Latest News

নাম-বেনাম-গুমনাম: নামে কতটা আসে-যায় মেয়েদের, ভেবে দেখেছি কি কখনও!

নাম নিয়ে তৃতীয় বিশ্বের মেয়েদের এই চূড়ান্ত সংবেদনশীলতার কথা এবং তাদের নাম সংক্রান্ত লাঞ্ছনার কথা তারা নিশ্চয়ই জানে না, যাদের কাজ হল হারিকেন টাইফুন সাইক্লোনের নামকরণ করা।

প্রতিভা সরকার

কথায় বলে, নামে কী আসে যায়, গোলাপকে যে নামেই ডাকো সে গন্ধ বিলোবেই। আদতে কিন্তু নামে খুবই যায় আসে, বিশেষত সেটি যদি হয় মেয়েদের নাম। সে-নামের অপব্যবহার এবং বিকৃতি অন্য ধরনের বিপর্যয় ডেকে নিয়ে আসতে পারে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিটির জীবনে।

আসছি সে কথায়। শুধু শুরুতে বলে নিই, নারী দিবসের প্রাক্কালে মেয়েদের জীবনের বড় বড় সমস্যা নিয়ে অনেক লেখা, অনেক আলোচনা আসবে আমাদের জন্য। তার মধ্যে গার্হস্থ্য হিংসা, যৌন নিপীড়ন, পণ-লাঞ্ছনা, কাজের জায়গায় হেনস্থা, বিনামূল্যের শ্রমদান, আরও অনেক কিছু থাকবে। থাকা স্বাভাবিক এবং উচিত। যা অল্প থাকে, তা হল ছোট ছোট ব্যাপারে মেয়েদের একেবারে শৈশব থেকে অকারণ হেনস্থা। এগুলোই হয়ত বড়বেলার গভীর অপমান ও ব্যাপক নিপীড়নের সূত্রপাত ঘটায়। আমরাই শুধু ঠিক সময়ে খেয়াল করতে পারি না।

যেমন নাম– মেয়েদের নামকরণ এবং সেই নামের যথেচ্ছ বিকৃতি, বিকৃত ব্যাখ্যা এবং তার পরের হেনস্থা।

আশ্চর্য হয়ে দেখি, সুন্দরবন এলাকায় সাংঘাতিক বিপর্যয়ের পরও সাইক্লোন বুলবুলকে নিয়ে নামের কারণে সোশ্যাল মিডিয়ায় হাসিঠাট্টার অন্ত থাকছে না! কেউ কেউ পোস্ট করলেন, “নাচ মেরে বুলবুল পয়সা মিলেগা”, কেউ আবার, “বুলবুলি তুই ফুলশাখাতে দিসনে আজি দোল”। অর্থাৎ সাইক্লোনটির নামকরণ তাদের ভারী ‘হট’ লেগেছে। ওই নাম উচ্চারণেই তারা পুলকিত, রোমাঞ্চিত, তাদের মনশ্চক্ষুতে তখন নৃত্যরত এক চপলা রমণী, যার ছন্দোময় পদঘূর্ণনকে স্বাগত জানানো যায় পয়সা বা নোট ছড়িয়ে।

মানুষ মারা পড়ছে যে বিকট ঝড়ের দাপটে, মাঠভরা সোনার ধান ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, ঘরবাড়ি ভেঙে চাপা পড়ার হাত থেকে বাঁচতে লোকে বাচ্চার হাত ধরে উঁচু বাঁধের দিকে ছুটছে প্রাণপণ, তাকে এইভাবে রোমান্টিসাইজ করা, ফ্যান্টাসিতে মুড়ে দেওয়া খুবই অমানবিক এবং নিষ্ঠুর, এটা বুঝতে খুব বেশি বুদ্ধি লাগে না। কিন্তু তবুও এই রকমটা আকছার হয়ে চলেছে, কারণ মেয়েদেরকে নিয়ে, এমনকী শুধু তাদের নামকে নিয়েও খিল্লি করার মজা অন্য স্তরের।

যাদের আমার কথা বাড়াবাড়ি মনে হবে, তাদের বলব, কিছুদিন আগে একটি বেজায় হিট হিন্দি গানের কথা স্মরণ করতে। কোন ফিল্মের গান মনে নেই, তার বোধহয় দরকারও নেই, কারণ, শুধু শীলা নামটিই গুরুত্বপূর্ণ এই প্রসঙ্গে। শীলা শব্দের অর্থ শীলযুক্ত যে রমণী। অথচ এই নীতিনিষ্ঠ গম্ভীর নাম ব্যবহারের কারণেই গানটি অনেক মানুষের, থুড়ি মেয়েমানুষের জীবনে বিপর্যয় ডেকে এনেছিল।

