Latest News

দুর্গার বিজ্ঞান-পিতাকে আর কতকাল ভুলে থাকব আমরা?

ডা: গৌতম খাস্তগীর

 

ডা. গৌতম খাস্তগীর

দিনটা বেশ মনে আছে। আমি ডাক্তারি পড়া শুরু করেছিলাম ১৯৭৮ সালে। সে বছরই ২৫ জুলাই ব্রিটেনে জন্ম নিল পৃথিবীর প্রথম টেস্টটিউব বেবি (Test Tube Baby)। চিকিৎসা বিজ্ঞানের যুগান্তকারী এক অধ্যায়। পত্র-পত্রিকায় তুমুল আলোচনা। সারা বিশ্বে বহু নিঃসন্তান দম্পতিদের মুখে হাসি ফুটল।

কী আশ্চর্য সেই একই বছর মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধান, ৩ অক্টোবর পৃথিবীর দ্বিতীয় এবং ভারত তথা এশিয়ার প্রথম টেস্টটিউব বেবি জন্ম নিল আমারই শহর কলকাতায়। কানুপ্রিয়া আগরওয়াল, ডাক নাম দুর্গা, যাঁর বায়োলজিক্যাল ফাদার হলেন প্রভাত আগরওয়াল এবং বিজ্ঞান-পিতা এই রাজ্যেরই এক স্বনামধন্য চিকিৎসক ডা: সুভাষ মুখোপাধ্যায়। চিকিৎসা গবেষণায় কলকাতার তখন খুব একটা নামডাক নেই। স্রেফ অধ্যবসায়ের জোরে অসাধ্য সাধন করলেন শহরের এক গবেষক চিকিৎসক।

স্বভাবতই মেডিক্যাল কলেজে পড়তে ঢোকার সময় থেকেই টেস্টটিউব বেবির বিষয়টি নিয়ে ভীষণ আগ্রহ ছিল আমার। আমি স্থির করেছিলাম এই বিষয়ে ভবিষ্যতে কাজ করব। কিন্তু যখন এ নিয়ে এগবো বলে পরিকল্পনা করছি, ততদিনে দুর্গার বিজ্ঞান-পিতা প্রয়াত। তখন তাই এখানে এই ব্যাপারে কারও কাছ থেকে পরামর্শ নেওয়া বা সাহায্য পাওয়া আমার ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল। এই প্রশিক্ষণের জন্য আমি বিদেশে পাড়ি দিলাম।

প্রথম টেস্টটিউব বেবির জনক রবার্ট এডওয়ার্ডস নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। কিন্তু দ্বিতীয় টেস্টটিউব বেবির বিজ্ঞান-পিতার কাজকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের আন্তর্জাতিক মহল প্রাপ্য স্বীকৃতি ও সম্মান দিলেও দেশে এবং এমনকী নিজের রাজ্যেও তিনি উপেক্ষিতই বলা চলে। তিনি প্রয়াত হওয়ার অনেক পরে চিকিৎসা ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত নানা প্রতিষ্ঠান তাঁর কাজকে গ্রহণ এবং অনুসরণ করলেও রাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান দেয়নি। পরিবর্তে চিকিৎসমহলের একাংশের অসম্মান, কাজ নিয়ে সংশয় ইত্যাদির মুখে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন এই সাধক চিকিৎসক। সেটা গত শতকের আটের দশকের গোড়াকার ঘটনা।

চার দশক আগের সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন দিনগুলির কথা মনে করিয়ে দেওয়া এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। ডা সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে কী ধরনের মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে তখন যেতে হয়েছে তা অনেকেরই জানা। তা নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। কথা সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরী লিখেছেন অভিমন্যু নামের উপন্যাস এবং তপন সিনহার মত বিখ্যাত পরিচালক সিনেমা করেছেন।

আমরা, শহরের বেশ কিছু মানুষ এখন বরং চাইছি, সরকারের কাছ থেকে তাঁর কাজের মরণোত্তর স্বীকৃতি। কারণ, যে কাজ একটা সময় তাঁর শহর, তাঁর রাজ্য বুঝতে চায়নি বা বুঝতে পারেনি, গোটা দূনিয়া কিন্তু টেস্টটিউব বেবির ক্ষেত্রে সেই পদ্ধতিই অনুসরণ করছে। খুবই আনন্দের কথা যে, আমাদের এই উদ্যোগের পাশে আছে বিশ্বের প্রথম ও দ্বিতীয় টেস্টটিউব বেবি যথাক্রমে লুইজ ব্রাউন এবং কানুপ্রিয়া ওরফে দুর্গা। অর্থাৎ, স্রষ্ঠার স্বীকৃতি আদায়ের দাবিতে সরব তাঁর সৃষ্টি। আছেন কানুপ্রিয়ার মা-বাবাও।

