
ন্যায্য মুখরতার নামই নারীবাদ: একটি ‘ছু-মন্তর’ বিষয়ক সংলাপ
মূলধারার ইতিহাসে সেই সময়ের শ্রমিক আন্দোলনের কথা যত সহজে পড়তে পারা যায়, নারী-আন্দোলনের কথা তত সহজে নয়।
শতাব্দী দাশ
–আজ বরং ম্যাজিকের গল্প বলি, শোনো… জাদু… ছু-মন্তর…
–বলো বলো।
–আচ্ছা ধরো, এই যে আমি আছি… আমি যে আদৌ ছিলাম, তা কি আমি যখন থাকব না, তখন প্রমাণ করা যাবে?
–আঁ আঁ মা, থাকবে না কেন?
–আহা, চিরকাল কি মানুষ থাকে?
–যাও, তোমায় গল্প বলতে হবে না।
–চটো কেন? দ্যাখো, এই যে তোমার ইতিহাস বই। যে মানুষ নেই, তার কথা তো তুমি জানতে পারছো সেখান থেকে। কিন্তু সবার কথাই কি জানতে পারছ সমান ভাবে? বলো দেখি, আদিম মানুষ কেমন ছিল? কেমন ছিল তার বিবর্তন?
–সে ছিল প্রায় চারপেয়ে বনমানুষ। এই দ্যাখো, শিরদাঁড়া সোজা হচ্ছে ক্রমে। হচ্ছে, হচ্ছে, হচ্ছে। এই যে, এইবার একে পেলাম– হোমো সেপিয়েন্স। এ ছবি তো সবাই দেখেছে।
–আচ্ছা এই যে হোমো সেপিয়েন্সে বিবর্তন, সেই হোমো সেপিয়েন্স আমার মতো নয় কেন? তোমার মতো নয় কেন? মানে আমি, তুমি, যারা নারী… তাদের মতো কেন নয়? এই যে বনমানুষ থেকে মানুষ হল, ছবিতে সে শুধু পুরুষমানুষ হল কেন?
–তা কেন হবে? মেয়েমানুষের বিবর্তন হয়নি নাকি? নিশ্চয় হয়েছে। ছবি দেয়নি তাদের। কিন্তু হয়েছিল তো বটেই।
–বেশ। কিন্তু বারবার এই ছবি দেখতে দেখতে, ভেবে দ্যাখো, তোমার কল্পনাতেও ডিফল্ট মানুষটি পুরুষ হয়ে গেছে। আর নারী… সে থেকেও অদৃশ্য রয়ে গেছে। আবার, আদিম মানুষ নাকি শিকারি ছিল। এই দ্যাখো, একটা পশুকে ঘিরে ধরে মারছে অনেক পুরুষ। কিন্তু মেয়েরা তখন কোথায় ছিল? এখানেও তো মেয়েদের দেখতে পাচ্ছি না!
–মা, তারাও কি শিকার করত?
–হয়তো তারা সকলে শিকার করত না, আবার হয়ত কেউ কেউ করত। এই নিয়ে এক বিতর্ক ছিল।
–কী রকম?
–১৯৬৬ সালে নৃতত্ত্ববিদদের এক সম্মেলন হয়েছিল শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে। আলোচ্য বিষয় অনুসারে সিম্পোসিয়ামের নাম ছিল, ‘ম্যান দ্য হান্টার’। সেখানে বলা হয়েছিল, এই যে শিকারি প্রজন্মের সাফল্য, তা জৈবিক ও মানসিকভাবে মানুষকে বনমানুষের থেকে আলাদা করল। আর তারপর ধীরে ধীরে মানুষের বিবর্তন হল। আপাতভাবে তো ঠিকঠাকই শোনাচ্ছে, তাই না?
