
রূপাঞ্জন গোস্বামী
১৮৫০ সাল, মাত্র ছ’বছর বয়েসে অনাথ হয়ে গিয়েছিল আমেরিকার টেনেসির মুর কাউন্টির জেসপার নিউটাউন ড্যানিয়েল। ডাক নাম ‘ জ্যাক‘। মাত্র এক বছর বয়েসে মাকে হারায় জ্যাক। তারা ছিল ১০ ভাইবোন। বাবার ছিল অগাধ সম্পত্তি। জ্যাকের মায়ের মৃত্যুর পর দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন জ্যাকের বাবা। দ্বিতীয়পক্ষের স্ত্রীর তিন ছেলে মেয়ে হয়।
আমেরিকার গৃহযুদ্ধে আচমকা মারা গিয়েছিলেন জ্যাকের বাবা ক্যালাওয়ে ড্যানিয়েল ১৩ ছেলে মেয়ে ও দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীকে রেখে। বাবার মৃত্যুর পর জ্যাকেদের পরিবারে সম্পত্তি নিয়ে বিবাদ লাগে। সৎ-মা’র অত্যচারে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয় জ্যাকের দাদা দিদিরা। ছ’বছরের বালক জ্যাক ড্যানিয়েলকে নিয়ে এসেছিলেন ড্যান কল নামে লুথেরান চার্চের এক যাজক। তাঁর ছিল একটি মুদিখানার দোকান। সেই দোকানের পিছনে ছিল একটি কারখানা। সেখানে অবৈধভাবে ‘মুনশাইন’ নামে একটি স্থানীয় হুইস্কি তৈরি করতেন ড্যান কল।
ড্যান কলের হুইস্কি কারখানার মূল কর্মী ও টেস্টার ছিলেন নাথান নিয়ারেস্ট গ্রিন। তিনি ছিলেন ড্যান কলের অ্যাফ্রো-আমেরিকান ক্রীতদাস। দাসপ্রথা উঠে গেলে তিনি থেকে যান ড্যান কলের কাছে। সুরা তৈরিতে নাথাম গ্রিনের ছিল অকল্পনীয় দক্ষতা। এক ফোঁটা সুরা জিভে নিয়ে বলতে পারতেন তার গুণমান ও সেই সুরার দাম কী হওয়া উচিত। ড্যান ও নাথানের তৈরি ‘মুনশাইন’ সুরা জনপ্রিয় ছিল এলাকায়।
চার্চের সহায়তায় লেখাপড়া চালানোর পাশাপাশি জ্যাক ড্যানিয়েল ড্যান কলের মুদিখানার দোকানে টুকিটাকি কাজে সাহায্য করত। কিন্তু জ্যাকের অসীম আগ্রহ ছিল দোকানের পিছনের কারখানাটিতে কী হয় তা জানার। কিন্তু ড্যান কল সেখানে জ্যাককে কিছুতেই যেতে দিতেন না। এভাবেই কাটল বছর সাতেক।
জ্যাকের বয়েস যখন ১৩ বছর, একদিন জ্যাককে নিয়ে ড্যান গেলেন তাঁর সুরা তৈরির কারখানায়। বালক জ্যাক অবাক হয়ে দেখেছিল সুরা তৈরির পদ্ধতি। সেদিন ড্যান কল বালক জ্যাককে হাতে ধরে শিখিয়েছিলেন হুইস্কি তৈরির ঘরোয়া পদ্ধতি। যাজক হিসেবে তাঁর অপরাধ বোধও ছিল এর জন্য, কিন্তু তার চেয়েও সম্ভবত বেশি অপরাধবোধে ভুগতেন যাজক হয়ে মদের ব্যবসা করেন বলে।
ড্যান কল অনুভব করতেন তিনি যাজক হয়ে যেটা করছেন সেটা ঠিক নয়। তাই তিনি তাঁর কারখানাটিকে বিক্রি করতে ও হুইস্কি তৈরির স্বতন্ত্র পদ্ধতিটি কাউকে শিখিয়ে দিতে যেতে চাইছিলেন। বালক জ্যাকের মদ তৈরিতে উৎসাহ থাকলেও মদ্যপানে একদম উৎসাহ ছিল না। তাই বালক জ্যাকের মধ্যে এক সম্ভাবনাময় সুরা নির্মাতাকে খুঁজে পেয়েছিলেন ড্যান।
