
ডঃ অভিজিৎ চৌধুরী
সারা বিশ্বে যে অসুখ সবচেয়ে বেশি মাথাচাড়া দিয়েছে তা হল অর্গ্যান ফেলিওর বা অঙ্গ বৈকল্য। মানবশরীরের জীবনদায়ী অঙ্গগুলো যেমন, হার্ট, লিভার বা কিডনি বিকল হলে সেগুলো যদি সঠিক পদ্ধতিতে প্রতিস্থাপন করা যায়, তাহলে মানুষ সম্পূর্ণ নতুন জীবন ফিরে পায়। সুস্থ ভাবে বাঁচতে পারে। এই ভাবনা থেকেই, বিশ্বজুড়ে ‘রিপ্লেসমেন্ট অব অর্গ্যান’কে কেন্দ্র করে ট্রান্সপ্লান্টেশন বা অঙ্গের প্রতিস্থাপনজনিত অস্ত্রোপচারের চাহিদা অনেক বেড়েছে।
এখন প্রশ্ন হল, এই অঙ্গ আসবে কোথা থেকে! হার্ট তো আর অন্য কারোর থেকে নেওয়া যায় না। লিভার বা কিডনি তবুও নেওয়া যায়। তাহলে উপায়? এই সমস্ত ট্রান্সপ্লান্টেশন বা প্রতিস্থাপনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বা বলা যেতে পারে সভ্যতার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ দিক হল, মস্তিষ্ক-মৃত ব্যক্তিদের থেকে অঙ্গ নেওয়া। পথ দুর্ঘটনা বা স্ট্রোকের কারণে মস্তিষ্কের মৃত্যু হলে, সেই রোগীর হার্ট, লিভার, কিডনি বা কর্ণিয়া ভালো থাকে অর্থাৎ অন্যকে দান করার মতো অবস্থায় থাকে। একজন মানুষের দান থেকে একই সঙ্গে সাত থেকে আট জনের জীবন বাঁচতে পারে।
সেটা কী ভাবে? ধরুন, স্ট্রোকের কারণে মৃত্যু হয়েছে যে রোগীর, তাঁর দু’টো কিডনি, একটা লিভার, হার্ট, দু’টো কর্ণিয়া এবং ত্বক, এতগুলো অঙ্গ পাওয়া যেতে পারে। লিভার, কিডনি ও হার্ট প্রতিস্থাপন করলে চার জন সম্পূর্ণ মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসতে পারেন। কর্ণিয়া প্রতিস্থাপন করলে অন্ধ দু’জন পৃথিবীর আলো দেখতে পারেন। আরও দু’জনের চামড়া বা ত্বকের প্রতিস্থাপন হতে পারে।
এর পরের বিষয় হল অঙ্গদাতার খোঁজ। আমাদের দেশে অঙ্গদানের নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম, পদ্ধতি এবং আইন রয়েছে। এই আইনে অঙ্গদাতার পরিবার বা নিকট আত্মীয়ের অনুমতি সাপেক্ষে অঙ্গ নেওয়া যেতে পারে। অথবা, অঙ্গদাতা যদি নিজেই মরণোত্তর অঙ্গদানের সম্মতি দিয়ে যান, তাহলে আইনি প্রক্রিয়াও অনেক সহজ হয়ে যায়।
সুতরাং, আজ ১৩ অগস্ট বিশ্ব অঙ্গদান দিবসের মূল লক্ষ্য দু’টো। প্রথমত, অঙ্গ প্রতিস্থাপন হলে একজনের থেকে যে বহুজন জীবনের আলো নিয়ে বাঁচতে পারেন, সেই বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো। দ্বিতীয়ত, অঙ্গদানের সার্বিক সচেতনতা গড়ে তোলা। সংস্কার এবং শোক ভুলে প্রিয়জনের অঙ্গ দান করার মতো মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে তাঁর পরিবারের সদস্যদেরই। প্রসঙ্গত, বলতে পারি আমাদের রাজ্য অঙ্গদানে অনেক পিছিয়ে আছে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে গত বছর ১০-১২টি অঙ্গদান হয়েছিল। চলতি বছরে সেটা আরও কম। সাকুল্যে ৫-৬টি হবে। সে ক্ষেত্রে তেলঙ্গানা, কেরল, কর্নাটকে অঙ্গদানের নজির অনেক বেশি।
উৎসব-অনুষ্ঠান হোক বা সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয়ে, বাঙালিরা আলোড়িত হন অনেক বেশি। অথচ, যখনই অঙ্গদানের বিষয়টা সামনে আসে, তখনই একটা ভয় বা সংস্কার চেপে বসে মনে। আমার প্রিয়জন বেঁচে থাকবেন আরও পাঁচজনের দেহে, এই উন্মাদনা বা অভিব্যক্তি নিজে থেকে না এলে, অঙ্গদানের সচেতনতা কোনও দিনই গড়ে উঠবে না। প্রচার বা কর্মশালার মাধ্যমে এই সচেতনতা আসার নয়। এটা একটা মানসিক অনুভূতি যার দ্বারা সম্পৃক্ত করতে হবে নিজেদেরই।
(লেখক পেশায় চিকিৎসক, লিভার বিশেষজ্ঞ, লিভার ফাউন্ডেশনের সচিব )