–হুঁ।
–কিন্তু ফেমিনিস্টরা ভারি গোল পাকালেন। তারা বললেন, সম্মেলনে তো এও বলা হয়েছে, শিকার মূলত পুরুষের কাজ ছিল। তা হলে মহিলারা করছিল কী? শিকার্য বস্তু জড়ো করছিল, সংরক্ষণ করছিল? তাই যদি বা করে, তা হলেও, তাদের সেই কাজের কোনও ভূমিকা বিবর্তনে ছিল না? ১৯৭৫ সালে স্যালি স্লোকাম নামে এক নৃতত্ত্ববিদ মহিলা একটা লম্বাচওড়া লেখাই লিখে ফেললেন তা নিয়ে। ‘ওম্যান দ্য গ্যাদারার’।
–আচ্ছা, ‘হান্টার’-এর কাজটি কি তবে ‘গ্যাদারার’-এর কাজের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল?
–সেভাবেই ভাবি আমরা। সেভাবেই ভাবতে শেখানো হয়েছে। সত্যি কি তাই? ভেবে দ্যাখো, শিকারির আচরণ ছিল আক্রমণাত্মক। অন্যদিকে, পালক বা খাদ্য সংগ্রাহকের কাজের প্রকৃতিই এমন যে, তাতে যত্ন, মায়া, ভালবাসার ছোঁয়া থাকতেই হবে। যে মুহূর্তে আমরা আদি প্রজন্মকে ‘শিকারি প্রজন্ম’ বলে অভিহিত করলাম, যে মুহূর্তে সিদ্ধান্তে এলাম, শিকারকার্যে সাফল্যের মধ্যেই আমরা খুঁজে পাব যোগ্যতমের উদবর্তনের ধারা, সংগ্রাহক বা পালকের কাজটিকে ততটা গুরুত্ব দেব না, সেই মুহূর্তে আমরা হয়তো স্থির করলাম, সভ্যতার বিবর্তনে হিংসাত্মক আচরণই ‘ডিফল্ট’ হয়ে উঠবে। ‘সৃষ্টির মনের কথা দ্বেষ’। অথচ ‘হান্টিং’-এর কাজটির সমান গুরুত্ব যদি ‘গ্যাদারিং’ও পেত, তা হলে আমাদের সভ্যতা, সংস্কৃতি, দর্শন যে অন্যরকম হত না, তা-ই বা বলতে পারে কে?
–আচ্ছা, ‘ম্যান’ কথাটা কি জেন্ডার নিউট্রাল?
–বলা মুশকিল। কখনও ‘ম্যান’ বলতে পুরুষ বোঝায়, কখনও ‘ম্যান’ মানে মানুষ। ভাষার গতিপ্রকৃতিই এমন যে, ‘পুরুষ’ আর ‘মানুষ’-এর ধারণা এখানে অবলীলায় মিলেমিশে যায়, আমরা খেয়ালও করি না। যখন বলছি ‘ম্যান ইজ মর্টাল’, তখন আমাকে ধরে নিতে হবে, আমি ‘ম্যান’ বলতে নারীদেরও বোঝাচ্ছি। অথচ যখন বলছি, ‘ফাইট লাইক আ ম্যান’… তখন কিন্তু আমাকে ধরে নিতে হবে, আমি নারীর কথা বলছি না। এবার প্রশ্ন হল, দ্বিতীয় বাক্যে ‘ম্যান’ শব্দটির দ্বারা যদি নারীকে অর্ধচন্দ্র দেওয়া যায়, তা হলে প্রথম বাক্যে একই শব্দে নারীরাও থেকে গেলেন কী করে? উত্তর হল, তাঁরা কোনওমতে থেকে গেলেন হয়তো, কিন্তু রইলেন অস্পষ্ট ছায়া হয়ে। কিংবা অদৃশ্য হয়ে। ছু-মন্তর!
