী’ কবিতার সেই লাইন, ‘সব সান্ত্বনার শেষে সব পথ একেবারে/ মিলেছে শূন্যের অন্ধকারে…’। আমাদের ক্ষমতা ছিল না কিছু প্রতিবাদের, শুধু নিষ্পলক চোখে দেখেছি টিভির ফুটেজ।

এবার মধ্যপ্রদেশের এক আরটিআই কর্মী চন্দ্রশেখর গৌড়ের করা এক তথ্যের অধিকার আইনের প্রশ্নের উত্তরে ভারতীয় রেলের বোর্ড জানিয়েছে, ২০২০ সালের সেই লকডাউনের মাঝেও প্রায় ৮৭০০ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন রেললাইনে। রেল বোর্ডের লিখিত উত্তর, ‘২০২০ সালের জানুয়ারি ও ডিসেম্বরের মধ্যে, সংশ্লিষ্ট রাজ্য পুলিশের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আমাদের হিসেব, রেলের লাইনে ৮০৫ জন নানাভাবে আহত হয়েছেন এবং ৮৭৩৩ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন।’

রেলের আধিকারিকরা আলাদা করে জানিয়েছেন, এই মৃতদের বেশিরভাগই পরিযায়ী শ্রমিক। তাঁরা লকডাউনে ট্রেন বন্ধ হয়ে যাওয়ার খবরে দিশেহারা হয়ে রেললাইন ধরে হাঁটা শুরু করেছিলেন। তাঁদের ধারণা ছিল, রেললাইন সড়কপথের চেয়ে অল্প দূরত্বে বেশি দূর যায়। তাছাড়া রাস্তা ধরে গেলে রাস্তা হারানোর সম্ভাবনাও বেশি। তাই রেলপথ ধরেই নাগাড়ে এক অনির্দিষ্ট যাত্রায় বেরিয়েছিলেন তাঁরা। ভেবেছিলেন, বাড়ি ফিরবেন। কিন্তু আর বাড়ি ফেরা হয়নি।

রেলের আইনে রেললাইনের ওপর দিয়ে হাঁটা রীতিমতো দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু কে খবর রাখে সেই আইনের? রেলের মুখপাত্র বলেছেন, এটা একটা সামাজিক সমস্যা। দেশে প্রায় ৭০,০০০ কিলোমিটার রেলপথ রয়েছে। রোজ ১৭,০০০ ট্রেন নিয়মিত ছুটে যায় সেই ট্র্যাকে। সবসময় প্রচার চালানো হয়, ট্র্যাকে হাঁটাচলা করবেন না। রেলের তরফে পারাপারের জন্য ফুটব্রিজ থেকে লেভেল ক্রসিং সবই বানানো হয়। ‘আমাদের কাছে যাত্রীদের নিরাপত্তা, মানুষের প্রাণের দাম সবচেয়ে বেশি। কিন্তু এখনও প্রচারে পুরোপুরি কাজ হয়নি।’ মুখপাত্রের ব্যাখ্যা, ‘এগুলো কিন্তু সড়কপথে পারাপারের সময়েও হয়। বরং অনেক বেশি হয়।’

কিন্তু কোভিডের সময় এমন অনেক ঘটনা ছিল, যাকে পুরোপুরি সড়কপথের সঙ্গে তুলনা করা যায় না। যেমন মহারাষ্ট্রের ঔরঙ্গাবাদের সেই মর্মান্তিক বিপর্যয়। ৮ মে, একদল পরিযায়ী শ্রমিক হাঁটা লাগিয়েছিলেন ভুসবল স্টেশনের দিকে। ভেবেছিলেন, স্টেশনে পৌঁছে কোনও ‘শ্রমিক স্পেশ্যাল’ ট্রেন ধরবেন। লাগাতার রোদে-গরমে সড়কপথে হেঁটে ক্লান্ত শ্রমিকরা ভেবেছিলেন, এবার রেলপথ ধরে হাঁটা যাক, তাতে যদি দূরত্ব কম হয়। রাত হতেই পরিশ্রমে ক্লান্ত শরীরগুলো এলিয়ে দিয়েছিলেন লাইনের ওপরেই। সরকার তো বলেছে ট্রেন বন্ধ। আর ভয় কী?

ট্রেন বন্ধ ছিল। তবে সেগুলো যাত্রীদের ট্রেন। চালু ছিল মালগাড়ি, স্টাফ স্পেশ্যাল। অত আর ভাবেননি গরিব শ্রমিকরা। গা এলিয়ে দিয়েছিলেন লাইনেই। সেই অঘোর ঘুম আর ভাঙল না। ভোররাতে এক মালগাড়ি এসে পিষে দিয়ে গেল ষোলোটা শরীর। মালগাড়ির চালকরাও আলো-আঁধারিতে ঠাহর করেননি, লাইনে হতভাগ্য শ্রমিকের দল শুয়ে আছে। যখন করলেন, দেরি হয়ে গিয়েছে খুব। চূড়ান্ত তৎপরতার সঙ্গে এমারজেন্সি ব্রেক মেরেছিলেন। কিন্তু কাজ হয়নি।

২০১৬ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে এরকম মর্মান্তিক ঘটনা কেড়ে নিয়েছে প্রায় ৫৬,২৭১ জনকে। কিন্তু রেল এগুলোকে ‘রেল দুর্ঘটনা’-র মধ্যে রাখে না। রেলের দৃষ্টিতে এগুলো ‘ট্রেসপাসিং’, অর্থাৎ বেআইনিভাবে রেললাইনে ঢুকে পড়া। এইরকম ঘটনার তদন্ত করে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের পুলিশ, ক্ষতিপূরণও দেয় রাজ্য সরকার।

দশ বছরে আড়াই লক্ষেরও বেশি প্রাণ কেড়েছে রেল-দুর্ঘটনা, বলছে সরকারি পরিসংখ্যান

You might also like