
সৌরদীপ চট্টোপাধ্যায়
‘পরিবর্তনের’ জোর হাওয়া কর্নাটকে (Karnataka)। সারা দেশে বিজেপির অশ্বমেধের ঘোড়া তুঙ্গভদ্রার তীরে থামিয়ে একেবারে নায়কের আসনে কংগ্রেস। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর নিরন্তর প্রচার, ‘দ্য কেরল স্টোরি’ নিয়ে লাগামছাড়া বিতর্ক, বিজেপির সর্বোচ্চ নেতৃবৃন্দের বিস্তর ঢক্কানিনাদ তুলে রাজনৈতিক সমাবেশ—সবই কার্যত বিফলে (Karnataka Election Results)। বিজেপির চেয়ে প্রায় দ্বিগুণের বেশি আসনে এগিয়ে থেকে নজিরবিহীন সাফল্যের পথে কংগ্রেস। গোটা দক্ষিণ ভারতই কার্যত চলে গেল বিজেপির হাতের বাইরে।
কলকাতাতেও তার ছায়া এসে পড়েছে। ইতিমধ্যেই রাজ্যে সোল্লাসে বিজয় মিছিল নামিয়েছেন প্রদেশ কংগ্রেসের কর্মীরা। তবে শুধু কি এইটুকু? বাংলার (Bengal) সঙ্গে কর্নাটকের টান তো আজকের কথা নয়! দীর্ঘদিন ধরেই বাংলার সংস্কৃতিতে, সাহিত্যে, ইতিহাসে রয়েছে কর্নাটক, তার কন্নড় সংস্কৃতি। আজ তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লবের পরে তো বলা হয়, বেঙ্গালুরুর যে কোনও অফিসেই নাকি বাংলা বললে দিব্যি বহু লোকের সাড়া মিলবে!

আমাদের অনেকেরই যেটা জানা নেই, বাংলার ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নৃপতি সেনরাজারা আদতে ছিলেন কর্নাটকের বাসিন্দা। সে যুগে কর্নাটককে বলা হত ‘কর্ণাট’। উমাপতিধরের লেখা ‘দেওপাড়া প্রশস্তি’-তে রয়েছে, সেন বংশের আদিপুরুষ সামন্ত সেন ছিলেন দাক্ষিণাত্যের শাসক চন্দ্রবংশজাত ও ‘ব্রহ্মক্ষত্রিয়’ বীরসেনের উত্তরপুরুষ। তাঁরা যেখানে রাজত্ব করতেন, মোটামুটিভাবে তাকে আজকের মহীশূরের সন্নিহিত অঞ্চল বলে ধরা যেতে পারে।
ঠিক কী কারণে তিনি কর্ণাট ছেড়ে বাংলায় এলেন সেই নিয়ে কোনও খাঁটি খবর নেই। ‘ব্রহ্মক্ষত্রিয়’ জাতিপরিচয়টি দেখে ঐতিহাসিক ভাণ্ডারকর প্রস্তাব করেছেন, এনারা সম্ভবত আগে ছিলেন ব্রাহ্মণ, পরে ক্ষাত্রধর্মে পরিবর্তিত হ’ন।
বাংলায় তখন একরকম ডামাডোল চলছে বলা যায়। পাল-রাজাদের শাসন প্রায় ফিকে হয়ে গিয়েছে, জমিদাররা স্বাধীনভাবেই রাজত্ব করছেন। সামন্তসেন বা তাঁর পুত্র হেমন্তসেন সম্ভবত পাল রাজাদের সামন্ত হিসেবেই বাংলায় বসবাস শুরু করেন। তারপর কপাল খোলে। তবে হেমন্তসেনের আমলের কোনও কিছুই পাওয়া যায়নি। ব্যারাকপুর তাম্রশাসনে তাঁকে ‘রাজাধিরাজ’ উপাধি দেওয়া হয়েছিল, এইটুকুই আমাদের কাছে খবর। তাঁর পরবর্তী বিজয়সেনকে সেন রাজবংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলে ধরা হয়। তারপর বল্লালসেন ও তাঁর পুত্র, সেন বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ নরপতি লক্ষ্মণসেনের আমলে তা প্রবল শক্তিশালী এক স্বাধীন রাজবংশে পরিণত হয়।