এবার ভাষাকে আরও ভাল করে অবলোকন করো। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুংবাচক শব্দই আদি শব্দ, নারীবাচক শব্দগুলি তার ডেরিভেটিভ মাত্র। নয় কি? যেমন ধরো, ‘নর’ হল মূল শব্দ, ‘নারী’ হল তার ডেরিভেটিভ। যেভাবে বাইবেল মতে, আদমের বুকের হাড় দিয়ে তৈরি হল ইভ, সেভাবেই পুংবাচক শব্দ থেকে নারীবাচক শব্দ তৈরি হয়। ভাষা আকার পায় মানবসমাজের গতিপ্রকৃতি অনুসারে, আবার ভাষার গতিপ্রকৃতিও সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে। ভাষাই মানুষের চিন্তাকে আকার দেয়, চিন্তাকে মুক্ত করে বা বদ্ধ করে। সেই ভাষাও মেরে রেখেছে নারীকে।
–আচ্ছা, এখন খেয়াল করলাম… বিজ্ঞান বইয়েও তো… যখন-যখন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ চিনিয়েছে, সেখানেও তো, মানে, একটা ছেলেরই শরীর। অথচ আমাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তো খানিক আলাদা।
–সে-সব তফাতের কথা আরও বড় হয়ে পড়া যায়। তাও হয়তো ‘জনন’-এর অধ্যায়ে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অধ্যায়ে নয়। তার আগে পর্যন্ত গোপনাঙ্গ ঢাকা পুরুষশরীরই মানবশরীর। তার মানে, এখানেও ম্যাজিক। নারীশরীর… ভ্যানিশ!
–যিনি ছবি আঁকছেন, তিনি হয়তো উলঙ্গ নারীশরীর এঁকে বিতর্ক বাড়াতে চান না।
–হয়তো। কিন্তু উলঙ্গ নারীশরীর এমনকী ছোটদের অ্যানাটমি চেনাতেও ব্যবহার করা যাবে না, এইটা স্থির করছে কে? বিতর্ক হতে পারে, ঠিক। প্রশ্ন হল, হবে কেন? পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা আমরা অনেক গভীরে বহন করি বলেই সে সম্ভাবনা থেকে যায়। উলঙ্গ পুং-শরীর দেখলে শিক্ষক-শিক্ষিকা বা ছাত্র-ছাত্রীর কাম জাগবে না, কিন্তু উলঙ্গ নারীশরীরকে তারা কিছুতেই স্রেফ অ্যানাটমি হিসেবে দেখতে পারবে না, টু-ডি ছবিকেও না! সে সততই যৌনপুত্তলি। সুতরাং তার অদৃশ্য থাকাই ভাল। এ-রকমই ভেবে নেওয়া হচ্ছে না কি? এই দেখার চোখটি কার? পিতৃতন্ত্রের নয়? বাই দ্য ওয়ে, আদি জীববিজ্ঞানী অ্যারিস্টটল কী বলেছিলেন জানো?
–কী?
–বলেছিলেন, ‘The first departure from type is that the offspring should become female instead of male’.
–মানে? আমি স্বাভাবিক নই? আমি ‘ডিপার্চার’?
–হ্যাঁ। বই-এর নাম ছিল, ‘Origin of Animals’.
–ভারী মুশকিল!
–আরও আছে তো। তিনি বলেন, নারীশরীর আসলে বিকৃত বা অস্বাভাবিক পুং-শরীর। যেমন ধরো, ওভারিকে ওভারি-ই বলা হয়নি সপ্তদশ শতকের আগে। বলা হয়েছে স্ত্রী টেস্টিকল।
–সে কী! তার মানে আমি, ‘আমি’ নই। আমি একটা বিকৃতি, একটা অস্বাভাবিকতা?
–কিংবা তুমি মূর্তিমান অভাব। ফ্রয়েডের কথাই ধরো, পৃথিবীর প্রথম মনস্তাত্ত্বিক।
–কী বলেছিলেন তিনি?
–বলতে চেয়েছিলেন, মেয়েদের সিংহভাগ মানসিক রোগ ‘পেনিস এনভি’ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। মানে তোমার যে শিশ্ন নেই, সেই অভাবই তোমার অস্তিত্বকে আকার দিয়েছে। অর্থাৎ এখানেও তুমি, ‘তুমি’ হিসেবে গণ্য নও। তুমি অভাব আর অসম্পূর্ণতা দিয়ে সংজ্ঞায়িত। সাধে কি ‘দ্য সেকেন্ড সেক্স’-এ সিমন দ্য বোভেয়া বলেছিলেন, ‘পুরুষ হল সত্তা আর নারী হল অপর’? তুমি শেক্সপিয়রের বোনের কথা জানো কি?