India's first test tube baby Durga celebrates her 40th birthday in Pune -  YouTube
ভারতের প্রথম টেস্ট টিউব বেবি–কানুপ্রিয়া আগরওয়াল

ডা: মুখোপাধ্যায়ের কাজকে গোটা বিশ্ব কী চোখে দেখে সে বিষয়ে নিজের অভিজ্ঞতা দু-চার কথা বলি। আমি বিদেশে গিয়ে দেখলাম টেস্টটিউব বেবি নিয়ে ডা সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অবদানের কথা অনেকেই জানেন। বিদেশে আমার শিক্ষক, সহপাঠী, গবেষকরা অনেকেই তাঁর ব্যাপারে আমাকে প্রশ্ন করতেন।

এখানে বলে রাখা ভাল যে ইংল্যান্ডে টেস্টটিউব বেবি নিয়ে যে গবেষণাটা হয় তা অনেকটাই আলাদা ছিল। প্রত্যেক মাসে মহিলাদের শরীরে যে ডিম্বানু তৈরি হয়, তা পেট থেকে ল্যাপারোস্কোপি করে বের করে ফার্টিলাইজ বা শুক্রাণু দিয়ে নিষিক্ত করে প্রতিস্থাপণ করা হত। অর্থাৎ একটি ভ্রূণ দিয়েই কাজ চলত। সুভাষ মুখোপাধ্যায় ইঞ্জেকশন দিয়ে অনেকগুলো ডিম তৈরি করেন। প্রতিটা ডিমকে শুক্রাণু দিয়ে নিষিক্ত করে অনেকগুলো ভ্রূণ তৈরি করেন। সেইসব ভ্রূণগুলো সঙ্গে সঙ্গে প্রতিস্থাপণ না করে, সংরক্ষণ করে রেখে পরে সেগুলি গর্ভে প্রতিস্থাপণের কাজ করতেন। সব কাজই করা হত প্রসবের পথ দিয়ে। পদ্ধতিটি অনেক সহজ, কম কষ্টকর এবং বেশী সফল।

আমি যে সময়টা ইংল্যান্ডে ছিলাম তখন গবেষণা করে দেখা গেল, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের এই পদ্ধতিটাই সবচেয়ে ভাল ও সুরক্ষিত। কারণ জরায়ুতে ইঞ্জেকশন দেওয়ার পর পরই প্রতিস্থাপণ করলে সেটা ভাল ফল দেয় না। জরায়ুর বিশ্রাম দরকার হয়। দু’তিন মাস পরে করলে সেটা ভাল হয়।

বিদেশে এই সংক্রান্ত কনফারেন্সে আমাকে অনেকের কাছে এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে যে, রবার্ট এডওয়ার্ড নোবেল পুরস্কার পেয়ে গেলেন অথচ সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে কেন কোনও পুরস্কার বা সম্মান দেওয়া হয়নি।। নানা জায়গায় তাঁর কাজ স্বীকৃতি পেল। সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে জাপান, আমেরিকা ও জার্মানিতে ডাকা হয়েছিল তাঁর কাজ সেখানকার চিকিৎসকমহলের কাছে তুলে ধরার জন্য। কিন্তু ওঁকে তখনকার রাজ্য সরকার যাওয়ার অনুমতি দেয়নি। কেন ওঁকে যেতে দেওয়া হয়নি, তা বিশ্বের অনেকেই জানতে চেয়েছেন।

আমি দেশে ফিরে তাঁর পদ্ধতি নিয়েই কাজ শুরু করি। সে সময় আমার সঙ্গে সুনীত মুখোপাধ্যায়ের আলাপ হয়। তিনি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সহকারী ও বন্ধু। আমার সঙ্গে দেশের প্রথম টেস্টটিউব বেবি কানুপ্রিয়া ওরফে দুর্গার বাবা-মায়ের দেখা হয়। কানুপ্রিয়ার জন্মদিনে ডা: মুখোপাধ্যায়কে স্মরণ করা হত। আমরা কিছু মানুষ মিলে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিতে নানা জায়গায় কনফারেন্স করা শুরু করলাম। এইভাবে কলকাতায় তাঁকে নিয়ে নতুন করে কৌতুহল তৈরী হল। আমি লক্ষ্য করলাম, কলকাতার অনেকেই এত বড় গবেষক ও চিকিৎসকের নামই জানেন না। তখন আমরা একটা ফাউন্ডেশন তৈরি করি। সেখানে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাজগুলো বাঁচিয়ে রাখাতে জুনিয়র ডাক্তারদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ শুরু হয়। বিভিন্ন কনফারেন্সের আয়োজিত হয়।

