
দ্য ওয়াল ব্যুরো: দক্ষিণ ও উত্তর প্যাঙ্গং হ্রদের সংলগ্ন পাহাড়ি এলাকায় আরও বেশি সেনা মোতায়েন করে ও যুদ্ধট্যাঙ্ক বসিয়েই স্বস্তি পায়নি চিনের লাল ফৌজ। নিজেদের মধ্যে চুপিচুপি কথা বলার জন্য আরও এক ধাপ এগিয়ে নতুন বন্দোবস্ত শুরু করেছে তারা। ভারতীয় সেনা সূত্র জানাচ্ছে, পাহাড়ি এলাকায় গোপনে কথাবার্তা বলার জন্য অপটিকাল ফাইবার কেবল বসাতে শুরু করেছে চিনের বাহিনী। প্যাঙ্গং লেকের আশপাশে ছড়িয়ে থাকা লাল সেনার মধ্যে যোগাযোগ রাখতেই এই ব্যবস্থা চিনের।
মস্কোয় সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশনের আলোচনা টেবিলে ভারত ও চিনের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর মুখোমুখি কথাবার্তাতেও বরফ গলেনি। শেষবার চুসুল সীমান্তে দুই দেশের সেনা কম্যান্ডার পর্যায়ের বৈঠকের পরেও প্যাঙ্গং লেক ও সংলগ্ন এলাকা থেকে সেনা সরানো (ডিসএনগেজমেন্ট) ও সেনার সংখ্যা কমানো (ডিএসকেলেশন) কোনওটাই করেনি চিনের সেনা। এখন আবার নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ বাড়াতে ফাইবার কেবল বসাতে শুরু করেছে তারা। ভারতের সেনা সূত্র জানাচ্ছে, এই ধরনের কেবল মারফৎ খুব দ্রুত গোপনে খবর আদানপ্রদান করা যায়। রেডিও যোগাযোগের চেষ্টা করলে তা ধরা পড়বে ভারতীয় সেনার সিস্টেমে। কিন্তু ফাইবার কেবলে সেই ভয় নেই।
দক্ষিণ প্যাঙ্গং লেকের ৭০ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে মুখোমুখি যুদ্ধট্যাঙ্ক সাজিয়ে বসে গেছে ভারত ও চিনের বাহিনী। দক্ষিণে চুসুল, মলডোর কাছে ফের লাল সেনার তৎপরতা লক্ষ্য করা গেছে। প্যাঙ্গং হ্রদের উত্তর সীমায় ৩ নম্বর ফিঙ্গার পয়েন্টের কাছে নতুন করে সামরিক কাঠামো তৈরিতে লেগে পড়েছে লাল ফৌজ। ট্রাকে চাপিয়ে সামরিক সরঞ্জাম নিয়ে এসে মজুত করা হচ্ছে। নতুন উপগ্রহ চিত্রে এমনটাই ধরা পড়েছে।
ভারতীয় সেনা জানাচ্ছে, দক্ষিণ ও উত্তর প্যাঙ্গংয়ের দখল নিতে মরিয়া লাল সেনা। কিন্তু ভারতের দক্ষ স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্সকে টপকে তাদের পক্ষে সেনা নিয়ে এগোনো তেমনভাবে সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থাকা তাদের সেনাদের মধ্যে কথাবার্তা চালানোর জন্য যোগাযোগের তেমন ব্যবস্থাও নেই। কোন এলাকায় সেনা মোতায়েন করতে হবে, কোন পাহাড়ি ঢাল বেয়ে যুদ্ধট্যাঙ্ক নিয়ে যেতে হবে ইত্যাদি খবর লেনদেনের জন্য ফাইবার কেবলের মতো নিরাপদ যোগাযোগের মাধ্যমকেই বেছে নিচ্ছে তারা।
দক্ষিণ প্যাঙ্গং শুধু নয়, উত্তর প্যাঙ্গংয়েও এমন ফাইবার কেবল চোখে পড়েছে ভারতীয় সেনার। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সেনা আধিকারিক বলেছেন, “আমাদের আশঙ্কা হচ্ছে এমন কেবল মারফৎ খুব দ্রুত খবর আদানপ্রদান করতে পারবে তারা। কোন জায়গায় ভারতীয় বাহিনী টহল দিচ্ছে, কোথায় ভারতের সেনার ছাউনি রয়েছে সেই গোপন খবরও পৌঁছে যাবে তাদের কাছে।”
