
দ্য ওয়াল ব্যুরো: হাইকোর্টের নির্দেশে স্কুল সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যানের পদ থেকে রাজ্য সরকার শুভশঙ্কর সরকারকে সরিয়ে দিয়েছে। শিক্ষা দফতর সূত্রের খবর, রাজ্য সরকার হাইকোর্টের নির্দেশ পালন করলেও শুভশঙ্করবাবুকে দফতর কাঠগড়ায় তোলেনি। যে সব মামলা ঘিরে কমিশনের ভূমিকায় অসন্তোষ প্রকাশ করে আদালত চেয়ারম্যানকে অপসারণ করতে বলে সেগুলি বহু পুরনো। শুভশঙ্করবাবু মাত্র বছর খানেক আগে দায়িত্ব নেন।
আদালতের রায়ে এসএসসি-র চেয়ারম্যান পদ থেকে সরে যেতে হলেও শিক্ষা দফরত সূত্রের খবর, শুভশঙ্করবাবু সহকর্মীদের কাছে এই অপসারণে ভিন্ন কারণে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। এসএসসি-র দায়িত্ব যাওয়ায় তাঁর কাজের বোঝা কমেছে। নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি এখন পূর্ণ সময় দিতে পারবেন। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তিনি। অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে এসএসসি-র চেয়ারম্যান পদ সামলাতে হচ্ছিল। ফলে দুই প্রতিষ্ঠানের প্রতিই অবিচার হচ্ছিল, মনে করেন শিক্ষা দফতরের অফিসারদের বড় অংশ।
শুভশঙ্করবাবুর জায়গায় এসএসসির চেয়ারম্যান হচ্ছেন অধ্যাপক সিদ্ধার্থ মজুমদার। তিনি এর আগে কলেজ সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন। শিক্ষামহলের খবর, রাজ্যের দুই মন্ত্রীর মেয়েদের কলেজে চাকরির প্যানেলে নাম রাখার নির্দেশ অগ্রাহ্য করায় তাঁকে সরতে হয়েছিল। তাঁর পক্ষে কারও নাম প্যানেলে ঢোকানো সম্ভব নয় জানিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তাকে হাতে হাতে পদত্যাগপত্র দিয়ে দেন তিনি। ফিরে যান সিটি কলেজের চাকরিতে। সিটি কলেজে অধ্যাপনার সুবাদে তিনি বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর প্রাক্তন সহকর্মী। এই দফায় তিনি শুধু স্কুল সার্ভিস কমিশনের দায়িত্বই পালন করবেন।
শুধু শুভশঙ্করবাবুই নন, তৃণমূল সরকারের সময়ে শিক্ষা ক্ষেত্রে এক ব্যক্তিকে একাধিক পদে বসানো এবং এক প্রতিষ্ঠানে কাউকে বছরের পর বছর রেখে দেওয়া একপ্রকার স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে। আবার মাসের পর মাস অস্থায়ী উপাচার্য হিসেবে কাজ চালানোর মতো অসম্মানজনক পরিস্থিতির মধ্যেও পড়তে হয়েছে বহু নামজাদা শিক্ষককে।
শিক্ষামহলে বহুদিন ধরেই প্রশ্ন ঘোরাফেরা করছে, রাজ্যের শিক্ষা জগতে কি উপযুক্ত শিক্ষক প্রশাসকের অভাব পড়েছে? তা হলে একই ব্যক্তিকে বছরের পর বছর এক পদে বা একাধিক পদে রেখে দেওয়া হচ্ছে কেন? যা থেকে এই প্রশ্নও কেউ কেউ করছেন, শিক্ষা প্রশাসকের পদে যোগ্যতা পরিবর্তে আনুগত্যই কি শেষ কথা হয়ে দাঁড়িয়েছে? বাম জমানায় এই প্রবণতার জন্ম হলেও বর্তমান সরকারের সময় তা অতীতের সব নজির ছাপিয়ে গিয়েছে।
শিক্ষা মহলের খবর, একই পদে বছরের পর বছর থাকা কয়েকজন শিক্ষা প্রশাসকের চাকরির মেয়াদ ফুরিয়ে গিয়েছে। তাঁদের ওই পদে রেখে দিতে আগেই চাকরির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছিল। এখন মেয়াদ শেষেও কাজ করছেন এক-দু’জন। একটি প্রতিষ্ঠানের এমনই এক শীর্ষকর্তার গত দু-মাসের বেতন আটকে গিয়েছে, প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নেওয়া অর্থের হিসেব জমা না করায়।
