Latest News

Xanthippe: কলহপ্রিয় বউ, মাথায় ঠান্ডা জল ঢেলে দিতেই চমকে উঠে কী বলেছিলেন সক্রেটিস ?

দ্য ওয়াল ম্যাগাজিন ব্যুরো: সে অনেককাল আগের কথা। অ্যাটিকা অঞ্চলের সবচেয়ে বড় আর প্রভাবশালী শহর তখন অ্যাথেন্স। প্রাচীন গ্রীসের রাজধানী এই নগররাষ্ট্রেরই বাসিন্দা ছিলেন সক্রেটিস। কে এই সক্রেটিস? পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম সেরা দার্শনিক। জীবদ্দশাতেই তিনি কিংবদন্তি। প্রচলিত ধর্মমতের, ভুলভাল অযৌক্তিক আচার-সংস্কারের ঘোরতর অবিশ্বাসী এই মানুষটাকে নিয়ে তাঁর জীবিতকালেই তৈরি হয়ে গেছিল নানারকম কিংবদন্তি।

Image - Xanthippe: কলহপ্রিয় বউ, মাথায় ঠান্ডা জল ঢেলে দিতেই চমকে উঠে কী বলেছিলেন সক্রেটিস ?

আনুমানিক ৪৭০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ অ্যাথেন্সের সিরকা শহরে এক রাজমিস্ত্রীর ঘরে জন্ম নেন সক্রেটিস। বাবা সফ্রোনিসকাস ছিলেন একজন ভাস্কর, স্থপতি। আর বড়লোকেদের ছেলেমেয়ের দেখভালের কাজ করতেন মা ফায়েনারেত। মধ্যবিত্ত পরিবার, একেবারে স্বচ্ছল বলা না গেলেও, স্বামী স্ত্রী’র মিলিত রোজকারে কোনওভাবে দিন গুজরান হয়ে যেত। অ্যালোপেস নামক রাজনৈতিক অঞ্চলে বেড়ে ওঠায় শৈশব থেকেই রাজনীতির সাথে পরিচয় ঘটে গেছিল সক্রেটিসের। আসলে, সত্যকে জানাই ছিল সক্রেটিসের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। কিন্তু তাঁকে কতটুকু জানি আমরা? সক্রেটিসকে নিয়ে গল্পগাছার বেশিরভাগটাই জনশ্রুতি। তাঁর কতখানি সত্যি, আর কতটা কল্পনা, বলা মুশকিল। শোনা যায়, ভারি রহস্যময় মানুষ ছিলেন সক্রেটিস। তাঁর কাজকম্মোও ছিল সাধারণের বোধবুদ্ধির বাইরে। জীবদ্দশাতেই সক্রেটিস হয়ে উঠেছিলেন আস্ত এক গোলকধাঁধাঁ। এমনকি মৃত্যুর এত বছর পরও তাঁকে নিয়ে বিস্ময়ের ঘোর কাটেনা।

অ্যাথেন্স সুন্দরের দেশ। গ্রিক নারীদের পাশাপাশি গ্রিক পুরুষরাও ছিলেন তাক লাগিয়ে দেওয়া সুন্দর। রূপ নিয়ে চর্চা আর দম্ভ দুইই ছিল অ্যাথেন্সবাসীর। এই সুন্দরের হাটে সক্রেটিস ছিলেন একেবারে বেমানান। এককথায় কুৎসিতই বলা যায় তাঁকে! বেঁটেখাটো চেহারা, কোটরে ঢোকা চোখ, উঁচু চ্যাপ্টা কপাল। নাকটাও ছিল একেবারে বোঁচা। এহেন সক্রেটিসকে সুন্দরী মেয়েরা যে খুব পছন্দ করতেন তা বলা যায় না। একটু বেশি বয়সেই বিয়ে করেন সক্রেটিস। প্রৌঢ় দার্শনিকের বিয়ে হয় সোনালি চুলের এক টগবগে তরুণীর সঙ্গে। সেই তরুণীই জ্যানথিপি। (Xanthippe)