–শেক্সপিয়রের বোন ছিল নাকি? যাঃ!
–ছিল না। কিংবা হয়তো ছিল। থাকলেই বা জানতে পারছে কে? আসলে আমি বলছি, এক হাইপোথেটিকাল বোনের কথা। ভার্জিনিয়া উল্ফ ‘আ রুম অব ওয়ান্স ওন’ প্রবন্ধে কল্পনা করেছিলেন, যদি শেক্সপিয়রের সময়ে শেক্সপিয়রের সমপ্রতিভাসম্পন্ন কোনও নারী শেক্সপিয়র থাকতেন, তা হলে কী দশা হত তার? তার থেকে কি পাওয়া যেত কালজয়ী নাটক? উত্তর হল, নাঃ। তা কী করে সম্ভব? তার তো নিজস্ব ঘর ছিল না লেখাপড়ার। সে তো হারিয়ে যেতই সংসারের ঘেরাটোপে। শেক্সপিয়রের মতো বাড়ি থেকে পালিয়ে থিয়েটারে আসা হত না তার অভিনেতা বা নাট্যকার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে। কারণ নির্দিষ্ট সময়ে বিয়ে না করলে একঘরে হত তার পরিবার। যদি সে আদৌ বাড়ি থেকে চম্পটও দিত, তা হলেও তার সুরক্ষার প্রশ্ন নিয়ে নিঃসন্দেহ হওয়া যায় না। থিয়েটারের মালিক তাঁকে নাট্যকার নয়, হয়তো সহজলভ্য মন্দমেয়ে হিসেবেই দেখতেন, তাই না? তাই সেই নাট্যকার, সেই কবি, সেই দার্শনিক…
–হয়ে গেছে ভ্যানিশ!
–ঠিক। এমন তো এখনও কতই হয়। সৃষ্টিশীল মহিলারা বলেন, তাঁদের সমাজনির্মিত নারীসত্তার সঙ্গে নাকি শিল্পীসত্তাটির ঠোকাঠুকি চলে দিনরাত।
–হিস্ট্রি তার মানে ‘his story’ শুধু?
–অনেকাংশেই তাই। যেমন ধরো, নারীশিক্ষার প্রসারের পুরোধা হিসেবে বিদ্যাসাগরের কথা তুমি বারবার পড়েছ। সাবিত্রীবাঈ ফুলের কথা কিন্তু পড়তে ঢের দেরি আছে। তাঁর কথা তোমাকে আগ বাড়িয়ে জানানো হবে না। তোমাকেই খোঁজ নিয়ে জেনে নিতে হবে, যদি আগ্রহী হও। অথচ তিনি শুধু প্রথম মেয়েস্কুলটি তৈরিই করেননি, ছিলেন সেই স্কুলের শিক্ষিকাও। বিদ্যাসাগরের মেয়েস্কুলে কিন্তু মেয়ে-শিক্ষিকা রাখা হয়নি। মেয়েরা কাজে বেরোলে সমাজ আরওই বেঁকে বসবে, শিশুকন্যার পড়াশোনার সম্ভাবনা শুরুতেই প্রতিহত করবে অভিভাবক, যাতে সে কাজে না বেরোয়– এভাবে বিদ্যাসাগর ভেবেছিলেন। অথচ সাবিত্রীবাঈ পড়াতে যেতেন সমসময়েই৷ গু-গোবর-ইট-পাটকেল ছোড়া হত। তাও যেতেন। মূলধারার ইতিহাসে তবু জায়গা পাননি। এখন সবে তার মূল্যায়ন শুরু হয়েছে।
একই ভাবে আমরা উনবিংশ শতকের নবজাগরণের কথা পড়ি, অথচ সে অধ্যায় থেকে পণ্ডিতা রমাবাঈ বা তারাবাঈ সিন্ধে ভ্যানিশ! একই কারণে তুমি অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়া মেয়েদের গল্প বিশদে জানতে পারো না। সহিংস আন্দোলনের গল্প পড়ো। সেখানে হয়ত লক্ষ্মী সায়গল বা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের জন্য একলাইন করে বরাদ্দ। কল্পনা দত্ত বা বীণা দাশরাও হয়ে গেছেন অদৃশ্য!
