
শঙ্খদীপ দাস
রাজ্যসভায় বিমা বিল বা অন্য বিষয়ে পরস্পরের তর্ক ও তির্যক মন্তব্য শুনলে মনে হতো, তাঁদের সম্পর্ক বুঝি অতিশয় তিক্ত। উপর উপর ছবিটা এমনই যে একে অপরের ছায়া দেখলেও যেন তর্ক জুড়ে দিতে পারেন। অথচ ৯ নম্বর অশোক রোডের বৈঠকখানার আড্ডা জানত, অরুণ জেটলি ও পি চিদম্বরমের নিজেদের মধ্যে কেমন বোঝাপড়া ও বন্ধু সম্পর্ক ছিল। রাজনীতি ও আর্থিক নীতির প্রশ্নে শঠে শাঠ্যং, কিন্তু তা ওই পরিধির মধ্যেই সীমিত। ব্যক্তিগত সম্পর্কে সে সবের সংক্রমণ ঘটেনি কখনও।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীতীশ কুমারদের ক্ষেত্রেও তাই। ছ’মাস আগেও ব্লগ লিখে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর দলের ‘সুবিধাবাদী’ রাজনীতির সমালোচনা করেছিলেন অরুণ জেটলি। কিন্তু তৃণমূলের শীর্ষ নেতাদের অনেকেই জানেন, বহু বিষয়ে মমতা-জেটলি কেমন তালমিল করে চলেছেন। রাজনৈতিক বৈরীতা কখনওই ব্যক্তিগত সম্পর্কে আঁচ ফেলেনি। শুধু কি তাই, তৃণমূলে মুকুল রায় যখন কোণঠাসা, তখন বিজেপি-তে তাঁর পুনর্বাসনের নেপথ্যে বন্ধুও তো ছিলেন সেই জেটলি। এমনকী দিল্লির ক্ষমতার অলিন্দে এই কানাঘুসোও রয়েছে, বাংলায় ষোলো সালের ভোটে বাম-কংগ্রেস যখন জোট করতে চলেছে, তার আগে নির্বাসনে থাকা মুকুল রায়কে মমতার সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নাকি নিয়েছিলেন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীই। যাতে তৃণমূলের মধ্যে বিভেদ রুখে বাম-কংগ্রেসের উত্থান ঠেকানো যায়।
আইএনএক্স মিডিয়া মামলায় প্রাক্তন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরমকে গ্রেফতার করতে সিবিআই এবং এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট যখন হন্যে হয়ে ঘুরছে, তখন এই ‘অরুণ জেটলি’ নামটিই ফের প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে বলে অনেকে মনে করছেন।
ঘরোয়া আলোচনায় কংগ্রেসের অনেক নেতাই বলছেন, জেটলি সুস্থ থাকলে হয়তো এই বিপত্তি এড়াতে পারতেন চিদম্বরম। তদন্তের নামে যে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা শুরু হয়েছে, তা কিছুটা হলেও ঠেকানোর চেষ্টা করতে পারতেন তিনি। তাঁদের মতে, বড় কথা হল, চিদম্বরম পালিয়ে যাননি। সিবিআই বা ইডি তাঁকে জেরার জন্য যতবার ডেকেছেন, ততবারই গিয়েছেন তিনি। তা এড়িয়েও যাননি।
প্রাক্তন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির শারীরিক অবস্থা এখন খুবই সঙ্কটজনক। গত ৯ অগস্ট দিল্লির অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সেসে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। এখন লাইফ সাপোর্টে রয়েছেন। গত সাত-আট দিন ধরে তাঁর শারীরিক অবস্থা নিয়ে আর মেডিকেল বুলেটিনও দিচ্ছে না এইমস।
জেটলি-র এহেন শারীরিক অবস্থা নিয়ে শুধু বিজেপি-তে নয়, বিরোধী রাজনীতিতে অনেক বন্ধুরই মন ইদানীং ভারাক্রান্ত। এমন নয় যে কেন্দ্রে বর্তমান মোদী সরকারে তাঁদের (বিরোধী রাজনীতিকদের) জেটলি বিনা বন্ধু একেবারেই নেই। তা আছে। যেমন, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিংহের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। কিন্তু কে না জানে, কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি-তে রাজনাথের কথার এখন কতটা গুরুত্ব রয়েছে! বরং অরুণ জেটলি-র কথার তবু গুরুত্ব ছিল এবং হয়তো এখনও আছে। বহুদিনের যত্নে মোদীর সঙ্গে সম্পর্কের এই ভিত গড়েছেন তিনি। ব্যক্তিগত ভাবে তাঁর কাছে ঋণী নরেন্দ্র মোদী। গুজরাত দাঙ্গার পর থেকে জাতীয় রাজনীতিতে মোদী যখন বারবার আক্রমণের মুখে পড়েছেন, তখন ঢাল হয়েছিলেন জেটলি। ধারাবাহিক ভাবে আইনি পরামর্শও দিয়েছেন। এমনকী ২০০২ সাল থেকে গুজরাতে পর পর তিনটি ভোটে পর্যবেক্ষক হিসাবে হাল ধরে ছিলেন তিনিই।
দিল্লির অনেক প্রবীণ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকের মতে, আসলে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ-র রাজনীতির ঘরানা আর জেটলি-র ঘরানা এক নয়। অটল বিহারী বাজপেয়ী, লালকৃষ্ণ আডবাণীর মতো নেতাদের ছত্রচ্ছায়ায় বেড়ে উঠেছিলেন জেটলি-সুষমারা। অনেক বর্ষীয়াণ কংগ্রেস নেতার মতোই বাজপেয়ী-আডবাণীও ছিলেন রাজনীতিতে উদার। কেন্দ্রে ৬ বছরের বেশি সময় ক্ষমতায় থেকেও বাজপেয়ী কিন্তু কখনওই বফর্স কেলেঙ্কারির তদন্ত নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাননি। সংসদের এথিক্স কমিটির চেয়ারম্যান পদে থাকলেও নারদ কেলেঙ্কারির তদন্তে গত পাঁচ বছরে একবারও মিটিং ডাকেননি আডবাণী। আবার ইউপিএ সরকার পত্তনের পর বাজপেয়ী জমানার প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জর্জ ফার্নান্ডেজের বিরুদ্ধে কফিন কেলেঙ্কারির ফাইল কিন্তু বন্ধ করে দিয়েছিল কংগ্রেসই। জর্জকে ক্লিনচিট দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়।
প্রশ্ন হল, রাজনীতিতে সেই ঘরানা কি তবে অস্তাচলে? তার স্পষ্ট উত্তর পেতে গেলে হয়তো আরও কিছুটা সময় পর্যবেক্ষণ করতে হবে। আপাতত বিজেপি-র উত্তর শোনা যাক। তাঁরা বলছেন, দোষ করলে শাস্তি পেতেই হবে। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে কাউকেই দুর্নীতি আড়াল করতে দেওয়া হবে না।
যদিও এর পাল্টা জবাবও রয়েছে। ইয়েদুরাপ্পা, ব্যাপম কেলেঙ্কারি, ছত্তীসগড়ের প্রাক্তন বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী রমন সিংহের বিরুদ্ধে রেশন কেলেঙ্কারির তদন্তের কী হল তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
তবে সেই চাপানউতোর থাক। বাস্তব হল, সময় খারাপ যাচ্ছে চিদম্বরমের।