শীলা কি জওয়ানি গানটির কথা বলছি এটা এতক্ষণ বোঝা গেছে নিশ্চয়ই, যদিও এ-রকম উদাহরণ আরও অনেক আছে। ওই যে শীলা নামের পর জওয়ানি শব্দের ব্যবহার, ওতেই পুরুষ শ্রোতাদের বক্ষমাঝে চিত্ত আত্মহারা হয়ে পড়ে। পাড়ায় পাড়ায় শীলা নামের কোনও যুবতীকে দেখলেই চেঁচিয়ে এ গান গাওয়া প্রায় রেওয়াজে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। শুধু দূর থেকে সুর বা বেসুর ছুড়ে তাকে অপদস্থ করা নয়, কানের গোড়ায় গিয়ে অসভ্যতা এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে, এক শীলা আর সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করে খবরের শিরোনামে উঠে এসেছিল।

উল্টোদিকে জয় জয় শিব শংকর গানের শংকর নামটি অনেক পুরুষের হয়, কিন্তু কখনওই কোনও পুরুষকে তাই নিয়ে ‘টন্ট’ (এই শব্দটা আমাদের কৈশোর-যৌবনে খুব চলত) করা হয়েছে বলে কানে আসেনি। ওই টন্ট ব্যাপারটাও যেন একতরফা। ওটা শুধু মেয়েদেরকেই করা যায়। উল্টোটা হলে সে ভারী লজ্জা, ভারী অশালীনতা হয়।

আসলে, শীলা বা মেয়েদের জওয়ানিপ্রাপ্তি এ-দেশে অশ্লীল। মেয়েরা সবাই সুশীলা। যেহেতু তারা হয় মাতা, নয় কন্যা, তাদের যৌবনোদ্গম চেপেচুপে রাখবার বিষয়, বর্তমান বা ভবিষ্যৎ স্বামীর জন্য লুকিয়ে রাখা সম্ভার। তাই যৌবনের উচ্ছলতা বা সৌন্দর্যময়তা সঙ্গতভাবেই বিদ্রুপের খাদ্য। সিনেমার গানে হলেও তা যদি পুরুষের কল্পনাকে উদ্দীপ্ত করে, তা হলে বাস্তবে সম্পর্করহিত কোনও মেয়েকে তার দ্বারা উত্যক্ত করা জায়েজ। চলতে-ফিরতে তাকে অপদস্থ করা পবিত্র কর্তব্য।

অথচ খোলাখুলি দৈহিক সৌন্দর্যের প্রশংসা মেয়েদের পক্ষে শোনাও অশুচি, অনুচিত। কারণ তা নিতান্তই উচ্ছৃংখলতা বা ভোগেচ্ছার প্রকাশ। কিন্তু দেদার চলতে পারে কর্ণবিদারী সিটি মারা, নাম নিয়ে বেনাম অপমান ছুড়ে দেওয়া। পর্দায় বিস্ফারিত অসাধারণ সুন্দরী নায়িকা ‘ম্যয় তেরে হাথ না আনি’ বলে সহজেই পার পেয়ে যেতে পারে, কিন্তু বাস্তবের শীলা মাথার উকুন। টিপে মারতে এক সেকেন্ড। শহরে কিছু কম হলেও, গ্রাম বা মফস্বলে এই প্রবণতা প্রবল। এগুলোকে আমরাও বড় কোনও হেনস্থা বলে গণ্য করি না। ও-রকম একটু-আধটু হয়েই থাকে, সবাই করে, এই বলে কার্পেটচাপা দিয়ে রাখি।

এমন নয় যে, এই ব্যাপারটি একেবারে হালের আমদানি। চিরকালই পিতৃতন্ত্রের এই বাঁদরামো দেখে এসেছে মেয়েরা। অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির নেত্রী মণিকুন্তলা সেনের আত্মজীবনীতে এ ব্যাপারে খুবই ইন্টারেস্টিং তথ্য মেলে।

জননেত্রী হয়ে বা তার আগেও নামের কারণে তাঁর বিড়ম্বনা ছিল দেখবার মত। অল্পবয়সে তিনি যখন মন্দিরের গাছে জল দিতেন ছেলেরা রাস্তা থেকে চিৎকার করত, শকুন্তলা আলবালে জল সিঞ্চন করিতেছেন।
স্কুলে যাবার সময় ওই ওরাই বাঙাল উচ্চারণে চিৎকার করত, ওই যে দুইডা নামের মাইয়াডা যায়।
কলেজে পড়ার সময় ইংরেজির প্রফেসর নাম ডেকেই বলতেন, মণিকুন্তলা, শকুন্তলা, কপালকুণ্ডলা, আহা কী নামই রেখেছেন!