–অথচ আজ নাকি নারী দিবস!
–হ্যাঁ, যতদিন এই ছু-মন্তরের খেলা না শেষ হচ্ছে, ততদিন একটা বিশেষ দিন অন্তত থাকুক, অদৃশ্যদের মনে করার জন্য।
এবার বিজ্ঞানের কথা বলি। এই যে আমরা লিঙ্গ নিয়ে কথা বলছি, ক্রোমোজোমের দ্বারা যে জৈবিক লিঙ্গ নির্ধারিত হয়, তা কে বললেন? আমরা টমাস হান্ট মরগ্যানের নাম পাই। বেশ কথা। কিন্তু যা চেপে যাওয়া হল, তা হল, তিনি প্রভাবিত ছিলেন নেটি স্টিভেন্স নামক এক বিস্মৃত মহিলা গবেষকের মিল-ওয়ার্মদের ওপর করা পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের দ্বারা। চিঠি চালাচালির নিদর্শন মজুত আছে কিন্তু। দেখা যাচ্ছে, মরগ্যান বিশদে স্টিভেন্সের থেকে জানতে চাইছেন তাঁর পরীক্ষা-নিরীক্ষার গতিবিধি। সূর্যের অন্যতম মূল উপাদান যে হাইড্রোজেন, সেই আবিষ্কারের দাবিদার সিসিলিয়া পেইন যতটা না হলেন, তার চেয়ে বেশি করে হলেন তাঁর পুরুষ সুপারভাইজার। ডিএনএ ‘আবিষ্কারের’ কৃতিত্ব পেলেন জেমস ওয়াটসন আর ফ্রান্সিস ক্রিক। অদৃশ্য থেকে গেলেন রোজ্যালিন্ড ফ্র্যাঙ্কলিন, যিনি ছিলেন এঁদের পূর্বসূরি। যিনি এক্স-রে পরীক্ষা ও ইউনিট সেল পরিমাপের মাধ্যমে সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে, ডিএনএ-তে আছে দু’টি চেন ও একটি ফসফেট মেরুদণ্ড।
–এ তো অন্যায়!
–বটেই তো। অন্তত তুমি জেনে রাখো সেই অদৃশ্য মেয়েদের কথা। এবার ধরো যদি নারী দিবসের কথাই বলি… নারী দিবস কোত্থেকে, কীভাবে এল? আসলে প্রথমে এটি নারী দিবস ছিল না। ছিল ‘আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবস’। ‘শ্রমজীবী’ কথাটা কোথায় গেল? গায়েব!
–কীভাবে গায়েব হল?
–তার আগে জানা দরকার দিনটার ইতিহাস। শিল্পবিপ্লবের কথা জানো তো?
–সেই যে সময়ে বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির প্রবল উন্নতির ফলে ইউরোপ আর আমেরিকায় প্রচুর কলকারখানা গড়ে উঠেছিল। উৎপাদন বেড়েছিল। কলকারখানার মালিকরা প্রচুর লাভবান হল, পুঁজিবাদী পৃথিবী সৃষ্টি হল…
–এবং একই সঙ্গে শ্রমিকের ওপর অত্যাচার বাড়ল। আবার সেই কারণেই শ্রমিক আন্দোলনও শুরু হল এই সময়েই। মার্ক্স পুঁজির স্বরূপ নিয়ে লিখতে শুরু করলেন এই সময়েই। কিন্তু সে-সময়ে নারীরা কী করছিল? ধরো, নারীশ্রমিকরা? মূলধারার ইতিহাসে সেই সময়ের শ্রমিক আন্দোলনের কথা যত সহজে পড়তে পারা যায়, নারী-আন্দোলনের কথা তত সহজে নয়।
প্রকৃতপক্ষে এই সময় শুধু পুরুষ শ্রমিকরা আন্দোলন করছিলেন না। আন্দোলন করছিলেন মেয়েরাও। মজুরির বৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন তাঁরাও। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের রাস্তায় নেমেছিলেন সুতো কারখানার হাজার হাজার নারীশ্রমিক। সেই মিছিলে চলে সরকারি লেঠেল আকবাহিনীর দমনপীড়ন। শুনেছিলে সে কথা?
