
কোভিড অতিমহামারী যখন ক্রমে স্তিমিত হয়ে আসছে, তখনই দেশ জুড়ে ফের শুরু হয়েছে মন্দির-মসজিদ বিতর্ক (Debate)। বারাণসীর জ্ঞানবাপী মসজিদ বিতর্ক বহু পুরনো। ২০২২ সালে দেখা গেল, সেই বিতর্ক (Debate) নতুন করে চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। গত বছর অগাস্টে পাঁচ মহিলা বারাণসী আদালতে আবেদন করেছেন, জ্ঞানবাপী মসজিদের মধ্যে হিন্দু দেব-দেবীর যে নিদর্শন হয়েছে, সেখানে পুজো করতে দেওয়া হোক।
দেশে হাজার হাজার মন্দির আছে। সেখানেও ওই মহিলারা পুজো-অর্চনা করতে পারতেন। কিন্তু তাঁদের ওই জ্ঞানবাপী মসজিদের মধ্যেই পুজো করতে হবে।
’২১-এর অগাস্টে দেশে কোভিডের দ্বিতীয় ওয়েভ (Debate) ছিল তুঙ্গে। হাজার হাজার লোক মারা যাচ্ছিলেন। হাসপাতালে অক্সিজেনের অভাব দেখা গিয়েছিল। দেশবাসীর সেই দুর্দশার সময় নতুন করে শুরু হয়েছিল জ্ঞানবাপী মামলা।
গত এপ্রিলে সেই মামলায় বারাণসীর আদালত মসজিদ চত্বরে সমীক্ষার নির্দেশ দেয়। তখন থেকেই সংবাদ মাধ্যমে বিষয়টি গুরুত্ব পেতে থাকে। সমীক্ষা নিয়ে মসজিদ কমিটি আপত্তি জানায়। অন্যদিকে হিন্দুত্ববাদীদের এক আইনজীবী দাবি করেন, মসজিদের মধ্যে শিবলিঙ্গ পাওয়া গিয়েছে। মসজিদ কমিটি যদিও বলছে, ওটা আসলে ফোয়ারার মুখ।
এই নিয়ে বিতর্ক যখন জমজমাট, তখনই ফের শোনা গেল, মথুরায় কৃষ্ণ জন্মভূমি ট্রাস্ট নামে এক সংস্থা দাবি করেছে, শাহী ইদগাহ মসজিদ যে জমিতে অবস্থিত, ঠিক সেখানেই শ্রীকৃষ্ণ জন্মেছিলেন। মথুরার জেলা আদালতে ওই জমির মালিকানার দাবিতে মামলা করা হয়েছিল। আদালত মামলাটি গ্রহণ করেছে।
সেই ন’য়ের দশকে রাম জন্মভূমি-বাবরি মসজিদ বিতর্ক যখন তুঙ্গে, তখন গেরুয়াবাদীদের স্লোগান ছিল, ‘ইয়ে তো পহেলা ঝাঁকি হ্যায়, কাশী মথুরা বাকি হ্যায়…।’ অর্থাৎ কয়েক দশক আগে থেকেই হিন্দুত্ববাদীরা স্থির করেছিল, অযোধ্যার পরে কাশী ও মথুরা নিয়ে বিতর্ক তোলা হবে। সেই অনুযায়ী তারা এগচ্ছে।
২০১৯ সালের নভেম্বরে সুপ্রিম কোর্ট অযোধ্যায় রাম জন্মভূমির পক্ষে রায় দেয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তখন বলেছিলেন, ‘এবার আমাদের সব তিক্ততা ভুলে যাওয়া উচিত।’ কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, তিক্ততা বেড়েই চলেছে।
কোভিডের ধাক্কায় অন্যান্য দেশের মতো ভারতের অর্থনীতিও বিপর্যস্ত। কর্মহীন মানুষের সংখ্যা বিগত কয়েক দশকের তুলনায় এখন অনেক বেশি। লক্ষ লক্ষ মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়েছেন। এই অবস্থায় অর্থনৈতিক সংকট থেকে বেরিয়ে আসার পথ খোঁজাই আমাদের মূল কাজ হওয়া উচিত ছিল। তার বদলে শুরু হয়েছে মন্দির-মসজিদ বিতর্ক। এই বিতর্কে যুক্তি বা তথ্যের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে বিশ্বাস।
অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ যেখানে ছিল, ঠিক সেখানটিতেই রাম জন্মেছিলেন, এমন কোনও প্রমাণ নেই। রাম কোনও ঐতিহাসিক চরিত্র নন। তিনি পৌরাণিক চরিত্র। শ্রীকৃষ্ণের ক্ষেত্রেও তা বলা যেতে পারে। তিনি যে শাহী ইদগাহ মসজিদের জমিতেই জন্মেছিলেন, তা কোনওভাবে প্রমাণ করা যাবে না। পুরোটাই বিশ্বাসের ব্যাপার।
একটা কথা বলা যায়, প্রাচীন ও মধ্যযুগে কিছু মন্দির ভাঙা পড়েছিল। শুধু মন্দির নয়, বৌদ্ধ বিহারও ধ্বংস করা হয়েছিল। শুধু ধর্মীয় বিদ্বেষ নয়, মন্দির বা বৌদ্ধ স্তূপ ভাঙার পিছনে অনেক সময় বড় ভূমিকা নিয়েছে রাজনীতি। কিন্তু কয়েকশ বছর পরে সেই অন্যায়ের প্রতিশোধ নেওয়া সম্ভব নয়। সেরকম চেষ্টা করলে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ বাড়বে। বাড়বে হানাহানি।
এমন পরিস্থিতি যাতে না হয়, সেজন্য বড় ভূমিকা পালন করতে হবে আদালতকে। বিশ্বাসের ওপরে যুক্তি ও বাস্তবকে প্রাধান্য দিতে হবে। না হলে ক্রমশ নৈরাজ্যের গর্ভে তলিয়ে যাবে দেশ।
আরও পড়ুন : আজ সিদ্ধান্ত জানায়নি বারাণসীর আদালত, পরশু ফের শুনানি জ্ঞানবাপী মামলার