৪৪৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে অ্যাথেন্সের এক বনেদি সম্পদশালী পরিবারে জন্মেছিলেন জ্যানথিপি। জ্যানথস্’ শব্দের অর্থ হলদে বা হালকা বাদামি আর ‘হিপোস’ শব্দের অর্থ ঘোড়া। সোজা মানে করলে জ্যানথিপি শব্দের অর্থ দাঁড়ায় হলদে বা হালকা বাদামি রঙের ঘোড়া। গ্রিকদের নামের সঙ্গে এই ঘোড়ার অনুষঙ্গ সেসময় প্রায়ই নিয়ে আসা হত। ঘোড়ার চেহারায় যে শ্রী আর চরিত্রে যে দার্ঢ়্য আছে, সেটা গ্রিকদের বিশেষ পছন্দের। পুরোনো অ্যাথেন্সের বনেদি পরিবারের মেয়ে জ্যানথিপির নামেও তাই ঘোড়ার অনুসঙ্গ এসেছে স্বাভাবিকভাবেই।

ইতিহাসকারেরা দাবি করেন আগেও একবার বিয়ে হয়েছিল জ্যানথিপির। সেই হিসেবে সক্রেটিস ছিলেন জ্যানথিপির দ্বিতীয় স্বামী। জ্যানথিপির প্রথম স্বামীর নাম জানা যায় না। তবে ইতিহাস বলে, প্রথমপক্ষের একটি সন্তান ছিল তাঁর। এর পর জ্যানথিপির বিয়ে হয় তাঁর থেকে ৪০ বছরের বড় প্রায় বুড়ো দার্শনিক সক্রেটিসের সঙ্গে। সক্রেটিসের বাড়িতে বউ হিসেবে বেশ মোটা বরপণ আর যৌতুক নিয়ে এসেছিল জ্যানথিপি। সঙ্গে এনেছিল বিপুল পরিমাণ টাকাকড়িও।

শোনা যায় ভারি কলহপ্রিয়া ছিলেন জ্যানথিপি। চিৎকার চেঁচামেচিতে বাড়িতে কাক চিল বসত না। আর সক্রেটিস? ঝগরুটে পাড়াকুঁদুলি বউয়ের হাতে নাকাল হতেন কি তিনিও? বিয়ে নিয়ে সক্রেটিসের মনোভাব ছিল ভারি মজার। বউয়ের তর্জনগর্জনকে মোটেই পাত্তা দিতেন না তিনি৷ নিজের ভাবনা আর আড্ডা নিয়েই মশগুল থাকতেন। সহাস্যে বলে বেড়াতেন, “যেমন করেই হোক বিয়েটা সেরে ফেল। যদি তোমার ভাগ্যে ভালো বউ জোটে, তুমি সুখী। আর যদি খারাপ জোটে, তুমি একজন দার্শনিক হয়ে যাবে”।

অন্যদিকে বাউণ্ডুলে, আড্ডাবাজ, অকম্মার ঢেঁকি বরটিকে নিয়েও কম নাকাল হতেন না জ্যানথাপি। বনেদি বাড়ির মেয়ে, তার ভাগ্যেই জুটেছে চালচুলোহীন বুড়ো বর। ঘর সংসারে মন নেই। সামাজিকতার ধার ধারে না। এমন স্বামী নিয়ে কোন মেয়ে আর খুশি হয়! একবার কী কারণে একবার শহরের ধনী বন্ধুদের নিজের বাড়িতে ভোজে ডেকেছিলেন সক্রেটিস। কিন্তু সেখানে যে খাবার পরিবেশন করা হয়েছিল তা একেবারেই মানী লোকের মান রাখার উপযুক্ত নয়। আমন্ত্রিতরা অপমানিত হয়েছিলেন কী না জানিনা, কিন্তু সব দেখেশুনে ভারি রেগে গেছিলেন জ্যানথিপি। স্বামীর বিচক্ষণতার অভাবে হয়তো লজ্জাও পেয়েছিলেন।

Image - Xanthippe: কলহপ্রিয় বউ, মাথায় ঠান্ডা জল ঢেলে দিতেই চমকে উঠে কী বলেছিলেন সক্রেটিস ?
সক্রেটিস ও জ্যানথিপি

