Latest News

বদ্রুর পায়ের জাদুতে মেতেছিল ভারত, তবুও মিলল না অর্জুন বা পদ্মশ্রী

দেবাশিস সেনগুপ্ত

‘তাঁকে অর্জুন বা পদ্মশ্রী পুরস্কার না দেওয়াটা তাঁর নয়, ভারতবর্ষের লজ্জা হিসেবেই থেকে যাবে’

প্রয়াত প্রাক্তন অলিম্পিয়ান সমর বন্দ্যোপাধ্যায়, ময়দানে যিনি পরিচিত ছিলেন বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায় (Badru Banerjee) নামে। গতরাতে ২টো ১০ মিনিটে এসএসকেএম হাসপাতালে প্রয়াত হয়েছেন তিনি। তাঁর বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। গত এক মাস ধরে তিনি অসুস্থ ছিলেন। বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় বেশ কয়েকদিন ধরেই ভুগছিলেন তিনি। অ্যালজাইমারসও ছিল। তাঁর প্রয়াণে শোকের ছায়া ফুটবল জগতে।এসএসকেএম (SSKM) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। শনিবার রাত ২টো ১০ মিনিট নাগাদ সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ভারতীয় ফুটবলের (Indian Football) এই কিংবদন্তী খেলোয়াড়। ৯২ বছর বয়সি এই প্রাক্তন অলিম্পিয়ানের মৃত্যুতে শোকের ছায়া খেলার জগতে।

১৯৩০ সালে ৩০ জানুয়ারি হাওড়ার বালিতে জন্মগ্রহণ করেন সমর বন্দ্যোপাধ্যায় (Samar Banerjee)। ফুটবল অনুরাগী বাড়ির বারান্দায় প্রায় প্রতি সন্ধ্যাতেই ফুটবল নিয়ে আলোচনা হত। আর পাঁচটা বাঙালির মতো বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায়ও ফুটবল পাগল ছিলেন। তিনি সেই গল্প শুনতেন ছোটবেলা থেকেই। পড়াশোনা নিয়ে তাঁর বাবার ছিল কড়া শাসন। কিন্তু বাবার বকুনি সত্ত্বেও ছোট্ট বদ্রু সেই আলোচনা শুনতেন। আলোচনায় কলকাতার তিন প্রধান – ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান ও মহামেডান স্পোর্টিং ছাড়াও অন্য ক্লাবের কথাও উঠে আসত সেই আলোচনায়। সেগুলো গোগ্রাসে গিলতেন বদ্রু। তাঁর দাদা রাধানাথ বন্দ্যোপাধ্যায় একজন খ্যাতনামা ফুটবলার ছিলেন। কিন্তু অল্পবয়সেই তিনি মারা যান। খেলার মধ্যেই আহত হয়ে তিনি মারা যান। দাদার মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছিলেন বদ্রু। বাড়িতে প্রবল আপত্তি উঠত ছোট ভাইয়ের ফুটবল খেলা নিয়ে। স্কুলের ব্যাগে করে লুকিয়ে বল, বুট নিয়ে গিয়ে সকলের অগোচরে খেলতে হত তাঁকে।

বালি হিন্দু স্পোর্টিং ক্লাব হয়ে বালি ওয়েলিংটন ক্লাব ছুঁয়ে ১৯৪৮ সালে তিনি যান বালি প্রতিভায়, সেখান থেকে বি এন আরে (১৯৪৯-১৯৫১)। আর তারপরে তাঁর স্বপ্নের ৮ বছর কেটেছিল মোহনবাগানে (১৯৫২-১৯৫৯)। এর মধ্যে ১৯৫৮ সালে মোহনবাগানের অধিনায়ক ছিলেন সমর বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর খেলার সময়ে ৪ বার কলকাতা লিগ (১৯৫৪, ১৯৫৫, ১৯৫৬ আর ১৯৫৯), ৩ বার আইএফএ শিল্ড (১৯৫২, ১৯৫৪ আর ১৯৫৬), ২ বার ডুরান্ড কাপ (১৯৫৩ আর ১৯৫৯) ও ১ বার রোভার্স কাপ (১৯৫৫) জিতেছিল মোহনবাগান। ১৯৫৪ ও ১৯৫৬-তে কলকাতা ফুটবল লিগ ও শিল্ড জিতে মোহনবাগানের হয়ে ‘ডবল’ করার কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন তিনি।