উপগ্রহ চিত্র খুঁটিয়ে দেখে এইসব ফাইবার কেবলের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছে ভারত। প্যাঙ্গং লেকের দক্ষিণ প্রান্ত স্প্যানগুর গ্যাপের পাহাড়ি এলাকাতেও এমন কেবলের অস্তিত্ব চোখে পড়েছে। ১৩ হাজার ৮৬২ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত প্যাঙ্গং সো লেক ভারত, চিন ও তিব্বতের সীমা অবধি বিস্তৃত। উত্তর ও দক্ষিণ ভাগ মিলিয়ে ৬০০ বর্গকিলোমিটারের বেশি এলাকা রয়েছে। হ্রদের উত্তর ভাগে মিশেছে কারাকোরাম পর্বতশ্রেণি। ওই দিকেই রয়েছে ফিঙ্গার পয়েন্ট ৪। প্যাঙ্গং হ্রদের দক্ষিণ ভাগে রয়েছে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থাকা পাহাড় যা ধাপে ধাপে নেমে গেছে স্প্যানগুর লেকের দিকে। এই হ্রদ ও তার সংলগ্ন এলাকার দুই তৃতীয়াংশেই নিজেদের অধিকার ফলাবার চেষ্টা করে চিন যা ভারতীয় সেনার তৎপরতায় রুখে দেওয়া গিয়েছে। ভারতের বাহিনীর শক্তি দেখে তার আগ্রাসনের বাহাদুরি দেখাতে পারছে না। তাই আঁটঘাট বেঁধে একটু একটু করে এগোনোর চেষ্টা করছে। ভারতীয় সেনা সূত্র জানাচ্ছে, উত্তর প্যাঙ্গং লেকের ৩ নম্বর ফিঙ্গার পয়েন্টের কাছে সামরিক কাঠামো তৈরির চেষ্টা করছে চিনের সেনা। অন্যদিকে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা তথা এলএসি বরাবরও সেনার সংখ্যা বাড়াচ্ছে তারা। এমন অবস্থায় রণকৌশল ঠিক করার জন্য তাদের নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ানো দরকার। বিপক্ষের নজর বাঁচিয়ে সেটাই করার চেষ্টা করছে তারা।
গত ২৯-৩০ অগস্ট চিনের বাহিনী যখন কালা টপের দখল নিতে না পেরে ফিরে গিয়েছিল, তার পর পরই উত্তর প্যাঙ্গংয়ের ৪ নম্বর ফিঙ্গার পয়েন্টে সেনার সংখ্যা বাড়িয়েছিল ভারত। এই মূহূর্তে ওই এলাকায় টহল দিচ্ছে গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ পাওয়া ভারতের দুর্ধর্ষ মাউন্টেন ফোর্স স্পেশাল ফ্রন্টিয়ারের কম্যান্ডোরা। লেহ-র কাছেই ভারতের বায়ুসেনা ঘাঁটি আছে। সেখান থেকে সুখোই-৩০এমকেআই, মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান ইতিমধ্যেই উড়ে এসেছে প্যাঙ্গং রেঞ্জে। হ্রদ পেরিয়ে বিপরীতে চুসুল রেজিমেন্টে টি-৯০ ভীষ্ম ট্যাঙ্ক ও টি-৭২ যুদ্ধট্যাঙ্ক তৈরি হয়েই আছে। টি-৯০ ‘ভীষ্ম’ ট্যাঙ্কের ২এ৪৬এম ১২৫ মিলিমিটার ট্যাঙ্ক-গান থেকে ৬০ সেকেন্ডে ৮টি সেল ছোড়া যায়। এর পাল্লা ১০০ মিটার থেকে ৬ কিলোমিটার পর্যন্ত। কাজেই চিনের বাহিনী বাড়াবাড়ি করলে তাদের সামরিক কাঠামো গুঁড়িয়ে দিতে বেশি সময় লাগবে না।
অন্যদিকে, শক্তিশালী অ্যাটাক হেলিকপ্টার অ্যাপাচে এএইচ-৬৪ই, সিএইচ-৪৭ এফ চিনুক মাল্টি-মিশন হেলিকপ্টারও নামিয়েছে বায়ুসেনা। পূর্ব লাদাখের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর কমব্যাট এয়ার পেট্রলিং-এর জন্য নামানো হয়েছে চিনুক কার্গো হেলিকপ্টার, আ্যাপাচে অ্যাটাক হেলিকপ্টার। রাতের বেলা পাহাড়ি এলাকায় নজরদারি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সেই জন্য অ্যাপাচে ও চিনুক কপ্টারকে কাজে লাগানো হয়েছে। চুসুল এলাকায় নজরদারি চালাচ্ছে অ্যাপাচে, অন্যদিকে দৌলত বেগ ওল্ডিতে রাতের বেলা চক্কর কাটছে চিনুক। চিনুকের সঙ্গে চিনা সেনার গতিবিধির উপর নজর রাখছে অ্যাপাচে কপ্টার। এএইচ অ্যাপাচে-৬৪ কপ্টারকে বলা হয় বোয়িং অ্যাপাচে অ্যাটাক কপ্টার। যুদ্ধাস্ত্র বয়ে নিয়ে যেতে পারে আবার নিশানায় আঘাতও করতে পারে।
তাছাড়া সীমান্তে টহল দিচ্ছে ইজরায়েলি সশস্ত্র হেরন ড্রোন। ‘আনম্যানড এরিয়াল ভেহিকল’ (ইউএভি) হেরন টিপি (Eitan) ড্রোনের প্রতিটিতেই অস্ত্র ভরার ব্যবস্থা আছে। দূরপাল্লার এই ড্রোন দিয়ে শত্রু ঘাঁটিতে অনায়াসেই টার্গেট করা যাবে। পাশাপাশি, এর বিশেষ ক্যামেরা যে কোনও আবহাওয়ার পরিস্থিতিতে যে কোনও সময় শত্রু ঘাঁটির ছবি তুলে আনতে পারবে।