আর একবার, তখন বেশ অভাব অনটন যাচ্ছে সক্রেটিসের সংসারে। ঘরে খাবার বাড়ন্ত। বাচ্চারা না খেয়ে আছে। সক্রেটিস অবশ্য যে কে সেই, নির্বিকার। এমন বাউণ্ডুলে বরও কপালে জোটে! রেগেমেগে গালমন্দ শাপশাপান্ত করতে লাগলেন জ্যানথিপি। সক্রেটিস কিন্তু রাগলেন না। রাগি মানুষ তো পশুরও অধম। কিন্তু রাগি বউয়ের দাপাদাপিতে ঘরে টেকাও মুশকিল। কী আর করবেন! চুপচাপ ঘরের বাইরের দিকে চৌকাঠে গিয়ে বসলেন সক্রেটিস। এ সব দেখে রাগে আগুন জ্যানথিপি দিলেন এক বালতি জল স্বামীর মাথার উপর ঢেলে। পথ চলতি পথিকেরা সে দৃশ্য দেখে হো-হো হেসে উঠলো। এবার তাঁদের সঙ্গে সক্রেটিসও হাসতে শুরু করলেন। লোকজন অবাক হল এবার। হাসতে হাসতেই সক্রেটিস দিলেন সেই মোক্ষম জবাব। বললেন, “অবাক হচ্ছেন কেন? এত বজ্রপাতের পর বৃষ্টি তো হবেই”। (Xanthippe)

প্লেটোর মতে, জ্যানথিপি ছিলেন নরম মনের স্নেহবৎসল জননী। সক্রেটিসের সঙ্গে বিয়ের পর ততদিনে তিন তিনটে ছেলে সন্তানের জন্ম দিয়েছেন তরুণী জ্যানথিপি। সক্রেটিসের সেই তিন ছেলে ল্যামপ্রোক্লিস, সোফ্রোনিসকাস ও সেনেক্লেনাস বেড়ে উঠেছে বাবার খানিক ঔদাসিন্য নিয়ে, মূলত মায়ের আদর যত্নেই। 
প্লেটো যাই বলুক, ঈলিয়ান সহ বেশিরভাগের মূল্যায়নেই, জ্যানথিপি ছিলেন ঈর্ষাপরায়ণ আর ঝগড়ুটে মহিলা। তাঁর চরিত্রে সহনশীলতা বেশ কমই ছিল। কোন কোন গল্পে দেখা যায় সক্রেটিসকে তার বউ ঝাড়ুপেটা করছেন আর সক্রেটিস শান্তভাবে বই পড়ে যাচ্ছেন। যেন আশপাশে কিছুই হচ্ছে না। ঈলিয়ান একটি আখ্যানে লিখেছেন, একবার বিখ্যাত কূটনীতিক অ্যালসিবিয়াডেস কী এক কারণে একটা বেশ বড়ো সুন্দর কেক পাঠান সক্রেটিসকে। এম্নিতেই বরের সঙ্গে অ্যালসিবিয়াডেসের ঘনিষ্ঠতাকে খানিকটা সন্দেহের চোখেই দেখতেই জ্যানথিপি। আর সেবার তো ভাগ্যদোষে উপহারের কেকটাও গিয়ে পড়ে জ্যানথিপির হাতে। রাগে ঈর্ষায় আস্ত কেকটাকেই পায়ের তলায় পিষে এক্কেবারে নষ্ট করে দেন তিনি।

Image - Xanthippe: কলহপ্রিয় বউ, মাথায় ঠান্ডা জল ঢেলে দিতেই চমকে উঠে কী বলেছিলেন সক্রেটিস ?
সক্রেটিস ও অ্যালসিবিয়াডেস

সক্রেটিস আর জ্যানথিপির দাম্পত্য নিয়ে টুকরোটাকরা মজার গল্পের শেষ নেই। সক্রেটিসকে একবার তাঁরই শিষ্য-বন্ধু অ্যালসিবিয়াডেস বললেন, “জ্যানথিপির এই ভয়ংকর রাগারাগি সহ্য করেন কী করে!” মাথা নেড়ে সক্রেটিস তাঁকে বলেন, “না, না, এসব আমার অভ্যেস হয়ে গেছে। ঠিক যেমনটি চরকির একটানা খুটখুট শব্দ। কই, তুমিও তো রাজহাঁসেদের প্যাঁকপ্যাঁক ডাকে কিছু মনে করো না। বিরক্ত হও কি!” খানিক অবাক হয়েই অ্যালসিবিয়াডেস বললেন ” হ্যাঁ, আমার পোষা রাজহাঁসেরা একটু ডাকাডাকি করে বটে, কিন্তু ওরা তো আমাকে ডিম আর ছানাপোনার জোগানও দেয়”। “তবেই বোঝ ভায়া, সামান্য ডিমের জন্যও তুমি কত সহ্য করছ, আর জ্যানথিপি আমার সন্তানদের মা!” হাসতে হাসতে সেদিন উত্তর দিয়েছিলেন সক্রেটিস।