ফ্যাসিবাদের বিপদ বোঝাতে এক মিটিংয়ে বক্তা হিসেবে তাঁকে যেতে হয়েছিল ঢাকার দয়াগঞ্জে। সর্বত্র বিরোধীরা দেওয়াল লিখন বা পোস্টারে লিখে রেখেছিল, মণিকুন্তলা ফিরে যাও, না হলে কুন্তল কেটে নেওয়া হবে। (সেদিনের কথা, পৃ: ৩০,৬৪)

ব্যক্তিটি মণিকুন্তলা সেন বলেই এত বিস্তারিত বলা। না হলে এ অভিজ্ঞতা মেয়েদের সবারই অল্পবিস্তর আছে।

নামের এই বিড়ম্বনা পিতৃতান্ত্রিক সমাজে কীভাবে মেয়েদের ওপর প্রভাব ফেলে, হালে তা বোঝাল তামিলনাড়ুর কয়েকটি অল্পবয়সী মেয়ে। এরা সবাই ক্লাস সেভেনের ছাত্রী। হস্টেলনিবাসী। একদিন ঘুম ভেঙে উঠে তারা দেখল স্কুলের দেওয়ালজোড়া পাঁচটি লাভ মেসেজ, তাতে তাদের পাঁচ জনেরই নাম জ্বলজ্বল করছে।

কী প্রতিক্রিয়া হওয়া উচিত ছিল? মেয়েগুলি লজ্জায় রাঙা হতে পারত, রাগে দাঁত কিড়িমিড়ি করে ছেলেগুলোকে গাল দিতে পারত, নিদেনপক্ষে টিচারদের বা বাপ-মাকে নালিশ করতে পারত। এর কোনওটাই না করে তারা ইঁদুরমারা বিষ খেয়ে নিল। মৃত্যু সুনিশ্চিত করতে সঙ্গে করবী বা ধুতুরার মাদ্রাজি ভার্সন ‘আরালি’ ফুলের গোটা। হয়তো তাদের মনে হয়েছিল গার্জিয়ান থেকে শুরু করে টিচার, সহপাঠী সবাই তাদের দোষী ঠাউরাবে। সবাইকে ছেড়ে কেন ওদেরই নাম! কেন ওদের সঙ্গেই এমন হয়! তা হলে কি সত্যিই ওরা ‘খারাপ মেয়ে’!

যেন কাউকে ভালবাসতে চাওয়া ভয়ানক অপরাধ আর সে-কথা ঘোষণা করা মানে অপরপক্ষের মাথায় কলঙ্কের বালতি উপুড় করে দেওয়া। এই কলঙ্কের হাত থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় নিজের মৃত্যুদণ্ড বিধান। তাই মেয়েগুলো দিশেহারা হয়ে নিজেদের সততা প্রমাণের জন্য আরালি গোটা গিলে নিল! কী শেখাচ্ছি আমরা মায়েরা আমাদের মেয়েদের!

নাম নিয়ে তৃতীয় বিশ্বের মেয়েদের এই চূড়ান্ত সংবেদনশীলতার কথা এবং তাদের নাম সংক্রান্ত লাঞ্ছনার কথা তারা নিশ্চয়ই জানে না, যাদের কাজ হল হারিকেন টাইফুন সাইক্লোনের নামকরণ করা। না হলে ১৯৫৩-তে আমেরিকান ওয়েদার সার্ভিস কী করে ঝড়ের নাম দেবার জন্য শুধু মেয়েদের নামের এক বর্ণানুক্রমিক তালিকা প্রস্তুত করতে পারে! শ্রুতিমধুরতার কারণে শুধু A থেকে W অব্দি নারীনাম তালিকাভুক্ত হয়, বাদ পড়ে Q U X Y এবং অবধারিত Z.

নারী আন্দোলনকারীদের প্রতিবাদের ফলে পুরুষ-নাম সেই তালিকায় ঢুকল বটে, একচেটিয়া কোনও দেশই এখন আর ঝড়বাদলের নামকরণ করে না, কিন্তু নারী-নাম কি নানা ক্ষেত্রে নানা ঝঞ্ঝাটের সাক্ষী হয়েই রয়ে যাবে! না হলে প্রলয়ঙ্করী ঝড়গুলিকে নীলোফার, তিতলি, বুলবুল, নীলম, মুর্জান, নার্গিস নামে ডাকা এত জটিলতা এবং অশোভন উল্লাসের জন্ম দেয় কী করে!

তলিয়ে দেখতে গেলে প্রচলিত সমাজব্যবস্থায় আমাদের নামই আমাদের ব্যক্তিসত্বার পরিচায়ক, সামাজিক পরিচয়ের প্রথম ধাপ। নাম না থাকলে তখন নম্বর থাকবে শুধু। যেমন থাকে জেলখানা, ডিটেনশন ক্যাম্পে। সেই নামের কারণে এত বিদ্রূপ, মশকরা, হেনস্থা সইতে হবে শুধু মেয়ে বলেই!

You might also like