দ্য ওয়াল ব্যুরো: পঞ্চমী থেকেই অন্ধকার নামে আলিপুরদুয়ারের মাঝেরডাবরি চা-বাগানে। হাসিখুশি, প্রাণচঞ্চল লুনিস, সুরভী, গিদাররা শরৎ এলেই কেমন যেন মিইয়ে যায়। কাশফুলের দোলায় মনখারাপের দিন শুরু হয়। ঢাকের বোলে আগমনীর সুর উঠলেই কানে হাত চাপা দেয় সুরভী, “আমাদের পূর্বপুরুষকে হত্যা করেছে গো! দুর্গাপুজো আমরা মানি না।” লুনিস একটু আধুনিক। বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসবের মরসুমে দুর্গাপুজোর নামে কুৎসা রটালে যদি বাবুরা রাগ করেন, তাই একটু সামলে নিয়ে সে বলে, “পুজোর চারদিন আমরা ঘরে বসে শোকপালন করি। এটাই প্রাচীন রীতি। বাপ-দাদারাও করতেন। আমরা যে অসুর গো!”
মাঝেরডাবরি চা-বাগানের কুলি লুনিস অসুর। এখানকার ৭০টি পরিবারের সকলেরই পদবী অসুর। আর অসুর মানেই তারা মহিষাসুরের বংশধর, এমন ধারণাই বদ্ধমূল লুনিস, সুরভী, সুকরামদের মনে। আলিপুরদুয়ার ছাড়াও জলপাইগুড়ির নাগরাকাটা, বানারহাট, চালসাতে এই অসুরদের বাস। নিজেদের অসুর-সম্প্রদায় বলতেই বেশি স্বচ্ছন্দ এরা।
উমার বোধনে গোটা বাংলা যখন মহিষমর্দিনীর উপাসনায় ব্যস্ত, উত্তরবঙ্গের এই জনগোষ্ঠী তখন আড়াল করে রাখে নিজেদের। পরনে ওঠে সাদা থান। বাড়িঘর মুড়ে ফেলে কালো পর্দায়। উৎসবের আনন্দ দূরে ঠেলে যেন একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত হয় উত্তরবঙ্গের সবকটা অসুর-গ্রাম। সেখানে ঢাকের বোল প্রবেশ করতে পারে না। আকাশ-বাতাসে ধ্বনিত হয় বিষাদের সুর। “আগে গ্রামে দুর্গাপুজোর সময় শোকগাথা পাঠ হত। এখন আর এতটা হয় না। তবে আমরা মনেপ্রাণে অসুর,” অনাবিল সহজ, সরলতায় বলে চলল লুনিস। আরও এক অন্য শারদীয়া। ব্যতিক্রমী শারদীয়া। অসুরদের এই উৎসবকে ব্রাত্যই রেখেছে উচ্চবর্ণের সমাজ। লুনিস জানিয়েছেন, এখনও অনেকে এই সংস্কার থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বিব্রত করেন, যুগ বদলে যাওয়ার দোহাই দেন, কিন্তু আমরা আমাদের এই প্রথার প্রতি গর্বিত।

আলিপুরদুয়ারে অসুরদের শোকগাথা
লুপ্তপ্রায় জনজাতি অসুর, ব্যতিক্রমী সংস্কার আঁকড়ে আজও গর্বিত
এই ‘অসুর’ সম্প্রদায় বিহারের একটি জনজাতি। ছোটনাগপুরের মালভূমি অঞ্চল গুল্মা ও লোহারডাঙ্গা জেলায় এদের বসবাস। সেখানে তারা লোহা গলানোর কাজ করতো। মহিষাসুরের সঙ্গে এদের কোনও যোগসূত্র রয়েছে কিনা সেটা এখনও নিশ্চিত করতে পারেননি ইতিহাসবিদরা। তবে মনে করা হয় এরা মূলত অষ্ট্রিক গোষ্ঠীভুক্ত। অষ্ট্রো-এশিয়াটিক ভামাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হলেও বর্তমানে তারা আঞ্চলিক ভাষাতেই কথা বলে থাকে। বর্তমান প্রজন্ম হিন্দি, সাদ্রি ভাষাতেই স্বচ্ছন্দ। জনগণনা-১৯৯১ অনুসারে পশ্চিমবঙ্গে ‘অসুর’ সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা ৪৮৬৪ জন। তার মধ্যে উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, আলিপুরদুয়ারে এদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।