পরবর্তীকালে জ্যাক ড্যানিয়েলকে আসল প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন ড্যান কলের হুইস্কি কারখানার নিয়ারেস্ট গ্রিন নামের সেই কৃষ্ণাঙ্গ কর্মী। জ্যাক ড্যানিয়েলকে তৈরি করার মূল কৃতিত্ব হয়তো তাঁরই। কিন্তু এই কৃষ্ণাঙ্গ মানুষটিকে বিশ্ব ততোটা চেনে না, যতটা চেনে ড্যান কলকে।
১৮৭৫ সাল, জ্যাক ড্যানিয়েল আইনি লড়াই লড়ে বাবার সম্পত্তির ভাগ আদায় করে নিয়েছিলেন। তারপর ড্যান কলের সঙ্গে মদের ব্যবসায় নেমেছিলেন। তখন তাঁর বয়েস ২৯ বছর। তাঁদের সঙ্গে রইলেন অভিজ্ঞ নাথান নিয়ারেস্ট গ্রিন। জ্যাক চেয়েছিলেন বৈধভাবে ব্যবসা করতে। তাই তিনি সরকার থেকে ডিস্টিলারির লাইসেন্স বের করেছিলেন। লাইসেন্স পাওয়ার পর স্থাপন করলেন Est. & Reg কোম্পানি। তিনজনের মিলিত উদ্যোগে তৈরি হতে লাগল জনপ্রিয় ‘মুনশাইন’ হুইস্কি।
১৮৮৩ সালে মদ ব্যবসা থেকে হঠাৎই নিজেকে সরিয়ে নিলেন ড্যান কল। কারণ, নিজের অপরাধবোধ তো ছিলই, এছাড়াও ড্যানের স্ত্রী স্বামীকে বলেছিলেন, হুইস্কি ব্যবসা ও চার্চের যাজকের মধ্যে যে কোনও একটি পেশা বেছে নিতে হবে। না হলে তাঁর পক্ষে ড্যানের সঙ্গে থাকা সম্ভব নয়। সুরাব্যবসা ছেড়ে ধর্মকেই আঁকড়ে ধরেছিলেন ড্যান। ব্যবসা থেকে ড্যান কলের প্রাপ্য বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ৩৪ বছরের জ্যাক। আশ্রয়দাতা ড্যান কলের সঙ্গে সম্পর্ক রেখেছিলেন মৃত্যু পর্যন্ত। কারণ ড্যান কলের প্রতি ছিল তাঁর অসীম কৃতজ্ঞতা।
১৮৮৪ সালে জ্যাক ড্যানিয়েল তাঁর সালে সুরা কারখানার জন্য নতুন জায়গার খোঁজ করতে লাগলেন। লিঞ্চবার্গের কাছে একটা জমি তাঁর পছন্দ হয়েছিল। জমিটির চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে প্রচুর সুগার ম্যাপল গাছ এবং একপাশে রয়েছে একটি পাথুরে গুহা। যার ভেতর দিয়ে বয়ে চলেছে খরস্রোতা এক ঝরনা। যার জলে আয়রন প্রায় নেই বললেই চলে।
জ্যাক ড্যানিয়েল কিনে ফেলেছিলেন বিশাল জমিটি। কয়েক মাসের মধ্যে নতুন জমিতে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল এক নতুন কোম্পানি, Jack Daniel Distillery। বিশ্ববিখ্যাত হওয়ার পরেও জ্যাক ড্যানিয়েল বিশ্বাস করতেন তাঁর সুরার খ্যাতির পিছনে তাঁর ফর্মুলার অবদান যতটা, এই ঝরনাটির বিশুদ্ধ জল ও ম্যাপল গাছের অবদান ততটাই।