কলেজ সার্ভিস কমিশনে অনেক দিন ধরে আছেন অধ্যাপক দীপক কর। আবার তিনিই সিধো-কানহু-বীরশা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। তিনিই আবার কলকাতার আশুতোষ কলেজেরও প্রিন্সিপ্যাল। অর্থাৎ একজন তিনটি পদ সামলাচ্ছেন। সিধো-কানহু-বীরশা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড় সংলগ্ন এলাকায়। অন্যদিকে, কলেজ সার্ভিস কমিশনের অফিস নিউটাউনে। আশুতোষ কলেজ দক্ষিণ কলকাতায়। তিনটি পদই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদ এবং কাজের চাপ বিপুল। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে তাঁকে কলকাতা-পুরুলিয়া করতে হয়।
২০১৫ সালে যাত্রা শুরু করে ওয়েস্ট বেঙ্গল টিচার্স ট্রেনিং, প্ল্যানিং অ্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। সেটির উপাচার্য অধ্যাপক সোমা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনিই বিগত কয়েক বছর যাবৎ সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। তাঁকে সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি করে ওই প্রতিষ্ঠানের এক অধ্যাপককে বঞ্চিত করা হয়েছে।
স্কুল সার্ভিস কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান অধ্যাপক সুবীরেশ ভট্টাচার্য একই সঙ্গে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় এবং হিল বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন বেশ কয়েক বছর হল। আবার বেশ কয়েক মাস হয়ে গেল রাজ্যের দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা অস্থায়ী হিসেবে কাজ করছেন। একজন বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালের অধ্যাপক শিবাজী প্রতীম বসু, অপরজন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ব বিদ্যালয়ের সব্যসাচী বসু রায়চৌধুরী।
অন্যদিকে, তৃণমূল জমানার শুরু থেকে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের চেয়ারম্যানের পদে আছেন তৃণমূল নেতা মানিক ভট্টাচার্য। গত বিধানসভা নির্বাচনে তিনি তৃণমূলের টিকিটে জিতে বিধায়ক হয়েছেন। কেন তাঁকে ওই পদে দশ বছর বসিয়ে রাখা হয়েছে তা নিয়ে শিক্ষা শিবিরে গুঞ্জনের অভাব নেই। শাসক দলের বিধায়কের প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের চেয়ারম্যান থাকতে আইনি বাধা নেই। কিন্তু নৈতিকতার প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই।
উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের চেয়ারম্যানের পদ থেকে মহুয়া দাস সরে যাওয়ার পর ওই পদে বসেন ড. চিরঞ্জীব ভট্টাচার্য। তিনি একই সঙ্গে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্যের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন।
আবার অধ্যাপক কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায় মাধ্যমিক শিক্ষা পর্যদে আছেন ২০১২ থেকে। ২০১৬-র জুলাই পর্যন্ত ছিলেন পর্ষদের প্রশাসক। ২০১৬ থেকে এখনও পর্যন্ত আছেন সভাপতি পদে। মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার পরও কেন একজনকে এত বছর রাখা হয়েছে তা নিয়ে শিক্ষা দফতরেও জল্পনার শেষ নেই। এই ব্যাপারে শিক্ষা দফতরের অফিসারেরা কেউ কথা বলতে রাজি হননি। চেষ্টা করেও মেলেনি শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর প্রতিক্রিয়া।