মাঝেরডাবরি চা-বাগানে অসুর জনজাতি
অন্যান্য আদিবাসী সম্প্রদায়ের মতো ‘অসুর’ সম্প্রদায়েরও একাধিক গোত্র রয়েছে। প্রকৃতি, পরিবেশ, জীবজন্তুদের নামে এইসব গোত্রের নাম। যেমন–কাছুয়া (কচ্ছপ), কেরকেটা (পাখি বিশেষ), নাগ (সাপ), শিয়ার (শেয়াল), টিরকি (পাখি বিশেষ), বারোয়া (বন বেড়াল), আইল্ড (পাকাল মাছ), বাসরিয়ার (বেল) এসবই অসুর জনজাতির গোত্র। মহিষাসুরই এদের পূজ্য দেবতা। এদের আর এক গ্রামদেবতার নাম ‘মহাদানিয়া’।
ইতিহাসবিদরা বলেন, ‘অসুর’ সমাজে–অনার্য ভাব যতটা প্রকট, ঠিক ততটাই আর্য–প্রাধান্যও রয়েছে। ধারাবাহিক বিবর্তন ও আত্মীকরনের মধ্যদিয়ে ‘অসুর’ সমাজের একটা বিরাট পরিবর্তন এসেছে। ধর্মের বিভেদও আছে। এই সম্প্রদায় আজও উচ্চবর্ণের কাছে ব্রাত্য। তার উপর মহিষাসুরের পুজো করায় এরা অনেকটাই উপেক্ষিত। বিরল জনজাতির তালিকায় নাম লিখিয়ে ফেলেছে অসুর সম্প্রদায়।
পুরুলিয়া, পূর্ব বর্ধমানে মহিষাসুর ‘হুদুড় দুর্গা’
দশমীতে উমার বিসর্জনের পরেই ধামসা, মাদল, সারিন্দা, করতাল, আড় বাঁশি বেজে ওঠে পূর্ব বর্ধমানের আউশগ্রামে। মহিষাসুর স্মরণ উৎসব ‘দাঁশাই’ পরবে মাতে আউশগ্রামের শুখাগাঙা এলাকার সাঁওতাল নারী-পুরুষরা। এরাও অসুর জনজাতি। দুর্গাপুজো এখানেও ব্রাত্য।
বিজয়াতে একই ছবি দেখা যায় পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে। খেড়ওয়াল জনজাতি সেখানে নিজেদের অসুর বলে ভেবে আসছে শতাব্দী ধরে। নারী উমা নয়, তাদের কাছে দুর্গা হলেন পুরুষ। আশ্চর্য হলেও সত্যি, এই জাতির লোকেরা তাদের আদর্শ মহিষাসুরকেই ‘হুদুড় দুর্গা’ বলে ডাকে।

দাঁশাই পরব পূর্ব বর্ধমানে
লোককথা অনুসারে, একসময় বহিরাগত আর্য শক্তি এই অনার্য আদিম আদিবাসীদের উপর খাঁড়ার মতো নেমে আসে। দৈহিক শক্তিতে আর্যদের হারালেও, বুদ্ধিতে তারা পরাজিত হয়। কথিত আছে, আর্যরা নাকি এই অনার্য জনজাতিকে ভূমি থেকে উচ্ছেদ করতে এক নারীকে প্রেরণ করে। আদিম জনজাতিদের প্রথা অনুযায়ী মহিষাসুর কখনওই নারী বা শিশুর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরবেন না। তাই সেই নারীকে কান্ডারি করে অনার্যদের মহান নেতা মহিষাসুর এবং এখানকার ভূমিপূত্রদের বিরুদ্ধে জয় লাভ করে আর্যরা। ভূমিপুত্র আদিবাসী খেড়ওয়ালরা তাদের ক্ষমতা হারায়, যে দুঃখ আজও তারা মেনে নিতে পারেনি।
