
দ্য ওয়াল ব্যুরো: ‘ফিরিয়ে দাও আমার সেই বারোটা বছর…’ এজলাসে দাঁড়িয়ে কাঁপা গলায় আর্তনাদ করছেন একজন অসহায়-সর্বহারা বৃদ্ধ। গোটা আদালত পিন ড্রপ সাইলেন্স, কারও চোখ প্রায় শুকনো নেই। ‘সবার উপরে’ ছবির সেই বিখ্যাত দৃশ্য, বিখ্যাত সংলাপের কথা অনেকেরই মনে আছে। ছবি বিশ্বাসের জীবন্ত অভিনয় এখনও ভুলতে পারেননি বহু সিনেমাপ্রেমী। মিথ্যে মামলায় দোষী সাব্যস্ত বাবাকে কারাগারের অন্ধকূপ থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য ছেলে নিজেই বাবার হয়ে ওকালতি করেন এবং জয়ী হন। বেকসুর খালাস ঘোষণা করেন বিচারক। কিন্তু সে রায় শুনে, জীবনের দুর্মূল্য দীর্ঘ বারোটা বছর জেলে কাটিয়ে ফেলা বাবা অদৃষ্টের উদ্দেশে কাতর আর্তি করে বলতে থাকেন, ‘দাও, ফিরিয়ে দাও, ফিরিয়ে দাও আমার সেই বারোটা বছর!’
সেই দৃশ্যই যেন আজ নতুন করে ফিরে দেখল কলকাতা হাইকোর্টে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের (Justice Abhijit Ganguly) ১৭ নম্বর এজলাস। তবে ১২ বছর নয়, এবার ৪৭টি বছর হারিয়ে ফেলার আর্তি নিয়ে বিচারপতির মুখোমুখি হলেন ৭৬ বছরের বৃদ্ধা। বিচারপতির উদ্দেশে তিনি বললেন, ‘আপনি আইনের যোদ্ধা!’ এর উত্তরে বিচারপতি তাঁকে বলেন, ‘আইন আপনাকে গাছতলায় দাঁড় করিয়েছিল, আবার সেই আইনই আপনাকে আপনার প্রাপ্য সম্মান অর্থ ফিরিয়ে দিয়েছে।’
শুধু তাই নয়, বিচারপতিকে রবিঠাকুরের কবিতাও আবৃত্তি করে শোনান ওই বৃদ্ধা। পাল্টা উত্তরও দেন বিচারপতি, কবিতার দ্বারাই। শেষমেশ চোখের জলে ভেসে, ৪৭ বছর ধরে জীবন-যৌবন সব হারিয়ে ফেলার আক্ষেপ নিয়েই আদালত ছাড়েন তিনি।
ঠিক কী হয়েছে ঘটনাটি?
হাওড়ার শ্যামপুর হাইস্কুলের শিক্ষিকা ছিলেন শ্যামলী ঘোষ। অভিযোগ, নিজের প্রাপ্য বেতন তিনি পাননি প্রায় তিন দশক ধরে। ২৯ বছর বয়সে বিনা ব্যাখ্যায় স্কুল থেকে বরখাস্ত করা হয় তাঁকে। তার পরে প্রাপ্য সেই বেতন আদায়ের জন্য আইনি লড়াই শুরু করেন তিনি। এই নিয়ে একটানা ৪২ বছর ধরে তিনি লড়াই চালিয়েছেন। আদালতে চক্কর কাটতে কাটতেই পেকে গিয়েছে চুল। এক সময়ের যুবতী শিক্ষিকা এখন হয়েছেন প্রবীণ নাগরিক। তবু লড়াই থামেনি। দীর্ঘ সেই লড়াইয়ে অবশেষে সাফল্য এসেছে। সাফল্য এনে দিয়েছেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। গত বছর মে মাসে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় সেই মামলার রায়ে নির্দেশ দিয়েছিলেন, প্রবীণা ওই শিক্ষিকার সমস্ত বকেয়া বেতন সুদে আসলে তাঁর হাতে তুলে দিতে হবে। বকেয়া বেতনের সঙ্গে দিতে হবে ১০ শতাংশ সুদ।
১৯৭৬ সালে শ্যামপুরের ওই স্কুলে চাকরি পান শ্যামলী। বাম আমলে তাঁর চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় বেতন। ২০১৩ সালে মেয়াদ অনুযায়ী চাকরি থেকে অবসর নেন শ্যামলী। কিন্তু বেতনের জন্য লড়াই চলতে থাকে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক থেকে শুরু করে স্কুল শিক্ষা দফতরে ছোটাছুটি, একের পর এক চিঠি, কোনওটাই বাদ রাখেননি তিনি। কিন্তু কাজের কাজ হচ্ছিল না কিছুতেই। এর পরেই আইনের পথ ধরেন তিনি। কলকাতা হাইকোর্টে বিভিন্ন এজলাস ঘুরে মামলা আসে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাসে। শেষমেশ প্রবীণ শিক্ষিকাকে বিচার পাইয়ে দেন তিনি। রায় শুনে সেদিন হাইকোর্টে কেঁদে ফেলেছিলেন ৭৬ বছরের বৃদ্ধা শ্যামলী।
তবে প্রাপ্য টাকা পেয়ে গেলেও, এই মামলায় যিনি দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন, সেই উলুবেড়িয়া সাবডিভিশনে বনমালী জানা নামের সেই এডিআই-এর এখনও কোনও শাস্তি হয়নি। সেই শাস্তিই দেখতে চান শ্যামলী। তাই তাঁর বারবার ফিরে আসা আদালতে। আজ, বৃহস্পতিবারও দুপুর ২টো নাগাদ বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের ১৭ নম্বর এজলাসে হাজির হন ৭৬ বছর বয়সি শ্যামলী ঘোষ।
তাঁকে দেখে এদিন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘আপনার মত প্রবীণ মানুষদের এজলাসে দেখলে খুব খারাপ লাগে। আপনার পাওনা তো পেয়ে গেছেন, তবু কেন কষ্ট করে আদালতে আসেন?’ শ্যামলীদেবী হাতজোড় করে জানান, তিনি আদালতের নির্দেশে বকেয়া পেয়ে গেছেন জীবনের সায়াহ্নে এসে। কিন্তু যারা তাঁর চাকরি কেড়ে নিয়েছিল, তাঁর উপর অন্যায় অবিচার করেছে, তাদের যেন উপযুক্ত শাস্তি হয়!