আরও পড়ুনঃ কর্নাটকে তরুণ প্রজন্মের ভোট ঢেলে পড়েছে কংগ্রেসের দিকে, বিজেপির জন্য কি অশনি সঙ্কেত
প্রথাগতভাবে ‘বাঙালি’ না হয়েও সেনরাজাদের বহু কৃতিত্ব আজ বাংলা ও বাঙালির সংস্কৃতিতে জুড়ে রয়েছে। আজও সমাজে কুলীন বা কৌলিন্য নিয়ে যা সব প্রথা রয়েছে, কুলজী গ্রন্থ মতে, সেসবের জন্ম বল্লালসেনের হাতেই। অত্যন্ত পণ্ডিত ও শাস্ত্রজ্ঞ বল্লালসেনের ‘দানসাগর’ ও ‘অদ্ভুতসাগর’ গ্রন্থ এক অতুল কীর্তি। তবে এই ব্যাপারে লক্ষ্মণসেন সত্যিই অতুলনীয়। তাঁর পাণ্ডিত্য, তাঁর সামরিক সাফল্য, তাঁর কূটনৈতিক ধীশক্তিকে ছাপিয়ে আজ বাংলা ও বাঙালির আত্মায় অক্ষয় হয়ে রয়েছেন তাঁর সভার পাঁচ মহারত্নঃ শরণ, ধোয়ী, উমাপতিধর, গোবর্দ্ধন ও জয়দেব। ‘গীতগোবিন্দ’-এর তুল্য কাব্য তার পরের সহস্র বছরেও আর একটিও লেখা হয়নি।

সেন রাজারা যেখান থেকে এসেছিলেন, সেই অঞ্চলকে বলা হয় মহীশূর। পরে টিপু সুলতানের আমলে এই রাজ্য অপ্রতিরোধ্য শক্তিতে পরিণত হয়। কিন্তু মহীশূর নামটা এল কোথা থেকে? আদতে, নামটা হবে ‘মহিষুরু’, স্থানীয় ভাষায় যাকে বলে মহিষের আলয়। পণ্ডিতদের অনুমান, পুরাণমতে এই এলাকাতেই ছিল মহিষাসুরের বাসস্থান এবং চামুণ্ডি পাহাড়ের মাথাতেই দেবী চামুণ্ডেশ্বরীর হাতে তার ভবলীলা সাঙ্গ হয়। পরে ব্রিটিশদের মুখে মুখে ‘চুঁচুড়া’কে ‘চিনশুরা’ করার মতই ‘মহিষুরু’ হয়ে যায় ‘মাইসোর’। আজকের মহীশূরের কাছেই এই চামুণ্ডি পাহাড়ের মাথায় বিখ্যাত চামুণ্ডেশ্বরী মন্দির হোয়সল বংশের আমল থেকে আজও সগৌরবে রয়েছে।
এই মহিষাসুর বধই আজ বাংলার সর্বশ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গোৎসবের প্রধান বিষয়। শোনা যায়, সেন রাজাদের আমল থেকেই দেবী চামুণ্ডার আরাধনা বাংলায় ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয়। আজ বেঙ্গালুরুতেও বাঙালি অ্যাসোসিয়েশনের দুর্গাপুজো রীতিমতো বিখ্যাত।
আরও পড়ুনঃ কংগ্রেসের বিপুল জয় কর্নাটকে, বিজেপিকে টেনে নামাল ষাটের ঘরে
মহীশূরের অদ্বিতীয় নায়ক টিপু সুলতানের সঙ্গেও যোগাযোগ আছে কলকাতার। অবাক হওয়ার মতই ব্যাপার! পিতা হায়দর আলি এবং পুত্র টিপু দু’জনেই একের পর এক যুদ্ধে লড়ে গিয়েছেন ব্রিটিশের বিরুদ্ধে। ইতিহাস সে সবের নাম দিয়েছে ‘ইঙ্গ মহীশূর যুদ্ধ’ বা ‘অ্যাংলো মাইসুরু ওয়ার’। মোট চার দফায় এই যুদ্ধ চলেছিল, তৎকালীন দুর্ধর্ষ ব্রিটিশ বড়লাট লর্ড কর্নওয়ালিসের কার্যত ঘুম ছুটিয়ে দিয়েছিলেন টিপু। পরে চতুর্থ ইঙ্গ মহীশূর যুদ্ধে তাঁর