তাঁর ফার্মের ভেতরে থাকা ঝরনাটির জল, ম্যাপল কাঠ ও সেই কাঠ পুড়িয়ে তৈরি করা কাঠকয়লা হুইস্কি প্রস্তুতিতে ব্যবহার করেছিলেন জহুরি জ্যাক। ড্যান কলের মুনশাইন হুইস্কির পিছনে ছিল ফ্রান্সের বার্বন ঘরানার ডিস্টিলেশন, কিন্তু ড্যান তাঁর হুইস্কিকে আমেরিকার টেনেসি ঘরানায় আনতে চাইলেন। যেখানে প্রতি চুমুকে থাকবে চমক, থাকবে দেশের স্বাদ। তাই ড্যান কলের বার্বন ঘরানার মুনশাইন হুইস্কিকে সরিয়ে জ্যাক ড্যানিয়েল হাজির করেছিলেন টেনেসি ঘরানায় প্রস্তুত তাঁর নিজের ব্র্যান্ড Jack Daniel’s Old No.7 হুইস্কি।
Old Lincoln County পদ্ধতির সঙ্গে নিজস্ব ফর্মুলার মেলবন্ধন ঘটিয়ে উচ্চমানের হুইস্কি তৈরি করতে লাগলেন। হুইস্কি তৈরি হওয়ার পর কাঠের ট্যাঙ্ক থেকে ১০ থেকে ১২ দিন ধরে ফোঁটা ফোঁটা হুইস্কি ঝরে পড়ত ১০ ফুটের একটি ভ্যাটে। ‘সুগার ম্যাপল’ কাঠের তৈরি ভ্যাটটি ঠাসা থাকতো ম্যাপল কাঠ পুড়িয়ে পাওয়া কাঠকয়লা দিয়ে। এই বিশেষ ধরনের কাঠকয়লার ভেতর দিয়ে পরিস্রুত হতে হতে নামত প্রতি ফোঁটা হুইস্কি। হুইস্কির সঙ্গে মিশতো চারকোলের স্মোকি ফ্লেভার।
ভ্যাটের নীচে থাকত ম্যাপল কাঠের পিপে। ভর্তি হয়ে গেলেই পিপেগুলি চালান করে দেওয়া হত মাটির তলায় থাকা গুদামে, ব্যাচ নাম্বার ও তারিখ বসিয়ে। মাটির তলার গুদামঘরে রাখা সারি সারি ম্যাপল কাঠের পিপের মধ্যে থাকা হুইস্কি নির্দিষ্ট সময় পর বিক্রির জন্য সম্পূর্ণ ভাবে তৈরি হয়ে গেলে বোতলে ভরে বাজারে পাঠানো হতো।
পৃথিবীর তাবড় তাবড় সুরা নির্মাতা কোম্পানিগুলি বিশ্বাস করে হুইস্কি যত পুরনো হবে, তত সুরার মান, দাম ও কৌলিন্য বাড়বে। কিন্তু জ্যাক ড্যানিয়েলের চিন্তাধারা ছিল আলাদা। তিনি সবচেয়ে গুরুত্ব দিতেন হুইস্কির স্বাদ, গন্ধ ও বর্ণের ওপর। কারণ তিনি দেখেছিলেন হুইস্কি নতুন না পুরনো তা নিয়ে বেশিরভাগ সাধারণ ক্রেতার মাথা ব্যথা নেই।
প্রতি ব্যাচের হুইস্কি বাজারে গেলে, গোপনে বিভিন্ন শহরের বারগুলিতে ঘুরতেন জ্যাক ড্যানিয়েল, হুইস্কি সেবনের পর গ্রাহকদের প্রতিক্রিয়া দেখতেন দূর থেকে। জ্যাক ড্যানিয়েল চাইতেন না, গ্রাহকেরা তাঁর হুইস্কি সেবন করে বেহেড মাতাল হয়ে নিজেদের মধ্যে মারপিট করুক। তাঁর কোম্পানির হুইস্কি পানের পর গ্রাহকদের প্রতিক্রিয়া দেখে পরবর্তী ব্যাচের হুইস্কির কোয়ালিটিতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ঘটিয়ে বাজারে ছাড়তেন। এই ভাবেই নির্দিষ্ট মানে ও স্বাদে আনতে পেরেছিলেন Jack Daniel’s Old No.7 টেনেসি হুইস্কিকে। ১৮৯৬ থেকে যার স্বাদ আজও অপরিবর্তিত।
