
দ্য ওয়াল ব্যুরো: সরকারের সমালোচনা করলেই ‘শাস্তি’ পেতে হয় সে দেশে। যে কোনও পরিস্থিতিতে মুখ বুজে থাকাই যেন দস্তুর। কিন্তু এবার সীমা ছাড়িয়েছে অসন্তোষ। বাঁধ ভেঙেছে ধৈর্যের (China Protest)। লাখে লাখে মানুষ পথে নেমে সামিল হয়েছেন বিপ্লবে, বিদ্রোহে। সরকারের চোখে চোখ রেখে চাইছেন শাসকের পদত্যাগ। হাতে হাতে ব্যারিকেড গড়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়াচ্ছেন সরকারি পেয়াদাদের সামনে।
চিনের এমন ছবি শেষ দেখা গিয়েছিল তিন দশক আগে। তিয়েনআনমেন স্কোয়ারে (Tienanmen Square)। এত বছর পরে যেন আবারও ফিরে আসছে সেই স্মৃতি। শাসকের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে নেমেছে দেশের তরুণ তুর্কীর দল। ‘জিরো কোভিড নীতি’র নামে সরকারের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠেছে তারা।

এমনটাই হয়েছিল আটের দশকের শেষ দিকে। সে সময়ে মাও সে তুং-পরবর্তী সময়ে চিনের কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে দুর্নীতির অভিযোগ উঠতে শুরু করে। চিনের স্বৈরতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থাকেও প্রশ্ন করতে শুরু করেছিলেন সাধারণ মানুষ। চেয়েছিলেন আরও বেশি রাজনৈতিক স্বাধীনতা। বিক্ষোভের আঁচ বাড়তে বাড়তে ১৯৮৯ সালের এপ্রিলে গণতান্ত্রিক সংস্কার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, সামাজিক সাম্য, অর্থনৈতিক সংস্কারের দাবি নিয়ে রাস্তায় নামেন কাতারে কাতারে ছাত্র-যুব। একসময়ে বিক্ষোভ দমনে অত্যন্ত কড়া অবস্থান নেয় চিন। ৪ জুন তিয়েনআনমেন স্কোয়ারে ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভে জড়ো হওয়া প্রায় ১০ লক্ষ মানুষের উপর ট্যাঙ্ক দিয়ে নির্বিচারে গুলি চালানো হয়। এই হত্যাকাণ্ডে মৃতের সঠিক সংখ্যা এখনও অজানা। এই ঘটনাই তিয়েনআনমেন স্কোয়ারের গণহত্যা বলে পরিচিত।

সেই ছবিই যেন আবার ফিরে আসতে চলেছে, এই আন্দোলনেও। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যেন সেই একই রকম নৃশংস দমননীতির ছক কষছেন। পুলিশি সংঘর্ষ চলছেই। প্রস্তুত রয়েছে সেনাবাহিনীও। এর মধ্যেই নতুন নতুন শহরে রোজ ছড়িয়ে পড়ছে আন্দোলন।
আজ, সোমবার ভাইরাল হয় বেজিংয়ের একটি ভিডিও ক্লিপ। দেখা যায়, মারমুখী নিরাপত্তাবাহিনীর সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে বিক্ষোভরত এক মহিলা। মুহূর্তের মধ্যে ভাইরাল হয়েছে সেই ভিডিও। দেখা গেছে, বিক্ষোভকারীদের হঠাতে লাঠিচার্জ করছে পুলিশ। আন্দোলনকারীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে তারা। সেই সময় পুলিশের সামনে আচমকা রীতিমতো ‘রণং দেহি’ ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন সাদা জ্যাকেট পরা এক মহিলা। অসীম দৃঢ়তার সামনে মুহূর্তের জন্য থমকে যায় চিনা পুলিশ, ফের তাঁকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেওয়া হয়। এর পরে ওই মহিলাকে ঘিরে ধরে বেধড়ক মারধর করতেও দেখা গিয়েছে ভিডিওয়।
দেখুন সেই ভিডিও।
৩৩ বছর আগে তিয়েনআনমেন স্কোয়ারেও এমনই এক ঘটনা দেখা গিয়েছিল। চিনা ফৌজের ট্যাঙ্কের সামনে সটান দাঁড়াতে দেখা গিয়েছিল এক ব্যক্তিকে। হাতে তাঁর শপিং করার ব্যাগ। ইতিহাসের পাতায় তিনি ট্যাঙ্ক ম্যান বলে পরিচিত। আজ বেজিংয়ের সেই মহিলাও যেন ঠিক সেই ট্যাঙ্ক ম্যান। ইতিমধ্যেই ‘নয়া ট্যাঙ্ক ম্যান’ (New Tank Man) বলেই তিনি ভাইরাল সোশ্যাল মিডিয়ার পাতায়।