১৯৫৮–য় বার্মা শেলের চাকরিতে যোগ দেন তিনি। শিলিগুড়িতে ছিল পোস্টিং। সেখান থেকে এসে প্র্যাকটিস করা বা ম্যাচ খেলা সম্ভব হয়নি বেশিদিন। ১৯৫৯ সালে খেলার বুট জোড়া তুলে রাখেন ছেলেটি, তখন তাঁর বয়েস ২৯ বছর। ফুটবল ছাড়ার পরে বড়িষা এসসি ক্লাবকে কোচিং করান।

তিনি বাংলার হয়ে সন্তোষ ট্রফি খেলেছিলেন ১৯‌৫২ থেকে ‌১৯৫৬ অবধি আর জিতেছিলেন ২ বার (১৯৫৩ ও ১৯৫৫)। আর ১৯৫৬ সালে ২৬ বছর বয়সে তিনি ভারতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক নির্বাচিত হয়েছিলেন গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে। অস্ট্রেলিয়াকে ৪-‌২ গোলে হারিয়ে ভারত সেমিফাইনালে যুগোশ্লাভিয়ার কাছে ১-‌৪ গোলে হেরে যায়। শেষপর্যন্ত তাঁর অধিনায়কত্বে ভারত চতুর্থ হয় ব্রোঞ্জ পদকের ম্যাচে বুলগেরিয়ার কাছে ০-‌৩ গোলে হেরে। তার আগে ১৯৫৪-তে কলম্বো কাপজয়ী ভারত দলেও ছিলেন তিনি। চুণী-পিকে-বলরাম সমৃদ্ধ টিমেও নিজেকে আলাদা করে চেনাতেন সমর বন্দ্যোপাধ্যায়।

১৯৫৫-তে টালিগঞ্জের সিনেনায়িকা তপতী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সমর বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রেম ও বিয়ে, সেই সময়ের এক আলোড়ন ফেলা ঘটনা হিসেবেই আজও বিবেচিত হয়। তাঁদের দীর্ঘ ৫৭ বছরের দাম্পত্য জীবন শেষ হয়েছিল ২০১২ সালে, তপতী বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে। তার কয়েকবছর আগে ছেলেকে হারিয়েছিলেন তাঁরা।

পরবর্তী সময়ে বহু স্বীকৃতি ও সম্মান পেয়েছিলেন সমর বন্দ্যোপাধ্যায়। তার মধ্যে অন্যতম ছিল নিজের ক্লাবের থেকে ২০০৯ সালে ‘মোহনবাগান রত্ন’ সম্মানপ্রাপ্তি। এছাড়া কেন্দ্রীয় ক্রীড়া মন্ত্রকের তরফে অলিম্পিকে অংশগ্রহণকারী ফুটবলারদের দিল্লিতে ডেকে দেওয়া হয়েছিল সংবর্ধনা। রাজ্য সরকারের থেকে পাওয়া ‘জীবনকৃতী’ সম্মানও রয়েছে। ভারতীয় ডাকবিভাগও তাঁর সম্মানে বিশেষ ডাকটিকিট প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু তাঁকে অর্জুন বা পদ্মশ্রী পুরস্কার না দেওয়াটা তাঁর নয়, ভারতবর্ষের লজ্জা হিসেবেই থেকে যাবে।

ভারতীয় ফুটবলের নিয়ামক সংস্থা নিষিদ্ধ হয়ে গেছে, এই অবস্থাটা তাঁকে ভালো করে উপলব্ধি করতে হল না, এটা স্বস্তির কথা।

কোন সন্দেহ নেই, কলকাতা তথা ভারতীয় ফুটবল যতদিন থাকবে, তার একটা বড় অংশ জুড়ে সমর বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন, আছেন, থাকবেন…।

এশিয়া কাপই শেষ সুযোগ, টি ২০ বিশ্বকাপের দল হবে ১৫ জনের

You might also like