উত্তরে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘সেই মামলার বিচার হবে। সময় লাগবে। আপনার আসার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন হলে আমি আপনাকে ডেকে পাঠাব।’ তখন শ্যামলীদেবী আবার বলেন, ‘আমি আপনাকে দেখতে আসি, আপনি কেমন আছেন। আমি এলে আপনার অসুবিধা হবে?’ বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় তখন বলেন, ‘আমার কেন অসুবিধা হবে। আপনার বার্ধক্যের জন্য বলেছি। আর এজলাসে যখন বসে আছি, তার মানে ভালই আছি।’
এর কিছু ক্ষণের মধ্যেই মামলার ডাক এসে যায় এদিন, আদালতের নির্দেশমত রাজ্য ভিজিলেন্স কমিশন মুখবন্ধ খামে রিপোর্ট জমা করে। সেই রিপোর্টে উলুবেড়িয়ার এডিআই বনমালী জানার বিরুদ্ধে তথ্য প্রমাণ জমা পড়ে। এই বনমালী জানাই শ্যামলী ঘোষকে হেনস্থা করে ছিল বলে অভিযোগ। রিপোর্ট দেখে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় নির্দেশ দেন, ভিজিলেন্স কমিশনকে নির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ দিয়ে ৩ সপ্তাহের মধ্যে শিক্ষা দফতরের সচিবকে জানাতে হবে, যাতে বনমালী জানার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। রাজ্য ভিজিলেন্স কমিশন ভাল কাজ করেছে বলেও জানান বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়।
এর পরে মামলা শেষে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় শ্যামলীদেবীর উদ্দেশে বলেন, ‘ম্যাডাম আপনার কেস হয়ে গেছে, আপনি এবার বাড়ি যান।’ এই সময়ে শ্যামলী দেবী বিচারপতির সামনে দাঁড়িয়ে আবৃত্তি করেন রবিঠাকুরের পূরবী কাব্যগ্রন্থের লীলাসঙ্গিনী কবিতার অংশ, ‘কেন অবেলায় ডেকেছো খেলায়, সারা হয়ে এল দিন, এবার কি তবে শেষ খেলা হবে নিশীথ-অন্ধকারে?’ এই কবিতাটি আবৃত্তি করে তিনি বলেন, ‘৭৬ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই কবিতা লিখেছিলেন। আমিও শেষ বয়সে এসে বিচার পেয়ে এই উপলব্ধি করলাম। কিন্তু বিধবা অবস্থায় দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে যে কষ্ট সহ্য করেছি, তা বলার নয়। যাদের জন্য এই কষ্ট তারা উপযুক্ত শাস্তি পাক, সেই দেখতেই আদালতে আসা।’
এ কথার উত্তরে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় তাঁকে বলেন, ‘আপনি দেখছি কবিতা ভালবাসেন। যাঁরা কবিতা ভালবাসে তাঁরা খারাপ হয় না। এছাড়াও আপনি রবীন্দ্র অনুরাগী। শেষ বেলায় বিচার পাচ্ছেন সেটা ঠিকই, তবে মনে রাখবেন, এখনই অন্ধ বন্ধ কোরো না পাখা। আপনি ভাল থাকুন।’
এদিনও চোখের জলে আদালত ছাড়েন শ্যামলীদেবী। তবে আর্তি রেখে যান ভরা আদালতে, ‘ফিরিয়ে দাও আমার জীবন-যৌবন, আমার ৪৭টা বছর!’
কৃত্রিম যোনি ও জরায়ু তৈরি করে নজির কল্যাণীর জেএনএম হাসপাতালের, বড় সাফল্য রাজ্যের