জ্যানথিপির তর্ক করার এই স্পিরিটটাই না কি সবচেয়ে বেশি পছন্দ করতেন সক্রেটিস। স্বভাভসিদ্ধ ভঙ্গিতে স্ত্রীকে সমর্থন করতেন তিনি। বলতেন, ‘অনুগত বেচারা প্রাণি আমার দুচক্ষের বিষ।’ তাই যতই কলহপ্রিয়া, দুর্মুখ বলে ঐতিহাসিকরা বদনাম করুন না কেন, এই আপনভোলা দার্শনিকের প্রেরণাদাত্রীও ছিলেন তাঁর তরুণী বধূ। ভয়ে হোক, বা ভক্তিতে জ্যানথিপির সান্নিধ্যে বিয়ের পর আগের তুলনায় অনেক সামাজিক হয়েছিলেন সক্রেটিস। নানান মানুষের সঙ্গে তাঁর এই মেলামেশা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক হয়েছিল। সক্রেটিস নিজেও মানতেন সে কথা, বলতেন, “মানুষের সঙ্গেই আমার কারবার, বাছ-বিচার না করেই মানুষের সঙ্গে আমি মেলামেশা করতে চাই। তাই বউ (জ্যানথিপি)কে একটু বেশিই পছন্দ করি আমি। বেশ ভালোভাবে জানি, যদি তাঁর মর্জি আর মেজাজ সহ্য করতে পারি তাহলে সহজেই প্রত্যেক মানুষের সঙ্গে আমি সংযোগ ঘটাতে পারবো”। 

শুধু দার্শনিকই নন, সক্রেটিস ছিলেন সম্পূর্ণ মুক্ত চিন্তাশীল এক মানুষ। ধর্ম, সমাজ বা রাষ্ট্রযন্ত্রের কোনো কিছুকেই তিনি স্বতঃসিদ্ধ বলে মেনে নেননি৷ এরকম মেধাবি দৃঢ় মানুষেরা যুগে যুগে রাষ্ট্রশক্তির কাছে বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ সক্রেটিসের ক্ষেত্রেও তাই হল। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে অভিযুক্ত করা হল দার্শনিককে।এছাড়াও সক্রেটিসকে তরুণ সম্প্রদায়ের মধ্যে চরিত্রহীনতা ও দুর্নীতি প্রবেশ করানোর অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। মনে রাখতে হবে, দার্শনিকের বয়স বয়স ৭০এর কোঠায়।

তখনকার অ্যাথেন্সে উকিলের ব্যবস্থা ছিল না৷ বিচারক আর অভিযুক্তের কথোপকথনের মধ্যে দিয়েই বিচারের কাজ চলত। সক্রেটিসের ক্ষেত্রে সেই বিচার প্রায় হেঁয়ালিতে পরিণত হয়েছিল। মাত্র ৬০ জন বিচারকের রায়ে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। আপত্তি করেননি সক্রেটিসও। এমনকি বন্দিশালা থেকে পলায়নের সমস্ত সম্ভাব্য পরিকল্পনা তিনি দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। আর নির্লিপ্ত হাতে গলায় ঢেলে দেন বিষাক্ত হেমলক। সক্রেটিসের মৃত্যুর পর জ্যানথিপির প্রতিক্রিয়াই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় দুজনের সম্পর্কের গভীরতা, দেখিয়ে দেয় বাইরে বাইরে যেমনই হোক, মহাজ্ঞানী স্বামীর জন্য ঠিক কতটা আবেগ জমে ছিল আপাত কটুভাষিণী স্ত্রীয়ের বুকে। রায়বাঘিনী ঘরনি নয়, সেই শোকসন্তপ্তা প্রেমিকারূপেই অমলিন হয়ে আছেন জ্যানথিপি।

You might also like