১৮৯৭ সালে বোতলের আঙ্গিকে পরিবর্তন এনেছিলেন জ্যাক ড্যানিয়েল। চৌকো ধরনের অভিজাত চেহারার বোতলে বিক্রি করতে শুরু করেছিলেন Jack Daniel’s Old No.7 হুইস্কি। মার্কেটে সুপারহিট হয়ে গিয়েছিল জ্যাক ড্যানিয়েলের হুইস্কি। ১৯০৪ সালে সেন্ট লুইসে হওয়া বিশ্ব হুইস্কি মেলায় গোল্ড মেডেল পেয়েছিল জ্যাক ড্যানিয়েল-এর হু্ইস্কি । এরপর সারা বিশ্বে জ্যাক ড্যানিয়েলের হুইস্কির খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে আর সময় লাগেনি।
প্রচুর মিথ আছে জ্যাক ড্যানিয়েলের হুইস্কির Old No.7 নামটি নিয়ে। কেউ বলেন অবিবাহিত জ্যাক ড্যানিয়েলের নাকি ৭ জন গার্লফ্রেন্ড ছিল। কেউ বলেন ৭ নম্বর ট্রেন তাঁর হুইস্কির ব্যারেল বইত। কেউ বলেন তিনি একটি ব্যাচের হুইস্কি ৭ বছর খুঁজে পাননি, খুঁজে পাওয়ার পর নাম দেন Old No. 7। কেউ বলেন তাঁর কোম্পানির রেজিস্ট্রেশান নাম্বার ছিল সাত। কিন্তু নামের পিছনে থাকা সঠিক কারণ আজও জানা যায়নি।
১৯১১ সালের ১০ অক্টোবর ৬২ বছর বয়সে মৃত্যু হয় জ্যাক ড্যানিয়েলের। মৃত্যুর ৬ বছর আগে, একদিন সকালে তাঁর টাকা রাখার আলমারি খুলতে না পারায়, রাগে লাথি মেরেছিলেন আলমারিতে। পা কেটে গিয়েছিল। কিন্তু আঘাতকে গুরুত্ব দেননি। ক্ষতটির যত্ন না নেওয়া ও অবহেলার ফলে ক্ষতটি বিষিয়ে যায়।
ছ’বছর ধরে জ্যাক ড্যানিয়েলের সারা শরীরে ইনফেকশন ছড়িয়ে পড়েছিল। যার পরিণতি ছিল অকালে মর্মান্তিক মৃত্যু। অথচ দূর্ঘটনার দিন জ্যাক ড্যানিয়েলের হাতের কাছেই ছিল তাঁর তৈরি Old No. 7 হুইস্কি। কিছুটা হুইস্কি ক্ষতটিতে লাগিয়ে দিলে অ্যালকোহলের জীবাণুনাশক ক্ষমতার জন্য হয়তো বেঁচে যেতেন জ্যাক ড্যানিয়েল।
আজ, জ্যাক ড্যানিয়েলের মৃত্যুর ১০৮ বছর পর, Jack Daniel’s Old No.7 হলো পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া আমেরিকান হুইস্কি। Jack Daniel Distillery হলো পৃথিবীর একমাত্র সুরা নির্মাতা কোম্পানি যেখানে ডিস্টিলারি দেখতে যাওয়া হাজার হাজার পর্যটককে বিনা পয়সায়, ছোট্ট বোতলে Jack Daniel’s Old No.7 টেনেসি হুইস্কি স্মারক হিসেবে দেওয়া হয়। মাসের প্রথম শুক্রবার কর্মীদের মাইনে দিতেন জ্যাক ড্যানিয়েল, সঙ্গে দিতেন এক বোতল Old No.7। আজও সেই নিয়ম চলে আসছে।
৫ ফুট ২ ইঞ্চির মানুষটি ছোট্ট একটি বাক্যে ব্যবসার মূল সুর বেঁধে দিয়ে গিয়েছিলেন “Every day we make it, we’ll make it the best we can।” ইতিহাস মনে করে এই বাক্যটির ভেতরেই লুকিয়ে আছে জ্যাক ড্যানিয়েল এবং Jack Daniel’s Old No.7 টেনেসি হুইস্কির আকাশ ছোঁয়া সাফল্য।