ইতিহাসবিদরা এমনও বলেন, গ্রামীণ কৃষিপ্রধান সভ্যতার বাহক অনার্য জাতির কাছে মহিষরূপী মহিষাসুর তাই খুবই আপন। আজও ষষ্ঠী থেকে দশমীর দিন পর্যন্ত খেড়ওয়াল আদিবাসীর (মূলত সাঁওতাল, মুন্ডা প্রভৃতি জাতি) পুরুষরা সেরেঞ বা ভুয়াং হাতে ‘দাঁশাই নাচ’-এর মাধ্যমে নিজেদের আত্মরক্ষার একটা প্রয়াস করে। মহিষাসুরের শোকগাথার মাধ্যমেই তারা প্রমাণ করতে চায় মানুষ হিসেবে তারা কতটা বঞ্চনা ও অবহেলার শিকার। দুর্গাপূজার পনেরো দিন পরেই আদিম অধিবাসীদের দ্বারা পালিত বাঁদনা পরবে গৃহপালিত পশু হিসেবে মহিষের পুজো করা হয়।
দশেরাতে রাবণ পুজো করে ঝাড়খণ্ডের ঘাগরা, চৈনপুর, বিষণপুর
রাঁচি থেকে মোটামুটি ৯০ কিলোমিটার এগোলে গুমলা শহর। তারই কিছু দূরে পাহাড়-জঙ্গলে ঘেরা ঝাড়খণ্ডের ঘাগরা, চৈনপুর, বিষণপুর। দুর্গাপুজো এলেই ঝাড়খণ্ডের এই তিন গ্রাম ডুবে যায় শ্মশানের নৈঃশব্দে। ঘরে ঘরে জানলা-দরজা বন্ধ থাকে পুজোর চার দিন। যাতে আলোর রোশনাই তো দূর, ঢাকের আওয়াজ টুকুও যেন ভুল করে ঢুকে না পড়ে! ‘পূর্বপুরুষ মহিষাসুরের হত্যার উৎসবে কেন সামিল হবো আমরা,’ বেশ ঝাঁঝিয়েই উত্তর দেয় বিমল অসুর। বলে, ‘‘আগে তো নবরাত্রি উৎসবের ন’দিন টানা আমাদের গ্রামে শোকপালন হত। আমরা সাদা থান পরে থাকতাম। মেয়েরা সাদা শাড়ি পরত। এখন সময় পাল্টেছে। সাদা কাপড় পরা বা শোকগাথা পাঠ হয় না। তবে দুর্গাপুজোর সঙ্গে আমাদের কোনও সম্পর্ক নেই।’’

ঝাড়খণ্ডে অসুরদের পরব
শুধু মহিষাসুর বধ নয়, পুজোর পরে ঝাড়খণ্ডের বিষণপুরের অসুররা দশেরায় রাবন বধও মেনে নিতে পারেন না। রামলীলা উৎসবে গিয়ে রাবণের মূর্তি জ্বালানোর বিরোধিতা করেছিলেন বিমল অসুর। মহিষাসুর এবং রাবণই তাঁদের আত্মার আত্মীয়। আরাধ্য দেবতা। গবেষকরা বলেন, এই অসুর জাতি কিন্তু ঝাড়খণ্ডের আদিবাসী নয়। এঁরা মূলত এসেছেন মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তীসগঢ় থেকে। বহু প্রাচীন কাল থেকেই ওঁদের পেশা হল লোহার নানা জিনিস তৈরি করা। দুর্গাপুজোকে তারা কার্যত ‘গণ-বয়কট’ করেছে।
পুরাণ ঘেঁটে অসুর জনজাতির আসল রহস্য, আর্য-অনার্য তত্ত্বের হাল হকিকত বোঝার চেষ্টা করে চলেছেন ইতিহাসবিদ, গবেষকরা। বাংলা জুড়ে অসুর-গ্রামগুলির এই সংস্কারের আসল কারণ কিন্তু আজও রহস্যের ঘেরা। বছর বছর আশ্বিনের শারদপ্রাতে বিষাদের মেঘ জমে অসুরদের ঘরে ঘরে।
‘বাবুদের পুজোর পরেই তো আমাদের পুজো গো!’ চোখে জল, ঢাকের কাঠিতে শারদীয়ার বোল, অন্য পুজো ঢাকি-গ্রামে