
দ্য ওয়াল ব্যুরো: (CAG Report) কী কারণে বালেশ্বর স্টেশন পেরনোর পরেই মালগাড়িতে আছড়ে পড়ল করমণ্ডল এক্সপ্রেস? কী থেকে ওই অভিশপ্ত সন্ধ্যায় শেষ হয়ে গেল ২৮৮-টি প্রাণ? এখন এই প্রশ্নটাই ঘুরপাক খাচ্ছে সব মহলে। রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণো যদিও নানা যুক্তি দিয়ে একটা উত্তর খাড়া করার চেষ্টা করেছেন। বলেছেন, বিস্তারিত তদন্ত হবে। রিপোর্টে কেউ দায়ী প্রমাণিত হলে কাউকে ছাড়া হবে না। নয়াদিল্লির রেল বোর্ডের তরফেও একটা ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। বলা হচ্ছে, লাইন বদলের প্রযুক্তি বা ‘ইলেকট্রনিক ইন্টারলকিং’ ব্যবস্থার ত্রুটিতেই কালান্তক দুর্ঘটনার মুখে পড়ল দুটি যাত্রীবোঝাই ট্রেন।
কিন্তু তাতে কি আর হাহাকার থামে? বালেশ্বরের হাসপাতালে, স্টেশনে, কলকাতায়, খড়্গপুরে এখনও ভেসে উঠছে কান্নার রোল। ট্রাকে, মিনিভ্যানে চাপিয়ে মৃতদেহের পাহাড় সরানো হচ্ছে মর্গ থেকে মর্গে। আহত বহু। ফিরে আসছেন বাড়ি।
এবার বিরোধীদের অভিযোগ, গত বছরের সেপ্টেম্বরেই সংসদে রেলের বেহাল অবস্থা নিয়ে জমা পড়েছিল একটি বিস্তারিত অডিট রিপোর্ট। যা দিয়েছিলেন খোদ দেশের ‘কম্পট্রোলার ও অডিটর জেনারেল’, সংক্ষেপে সিএজি। রেলের পুরো পরিকাঠামো খতিয়ে দেখে দেওয়া সেই রিপোর্টে সিএজির দফতর জানিয়েছিল, বিস্তর খামতি রয়েছে রেলে। ঠিকমত পরিদর্শন হয় না, দুর্ঘটনার পর যথাযথ রিপোর্ট জমা পড়ে না, নতুন লাইন পাতায় অর্থ বরাদ্দ কম, লোকবলও প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়।
প্রায় বিস্ফোরক অভিযোগ তুলে সিএজি রিপোর্টে লেখা ছিল, ‘রেললাইনের গঠনগত অবস্থা, শক্তি, ধারণক্ষমতা, জ্যামিতিক মাপ ইত্যাদি খতিয়ে দেখার জন্য যে ‘ট্র্যাক রেকর্ডিং কারের’ পরিদর্শন চলে, তাতে রীতিমতো ৩০ থেকে ১০০ শতাংশ খামতি আছে।’ রিপোর্ট আরও জানিয়েছে, ‘ট্র্যাক ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম নামক ওয়েব নির্ভর যে ট্র্যাক রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থা রয়েছে, তার পরিদর্শন ব্যবস্থা সঠিকভাবে সক্রিয় নেই’।
২০১৭ সালের এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের মার্চ অবধি হওয়া ৪২২-টি বেলাইনের ঘটনাকে প্রযুক্তিগত বা ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের গাফিলতি বলে ধরা হয়েছে। রিপোর্ট বলছে, এই বেলাইনের ঘটনাগুলোর মধ্যে ১৭১-টি ঘটনাকে ধরা হচ্ছে ‘ট্র্যাক রক্ষণাবেক্ষণ-জনিত কারণে’, ১৫৬-টি ঘটনাকে ধরা হচ্ছে বিপদসীমার বেশি ‘ডেভিয়েশন অফ ট্র্যাক প্যারামিটার’-জনিত কারণে।
‘অপারেশন বিভাগের’ জন্য দুর্ঘটনার সংখ্যা ২৭৫ টি। যার প্রায় ৮৪ শতাংশ হয়েছে পয়েন্টের ভুল সেট করার কারণে বা শান্ট করার সময় ত্রুটির কারণে। শুধু তাই নয়, ৬৩ শতাংশ ক্ষেত্রে ‘অনুসন্ধান রিপোর্ট’ জমাই করা হয়নি। ৪৯ শতাংশ ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, রিপোর্ট গ্রহণে বিলম্ব হয়েছে।
সিএজি রিপোর্টে রেলের ভাঁড়ার ও তার টাকার খরচ নিয়েও কিছু গুরুতর প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। রিপোর্টে দেখা গিয়েছে, ২০১৭-১৮ অর্থবর্ষ থেকে গঠিত ১ লক্ষ কোটি টাকার ‘রাষ্ট্রীয় রেল সুরক্ষা কোষ’ থেকে নানাবিধ গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে খরচে রাশ টানা হয়েছে। ট্র্যাক নতুন করে পাতার ক্ষেত্রে বরাদ্দ রাখা যায়নি। বরাদ্দ হয়ে যাওয়া প্রকল্পেও টাকা পুরোপুরি খরচ করা হয়নি। রাষ্ট্রীয় রেল সুরক্ষা কোষের নির্দেশিকা থাকা সত্ত্বেও রেলে ‘নন প্রায়োরিটি টাস্কে’ খরচ করার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
২০১৭ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ঘটা ১১২৭ টি বেলাইনের ঘটনার মধ্যে ২৮৯-টি ঘটনাই ঘটেছে লাইন নতুন করে না পাতার কারণে। যা মোট ঘটনার প্রায় ২৬ শতাংশ। ‘নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার জন্য যে পরিমাণ লোকবল দরকার রেলের, তার ঘাটতি মেটাতে প্রায় কোনও পদক্ষেপই করা হয়নি’, সিদ্ধান্তে এসেছেন সিএজি।
করমণ্ডল দুর্ঘটনার পর থেকেই মোটের ওপর বিরোধীরা একযোগে নাগাড়ে আক্রমণ শানিয়েছেন নরেন্দ্র মোদী সরকারের ওপর। বারবার অভিযোগ উঠেছে, আত্মপ্রচার ও ভোট টানার কৌশল হিসেবে মোদী সরকার বন্দে ভারত নিয়ে যে পরিমাণ হইচই করেছে, তার ভগ্নাংশ গুরুত্বও সাধারণ ট্রেনগুলো পায়নি। মুখ খুলেছেন প্রাক্তন রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অধীর চৌধুরী, এমনকি লালুপ্রসাদ যাদবও। অভিযোগ, মোদী সরকার বিপুল অর্থ ব্যয়ে বুলেট ট্রেন নামাতে চাইছে, এদিকে সাধারণ লাইনে চলা ট্রেনগুলো ঠিক কী পরিস্থিতিতে চলছে, সেদিকে নজর নেই। কার্যত প্রায় সবক’টি অভিযোগের জায়গায় যেন ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে দেশের শীর্ষ অডিট অধিকর্তার রিপোর্টে।
দশ বছরে আড়াই লক্ষেরও বেশি প্রাণ কেড়েছে রেল-দুর্ঘটনা, বলছে সরকারি পরিসংখ্যান