
স্থায়ী থেকে অন্তরা-সঞ্চারী হয়ে আভোগে পৌঁছেও এই ক’দিনে তাকে এতটুকু সরতে দেখেনি কেউ। আম বাঙালিতো বটেই জি বাংলার সারেগামার মঞ্চে বছর ১৫র সুমনকে দেখলেই তাই শোনার জন্য বাড়তি আগ্রহ তৈরি হয়ে যাচ্ছে তাবড় বিচারকদেরও। সোনার চামচ মুখে নিয়ে যে জন্মায়নি সুমন, বরং প্রতিদিনের বেঁচে থাকার লড়াইটাও যে এই গানকে পাশে নিয়েই তাও এতদিনে জেনে ফেলেছেন সবাই। বিচারকদের মন জয় করে যত এগোচ্ছে সুমন, ততই যেন তার পাশে পাশে এগোচ্ছে গড়পরতা বাঙালি। কোথায় যেন ছুঁয়ে যাচ্ছে স্বপ্ন ছোঁয়ার অধরা তৃপ্তি।
অথচ এই সে দিনও নাকি বন্ধু মহলে সবাই হাসাহাসি করতো তাকে নিয়ে। বললেই গান করতো, তাই। সহপাঠী, বন্ধু নির্মল সরকারের কথায়, “পড়ার ক্লাস হোক বা খেলার জায়গা কেউ ওকে গান গাইতে বললেই গান গেয়ে উঠতো। তাই আমরা বন্ধুরা খুব হাসতাম।”
পাঁচ হাজার ছেলেমেয়ে সে দিন অডিশান দিচ্ছিল নদিয়ার কৃষ্ণনগরের একটি বেসরকারি হোটেলে। সেখানেই ‘গাও রে নও জওয়ান‘ এর দু কলি গেয়ে তাক লাগিয়েছিল হাঁসখালির হেমাইতপুরের সুমন মজুমদার। তারপর হঠাৎই একদিন জি বাংলার ফ্লোরে ডাক। অন্য রকমের সেই দিনটায় বুকের মধ্যে কে যেন হাতুড়ি দিয়ে জোরে জোরে আঘাত করছিল। এই অনুভূতি সুমনের মা লক্ষ্মী আর বাবা সুশান্তর।
জালালখালির বাজারে ছোট্ট ইলেকট্রিকের দোকান সুমনের বাবা সুশান্তর। চলা আর না চলার মাঝামাঝি অবস্থানে দাঁড়িয়ে। সংসার সামলাতে তাই বিড়ি বাঁধেন মা লক্ষ্মী। বাকি দায়টুকু হাসতে হাসতেই নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল সুমন। গান গাইতে পারতো যে। এখানে সেখানে, জলসায়, মাচায় নিয়মিত গায়ক ছিল সুমন। গান গেয়ে আনা সামান্য টাকা দিয়ে আগলানোর চেষ্টা করতো নুন আনতে পান্তা ফুরোন সংসার।
বাদকুল্লার খামার শিমুলিয়া হাইস্কুলের ক্লাস টেনের ছাত্র সুমন। তবে এক ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়ে তাঁদের অভাবের সংসারে ছেলেকে ছোট থেকে গানের পাঠ দেওয়ার কথা ভাবতে পারেননি বলে আক্ষেপ সুমনের মা লক্ষ্মীর। এমনিই বিভিন্ন জায়গায় গেয়ে বেড়াতো সে। কোথা থেকে গান শিখতো জানতে চাইতেই লক্ষ্মী বললেন, “টিভি দেখে।” বছর দুয়েক ধরে শুভদীপ মজুমদার নামের একজন সঙ্গীত শিক্ষকের কাছে যাতায়াত শুরু করেছে সুমন। ঈশ্বরপ্রদত্ত গলা আরও সমৃদ্ধ হচ্ছে প্রথামাফিক তালিমে। সারেগামার মঞ্চে তারই বিচ্ছুরণ।
এ বার মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে সুমন। জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষা। এখন অবশ্য পাখির চোখ সারেগামা। ফাঁকে ফাঁকেই চলছে স্কুলের টেস্টে বসার প্রস্তুতি। হাত বাড়িয়ে দিয়েছে বন্ধুরা। স্কুলের শিক্ষকরাও। সুমন যে এখন তাঁদেরও গর্ব।