–নাঃ। ভ্যানিশ!
–তাই বটে। সেই সময় আমেরিকার বস্ত্র শিল্পের মোট শ্রমশক্তির ৭০ শতাংশ ছিলেন মহিলা। বেশিরভাগই ছিলেন পরিযায়ী শ্রমিক। বাড়ির সমস্ত কাজ সামলে সপ্তাহে পঁচাত্তর ঘণ্টা অবধি কাজ করতে হত তাঁদের। না, পুরুষ বস্ত্রশ্রমিকদের অবস্থাও খুব ভাল ছিল না। কিন্তু মেয়েদের অবস্থা ছিল তার চেয়েও শোচনীয়। ১৯০৮ সালে ৮ মার্চ ১৫ হাজারেরও বেশি মহিলা শ্রমিক নিউইয়র্কে মিছিল করেন। আবার ১৯০৯-এর ২২ নভেম্বর, ক্লারা লেমলিক নামের এক পরিযায়ী মহিলা ইহুদি শ্রমিক ডাক দেন জেনেরেল স্ট্রাইকের, সেই স্ট্রাইক চলেছিল ১৯১০ সাল পর্যন্ত। সেই ইতিহাসেরই বা কী হল?
–ভ্যানিশ!
–১৯১৭ সালে, রাশিয়ায়, যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে, ফেব্রুয়ারির শেষ রবিবার (পশ্চিমি বা জর্জিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ৮ মার্চ) ‘রুটি এবং শান্তি’-র দাবিতে পথে নামেন রাশিয়ার মেয়েরা। এর চারদিন পর পতন হয় জারের। এই যে রুশ বিপ্লব নিয়ে এত উন্মাদনা, সেই মেয়েদের মিছিলকে মনে রেখেছে ক’জন?
–রাখেনি হয়তো।
–তারও অনেক পরে, ১৯৭৫ সালে ইউনাইটেড নেশন ঘোষণা করে, ৮ মার্চ ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত’ হবে। এবার গায়েব হল ‘শ্রমজীবী’ কথাটি।
–শ্রমজীবী মেয়ে কারা? কারখানার শ্রমিক মেয়েরা? নাকি যে-কোনও কাজ করেন যাঁরা? উপার্জনক্ষম যাঁরা?
–সব মেয়েই আদতে শ্রমজীবী, শুধু পারিশ্রমিক পান কেউ কেউ। অ-দৃশ্যমানতার ভোজবাজি আছে এখানেও।
–কী রকম?
–২০০৯ সালেই ইউনিসেফ জানিয়েছে, এ পৃথিবীর মোট কাজের ৬৬ শতাংশ করেন মেয়েরা। ৫০ শতাংশ খাদ্য উৎপাদন করেন (রান্না নয়, খাদ্য উৎপাদন) তাঁরা, কিন্তু তাঁদের ভাগ্যে জোটে মোট উপার্জনের মোটে ১০ শতাংশ। পৃথিবীর মোট সম্পদের মাত্র ১ শতাংশ মালিকানা রয়েছে তাঁদের হাতে। তা হলে এত শ্রম গেল কোথায়? তার অর্থমূল্য নেই। বুঝলাম। আর কোনও মূল্য? তাও কি আছে?
–ওটাও তবে ভ্যানিশ?
