
দ্য ওয়াল ব্যুরো: পাখিরা শীতকালে শরীর গরম রাখে কীভাবে? পালক ফুলিয়ে? মোটেও তা নয়। এ তো এতদিনের থিওরি ছিল। নতুন খোঁজ একেবারেই আলাদা। জানলে তাক লেগে যাবে।
আমরা ভাবতাম, শীত পড়লে পাখিরা তাদের পালক ফুলিয়ে রেখে তার ভেতরে বাতাস ধরে রাখে। শরীরের তাপে গরম হয়ে যা বাইরে বের হতে পারে না। ফলে গরম বাতাস শরীর গরম রাখে। এটাই ছিল ধারণা। সুইডেনের বিজ্ঞানীরা বলছেন, না তা নয়। কাঁপুনি থেকে বাঁচতে অনেক সময় পাখিরা পালক ফোলায় ঠিকই, কিন্তু শরীর গরম রাখার এটাই উপায় নয়। আসলে প্রাকৃতিকভাবেই শরীর গরম রাখার পদ্ধতি পাখিদের আছে যা অনেক স্তন্যপায়ী প্রাণীরও নেই। এই পদ্ধতি হল তাপ উৎপন্ন করা। শরীরের ভেতরেই প্রাকৃতিক হিটার বানিয়ে নেওয়া। এই হিটারে তৈরি হবে তাপ, আর সেই তাপ ছড়িয়ে পড়বে সারা শরীরে। ভেতরের তাপমাত্রাও বাড়বে এবং বাইরের পরিবেশের আবহাওয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্যও বজায় থাকবে।
‘ফেডারেশনন অব আমেরিকান সোসাইটি ফর এক্সপেরিমেন্টাল বায়োলজি’ সায়েন্স জার্নালে এই গবেষণার খবর ছাপা হয়েছে সম্প্রতি। সুইডিশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, পাখিদের শরীরের এই প্রাকৃতিক হিটার হল ‘শক্তিঘর’ মাইটোকনড্রিয়া। স্তন্যপায়ীদের লোহিত রক্তকণিকার মধ্যে মাইটোকনড্রিয়া থাকে না, কিন্তু পাখিদের থাকে। আর এই বিশেষ শারীরিক বৈশিষ্ট্যকেই তারা কাজে লাগায় তাপ তৈরি করার জন্য। লান্ড ও গ্লাসগো ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীরা বলছেন, পাখিদের লোহিত কণিকার মধ্যে থাকা এই মাইটোকনড্রিয়া যতটা শক্তি তৈরি করে, ততটাই তাপ উৎপন্ন করে। মানে শরীরে ভেতরে শক্তির জোগানও দেয়, আবার হাড় কাঁপানো ঠান্ডা থেকে শরীরকে গরমও রাখে।
আরও পড়ুন: গান গাইতে ভুলেছে, ভুল সুর তুলছে, প্রেমও করতে পারছে না বিপন্ন পাখিরা
মাইটোকনড্রিয়া কীভাবে কাজ করে সেটা বলার আগে, এই কোষীয় অঙ্গানু সম্পর্কে একটু জেনে নেওয়া যাক। সহজ করে বললে, মাইটোকনড্রিয়াকে বলে শক্তিঘর বা কোষের পাওয়ার হাউস। বৃত্তাকার মাইটোকনড্রিয়ার ব্যাস ০.২ থেকে ২ মাইক্রোমিটার অবধি হয়, দৈর্ঘ্যে ৪০-৭০ মাইক্রোমিটার আর দন্ডাকার মাইটোকনড্রিয়ার দৈর্ঘ্য ৯ মাইক্রোমিটার অবধি হয়। এই মাইটোকনড্রিয়ার কাজ অজস্র। শক্তি তৈরি করা, ফ্যাটি অ্যাসিডের বিপাক নিয়ন্ত্রণ, প্রাণিকোষে শুক্রাণু ও ডিম্বানু তৈরিতে ভূমিকা নেওয়া, কিছু পরিমাণ ডিএনএ ও আরএনএ তৈরি করা, স্মৃতিশক্তিকেও প্রভাবিত করতে পারে এই অঙ্গানু। বিজ্ঞানীরা বলেন, মানুষের বিবর্তনের ইতিহাসেও ভূমিকা আছে মাইটোকনড্রিয়ার, কারণ এর মধ্যে ডিএনএ-র বৈচিত্র্য পরিবর্তিত হয়।
আরও পড়ুন: নতুন গান গাইছে চড়াইরা, বদলে যাচ্ছে সুর, ছড়িয়ে পড়ছে মাইলের পর মাইল, অবাক হয়ে শুনলেন বিজ্ঞানীরা
যাই হোক, এহেন কোষীয় অঙ্গানু মাইটোকনড্রিয়া যার মূল কাজ শক্তি তৈরি করে সারা শরীরে এনার্জি পাঠানো, সেই পাখিদের শরীরে হিটারে বদলে যায় শীত বা ঠান্ডার সময়। মানে যখন তাপমাত্রা স্বাভাবিকের নীচে থাকে এবং পাখিরা তাদের শরীর গরম রাখতে চায়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, শীতের সময় পাখিদের মাইটোকনড্রিয়া শক্তির থেকেও বেশি তাপ তৈরি করে। রক্ত তখন রেডিয়েটরের মতো কাজ করে। এই তাপ সারা শরীরের কোষে কোষে পৌঁছে যায়।
বিজ্ঞানীরা পাখিদের রক্তের নমুনা নিয়ে সেল-রেসপিরোমিটারে পরীক্ষা করা দেখেছেন, কতটা অক্সিজেন মাইটোকনড্রিয়ায় জারিত হয়ে শক্তি তৈরি করে আর কতটা তাপ তৈরি করে। শীতের সময় এই তাপ তৈরির প্রক্রিয়াই বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে।
সুমেরু ও কুমেরু বৃত্তে থাকা কিছু পাখি ও প্রাণীদের মধ্যেও এই তাপ তৈরি করার বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। যেমন পেঙ্গুইন, তিমি মাছ, মেরু ভাল্লুক, শিয়াল, শিল ইত্যাদি প্রাণীরা বাইরের পরিবেশের তাপমাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শরীরের ভেতরেই তাপ তৈরি করে নিতে পারে। তাই এদের বলে এন্ডোথার্ম (এন্ডো মানে ভেতরে, থার্ম মানে তাপ)। তাই আন্টার্কটিকায় যখন তাপমাত্রা হিমাঙ্কের বহু নীচে নেমে যায়, তখনও দিব্যি ফুরফুরে, খোশমেজাজে দেখা যায় পেঙ্গুইনদের, কারণ তখন তাদের শরীরের ভেতরটাই টগবগ করে ফোটে, মানে রেডিমেড তাপ তৈরি হতে থাকে।
বিজ্ঞানী আন্দ্রে নর্ড বলছেন, এটাই আশ্চর্যের যে পাখিরা তাদের রক্তের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে। এইভাবে প্রয়োজনের সময় তাপ তৈরি করে সারা শরীরে ছড়িয়ে দেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। ছোট ছোট পাখিদেরও এই ক্ষমতা থাকে। এখন পাখিরা কীভাবে তাদের মাইটোকনড্রিয়ার কারসাজিতে শরীরে ভেতরে হিটার বানিয়ে ফেলে তারই খুঁটিনাটি পরীক্ষা করে দেখছেন বিজ্ঞানীরা।