মৃত্যু হলে ব্রিটিশরা মহীশূর দখল করে, পতন হয় রাজধানী শ্রীরঙ্গপত্তনমের। টিপু পুরো পরিবারকেই বন্দি করে পাঠানো হয় কলকাতায়। যাদের মধ্যে ছিলেন তাঁর পুত্র প্রিন্স আনোয়ার আলি শাহ ও প্রিন্স গোলাম মহম্মদ শাহ। বাকি জীবনটা কলকাতাতেই কেটেছিল তাঁদের। আজ কলকাতায় দু’জনের নামেই রাস্তা রয়েছে, প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডের ওপরেই রয়েছে শহরের সবচেয়ে বড় শপিং মল। প্রিন্স গোলাম মহম্মদ শাহ ১৮৪২ সালে মধ্য কলকাতায় একটি মসজিদ স্থাপন করেন, আজ যেটি ‘টিপু সুলতান মসজিদ’ নামে পরিচিত।

তবে কর্নাটককে নিঃসন্দেহে বাঙালির সবচেয়ে কাছে নিয়ে এসেছেন ঔপন্যাসিক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’ উপন্যাস কার্যত বাংলা সাহিত্যে একটি ‘ক্লাসিক’ বলে বিবেচিত। রবার্ট সিওয়েলের লেখা ‘দ্য ফরগটন এম্পায়ার’ বই থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে শরদিন্দুবাবু এই উপন্যাসের ভাবনাচিন্তা করা শুরু করেন। পরে রমেশচন্দ্র মজুমদারের লেখা দিল্লি সুলতানির সমসাময়িক দক্ষিণ ভারতের ইতিহাস থেকে সংগ্রহ করে লিখে ফেলেন বিজয়নগর রাজ্যের বিখ্যাত রাজা দেবরায়ের আমলের এক দুরন্ত কাহিনী। প্রেম ও যুদ্ধের মধ্যে মিশে যায় বিজয়নগর ও গজপতি রাজ্যের টানপড়েন। অর্জুনবর্মা, চিপিটকমূর্তি, মন্দোদরী, মণিকঙ্কণা, বিদ্যুন্মালা ইত্যাদি চরিত্রদের মিশেলে পনেরো শতকের বিজয়নগর সাম্রাজ্য যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাস পরে রবীন্দ্র পুরস্কারেও সম্মানিত হয়।

পরে কাকাবাবুও পৌঁছে গিয়েছেন বিজয়নগরে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা ‘বিজয়নগরের হীরে’ কৃষ্ণদেবরায়ের পরবর্তী সদাশিব রায় ও রাম রায়ের রাজত্বকালের নানা অজানা গল্পের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছে আমাদের।
বিজয়নগর সাম্রাজ্যের ধ্বংসাবশেষ আজও তুঙ্গভদ্রার তীরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। কৃষ্ণদেবরায়ের ‘অমুক্তমাল্যড়’ কাব্য, তাঁর অষ্টদিগগজ সভাসদদের অন্যতম তেনালি রামকৃষ্ণ বা তেনালিরামের গল্প আজও কন্নড় সাহিত্যের সঙ্গে পৌঁছে গিয়েছে আমাদের কাছেও। হাম্পি আজ ইউনেস্কোর অন্যতম বিশ্ব-ঐতিহ্য কেন্দ্র বলে স্বীকৃত। বহু বাঙালি পর্যটক আজ ভিড় করছেন সেখানে। তার পাশ দিয়ে যাওয়া ঝাঁ চকচকে হাইওয়ে ধরেই পৌঁছে যাওয়া যায় দেশের তথ্যপ্রযুক্তি রাজধানী বেঙ্গালুরুতে। যা আজ বহু বাঙালির কর্মস্থল। পাকাপাকিভাবে থেকেও যাচ্ছেন অনেকেই। বাংলা আর কর্নাটকের দোস্তি ভাঙার কোনও সম্ভাবনাই নেই।