–আসলে, নারীর শ্রম দুই প্রকার। এক, যা পুঁজিবাদী চোখে দৃশ্যমান, যার অর্থমূল্য আছে। আর দুই, যা পুঁজিবাদী চোখে অদৃশ্য, কারণ তার অর্থমূল্য নেই। যেমন জনন, প্রতিপালন, গৃহকর্ম। নারীর চেয়ে বড় শ্রমিক তবে আর কে? রিপোর্ট বলছে, গোটা বিশ্বে বিনিপয়সায় যে শ্রমের যোগান মেয়েরা দেন, তাকে যদি হিসেব করে অর্থের মাপকাঠিতে আনা যায়, তা হলে তার মোট মূল্য গিয়ে দাঁড়ায় বছরে ১০ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার (৭০,১৪,৫৩,০০,০০,০০,০০০ টাকা), যা অ্যাপেল সংস্থাটির বার্ষিক মোট টার্নওভারের ৪৩ গুণ!
–এ তো শ্রমচুরি!
–আরও আছে! ২০১৮ সালের ইউনাইটেড নেশনের অফিস অন ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইমের একটি রিপোর্ট বলছে, বিশ্বে প্রতিদিন গড়ে ১৩৭ জন মহিলা খুন হয়ে যান বাড়ির লোকের হাতেই! মানে খুন বা ধর্ষণের জন্য তাদের বাইরেও বেরোতে হল না, বাড়ির মেয়ে বাড়িতেই হাপিশ!
–এত ছু-মন্তর নেওয়া যাচ্ছে না।
–এখনও তো ভ্রুণহত্যার কথা বলিনি। গ্লোবাল অ্যাভারেজের চেয়ে ভারতে রোজ সাত হাজার মেয়ে কম জন্মায়। কোথায় হারায় তারা? ভ্যানিশ!
মোটামুটি ১০ মিলিয়ন কন্যাভ্রূণ দু’দশকে ভারত থেকে হাপিশ হয়েছে। আর প্রতি ১২ মিলিয়নে ১ মিলিয়ন মেয়ে জন্মালেও তাদের একবছর পূর্ণ হওয়ার আগেই মারা যায় বা তাদের মেরে ফেলা হয়।
তারপর ধরো, আজ যে মেয়ে স্কুলে ভর্তি হল, কাল তাকে খুঁজে নাও পাওয়া যেতে পারে। দাদা বা ভাইয়ের পড়ার খরচ যোগাতে, বিয়ে করে, বা বিয়ে এড়াতে পালাতে গিয়ে কিডন্যাপ হয়ে, পাচার হয়ে, পিরিয়ড শুরু হলে স্কুলে লেডিজ টয়লেটের অভাবে… ড্রপ আউট হয় কত মেয়ে! সব ভ্যানিশ।
–এ-সব শেষ হবে কবে? কীভাবে?
–কবে, তা তো জানি না। কীভাবে, তার কিছু কিছু জানি। যারা হারিয়ে গেছে, তাদের আলোচনায় ফেরাতে হবে। কবর খুঁড়ে তাদের পুনরুদ্ধারের কাজটি সহজ নয়। ইতিহাস লিখতে হবে নতুনভাবে। লেখা হচ্ছেও। তবে আরও কঠিন হল যারা হারায়নি, তাদের হারানো রুখে দেওয়া। দৃশ্যমান হওয়া তোমার অধিকার। আফ্রো-আমেরিকান লেখিকা চিমামন্দা আদিচে এক মজার গল্প বলেন। বলেন, কীভাবে নাইজেরিয়ান সমাজে পুরুষবন্ধুর সঙ্গে রেস্তোরাঁয় গেলে বেয়ারা তাঁকে দেখেও দ্যাখে না। ‘টিপ্স’ তিনি দিলেও, ‘ধন্যবাদ’ জানায় পুরুষটিকেই। তিনি শারীরিকভাবেও ‘অদৃশ্য’ বোধ করেন।
অথচ শুধু শারীরিকভাবে নয়, দৃশ্যমান হতে হবে সভ্যতার মননে, চিন্তনে, দর্শনে। মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে বলতে হবে ‘আছি’। এভাবে কেন্দ্রীয় চরিত্রদের বলতে হয় না। কিন্তু প্রান্তিকদের বলতে হয়, মুখর হতে হয়, কী আর করা!
সেই ন্যায্য মুখরতার নামই নারীবাদ।