ডা সুভাষ মুখার্জি সরকারি স্বীকৃতি না পেলে আগামী প্রজন্মের সাধারন মানুষ তাঁর কাজ ও গবেষণার ব্যাপারে কিছুই জানতে পারবে না। আমাদের শহরেই চিকিৎসা বিজ্ঞানে এত বড় বিপ্লব ঘটিয়েছেন যে চিকিৎসক তাঁর অবদান আড়ালেই থেকে যাবে। তাই আমরা চেষ্টা করছি তাঁর গবেষণার পথ ধরেই আরও বেশি মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে। তাঁর কাজকে জনপ্রিয় করতে।

আজ শনিবার আমরা শহরের বিশিষ্ট কিছু মানুষকে আমন্ত্রণ জানিয়েছি। ডা: সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জীবন ও কাজ নিয়ে তাঁদের অভিজ্ঞতা এবং ভাবনার কথা তাঁরা বলবেন। সেখানেই প্রয়াত চিকিৎসা বিজ্ঞানীকে মরণোত্তর সম্মান দেওয়ার দাবি সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হবে। বার্থ-ইন্সপায়ার ফাউন্ডেশন এই মত বিনিময় সভার আয়োজক। দাবি আদায় কর্মসূচির এটা আর একটা পর্বের সূচনা বলা চলে।

আগামী মাসের ১ থেকে ৩ তারিখ শহরে অনুষ্ঠিত হবে অ্যাকাদেমি অফ ক্লিনিক্যাল এমব্রিওলজিস্টের আন্তর্জাতিক সম্মেলন। সেখানে লুইজ এবং কানুপ্রিয়ার উপস্থিতিতে এই দাবিপত্র চূড়ান্ত করার পর তা পৌঁছে দেওয়া হবে রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে। আমরা চাই, তাঁকে ভারতরত্ন বা পদ্মভূষণের মতো কোনও রাষ্ট্রীয় সম্মান দিয়ে মরণোত্তর স্বীকৃতি জ্ঞাপন করা হোক। রাজ্য সরকারও বঙ্গরত্ন-র মতো কোনও সম্মান দিয়ে তাঁকে মরণোত্তর স্বীকৃতি দিতেই পারে। রাজ্যে এখন বেশ কয়েকটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল তৈরি হচ্ছে। আমরা চাই একটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ডা: সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের নামে রাখা হোক। এছাড়া শহরের কোনও রাস্তার নামকরণ করা হোক এই প্রয়াত চিকিৎসক-বিজ্ঞানীর নামে। ৩ অক্টোবর কানুপ্রিয়া অর্থাৎ দুর্গার জন্মদিন। ওই দিনটি জাতীয় আইভিএফ (ইন-ভিট্রো-ফার্টিলাইজেশন) ডে হিসাবে ঘোষণার দাবি জানানো হবে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে।

বিগত কয়েকমাস এক ভিন্ন পরিসরে আমরা বাংলা ও বাঙালির স্বার্থ রক্ষায় নানা কথা শুনেছি, শুনছি। বাংলার বিশিষ্টজনেদের তাঁদের অবদানের জন্য স্মরণ-শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের মতো প্রশংসনীয় উদ্যোগ লক্ষ্য করছি। আমাদের মনে হয়, পৃথিবীর দ্বিতীয় এবং ভারত তথা এশিয়ার প্রথম নলজাতকের স্রষ্টা তথা বিজ্ঞান-পিতাকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান না দিলে সে উদ্যোগ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ডা: সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে মরণোত্তর রাষ্ট্রীয় সম্মানজ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানে বাংলার এক বিরল, অবিস্মরণীয় কৃতিত্ব দাবি করার আনুষ্ঠানিক আয়োজন সম্পূর্ণ হতে পারে।

এখন প্রশ্ন, অতীতের ভুল শুধরে নিতে আর কতকাল অপেক্ষা করব আমরা? চার দশক কেটে গেল, সেই সাধক চিকিৎসা বিজ্ঞানী অভিমান করে অসময়ে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। ভুল শুধরে নিতে চল্লিশ বছর কম সময় নয়।

লেখক শহরের বিশিষ্ট স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ এবং চেয়ারপার্সন, বার্থ ইন্সপায়ার ফাউন্ডেশন।

পড়ুন দ্য ওয়ালের সাহিত্য পত্রিকা সুখপাঠ

You might also like