শনি ও রবিবার বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছে চিনের একাধিক শহরের রাজপথ। নতুন করে করোনা সংক্রান্ত বিধিনিষেধ আরোপের বিরুদ্ধে সরকার বিরোধী আন্দোলনে সামিল হয়েছেন করোনা ভাইরাসের আঁতুড়ঘর হুনান প্রদেশ-সহ বিভিন্ন এলাকার মানুষজন। তাঁদের দাবি, লকডাউন নয়, কাজ চাই।
এই পরিস্থিতিতে রবিবার সাংহাই থেকে সেই বিক্ষোভের খবর সম্প্রচার করছিলেন বিবিসির সাংবাদিক এড লরেন্স। তাঁকে গ্রেফতার করে হাতকড়া পরিয়ে জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁকে বেশ কয়েক ঘণ্টা থানায় আটকে রেখে লাথি, ঘুষি মারা হয় বলে জানিয়েছে বিবিসি। তাঁদের সাংবাদিকদের সঙ্গে যে ব্যবহার করা হচ্ছে, তাতে তাঁরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন বলে বিবৃতি প্রকাশ করেছেন সংবাদ সংস্থাটির কর্মকর্তারা।
পরে লরেন্সকে ছেড়ে দেওয়া হয় বলে জানা গেছে। তবে চিনের তরফে এই ঘটনার কোনও ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি বা ক্ষমাপ্রার্থনাও করা হয়নি বলে জানানো হয়েছে বিবিসি বিবৃতিতে। সংস্থাটির তরফে আরও জানানো হয়েছে, চিনের দাবি, ভিড়ের মধ্যে ওই সাংবাদিক কোভিডে আক্রান্ত হতে পারেন বলে আশঙ্কা করেই তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। ‘এটাকে আমরা কোনও বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা বলে মনে করছি না,’ দাবি বিবিসির।
উল্লেখ্য, গত এক সপ্তাহ ধরে চিনে ফের হু হু করে বাড়ছে করোনা সংক্রমণ। একটানা পাঁচদিন ধরে প্রতিদিন রেকর্ড সংখ্যক রোগী করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন বলে খবর মিলেছে। এই পরিস্থিতিতে একাধিক শহরে নতুন করে কোভিড বিধিনিষেধ আরোপ এবং আংশিক লকডাউনের পথে হাঁটতে চলেছে সরকার। এতেই খেপেছেন সাধারণ মানুষ। লকডাউনের বিভীষিকায় ফিরতে চান না কেউ। তাই পথে নেমে, স্লোগান তুলে সে কথাই জানাচ্ছেন তাঁরা।

এই বিক্ষোভের আঁচ আরও বেশি উস্কে গেছে, চিনের প্রান্তিক শহর উরুমকিতে একটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায়। সেখানে ১০ জন মানুষ একটি বাড়ির ভিতর পুড়ে মারা গেছেন। স্থানীয়দের দাবি, করোনার বিধিনিষেধকে সামনে রেখে আগুন লাগার পরেও ওই বাড়ি থেকে বেরোতে দেওয়া হয়নি বাসিন্দাদের! তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে সরকার।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চিনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে বিশ্বের প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগীর খোঁজ মেলে। করোনায় প্রথম মৃত্যুর ঘটনাটিও ঘটেছিল চিনে। এর পর খুব দ্রুত বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে এই মারণভাইরাস। বহু মানুষের মৃত্যু হতে থাকে। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে দীর্ঘমেয়াদী লকডাউন, কোয়ারেন্টাইন, ভ্রমণ বিধিনিষেধ শুরু হয় সারা বিশ্বে।

অভিযোগ, এখন পৃথিবীর প্রায় সব দেশ কঠোর করোনা বিধি থেকে সরে এলেও, চিন ‘জিরো কোভিড নীতি’র নাম করে এখনও সেসব জারি রাখছে। ফলে মানুষ স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারছে না, কাজ হারাচ্ছে বহু মানুষ। এসবের মধ্যেই শুরু হয়েছে গণবিক্ষোভ এবং আশঙ্কা বাড়িয়ে আবারও ফিরে এসেছে করোনা সংক্রমণ।
‘২৬/১১ নিয়ে মজা নয়!’ ছাত্রকে কাসভের সঙ্গে তুলনা, মুখের উপর জবাব অধ্যাপককে! দেখুন ভিডিও