

জ্যোৎস্না। সাধ করে মা-বাবা এই নামই রেখেছিলেন বড় মেয়ের। মহারাষ্ট্রের নাসিকে এই জ্যোৎস্না এখন পরিচিত নাম। শুধু মহারাষ্ট্র নয়, গোটা দেশেই তাঁকে নিয়ে চর্চা। তাঁর বাড়িতে প্রায় দিনই সাংবাদিকদের ভিড়। সফটওয়্যার ডেভেলপার জ্যোৎস্না (Jyotsna Daund) এখন নাসিকের সফল আঙুর চাষি। তাঁর হাতে সোনা ফলে মাটিতে। চারা পোঁতা, কীটনাশক ছড়ানো থেকে ট্র্যাক্টর চালানো প্রায় সবটাই নিজের হাতে। মরসুমি ফলনের সময় রাত জেগে পাহাড়ার দায়িত্বও তাঁরই কাঁধে। সাধের খামার অন্য লোকের হাতে ছাড়তে মন চায় না যে! কারণ এই খামারের সঙ্গে শুধু স্বপ্ন, পরিশ্রম নয়, জড়িয়ে আছে আরও কিছু।
‘‘আমাদের বাগানের আঙুর খুব মিষ্টি। বাজারে খুব চাহিদা। তাই দিনরাত পরিশ্রম করি। মরসুমের ফলন এখন আগের থেকে অনেক বেড়েছে,’’ পাম্প করে গোটা বাগানে জল দিতে দিতে বললেন জ্যোৎস্না। কম্পিউটার সায়েন্সের কৃতী ছাত্রী থেকে আঙুর চাষির জার্নিটা শুরু হয়ে গিয়েছিল সেই ছেলেবেলাতেই।
একটা দুর্ঘটনা, বদলে যায় জীবন…
নাসিকের লোনওয়াড়ি গ্রামের বিজয় ডান্ডকে চেনেন না এমন লোক কম। বিজয়ের বাগানের আঙুরের তুলনা নেই। তাঁর কাছে নিয়মিত টিপস নিতে আসেন অন্যান্য আঙুর চাষিরা। মহারাষ্ট্রের আঙুর এমনিতেই স্বাদের জন্য গোটা দেশে বিখ্যাত। আর বিজয় ডান্ডের সম্পূর্ণ বিজ্ঞানসম্মত উপায় তাঁর ব্যক্তিগত খামারের চিত্রনাট্যই পুরো পাল্টে দিয়েছেন। ছেলেবেলায় আইনজীবী হতে চেয়েছিলেন, তবে ভাগ্যের ফেরে সেটা আর হয়ে ওঠেনি। আইনের বদলে আঙুর চাষই তাঁর ধ্যানজ্ঞান।
এখন আর অবশ্য তেমন খামারে যাওয়া হয়ে ওঠে না। দুর্ঘটনায় একটা পা পুরোপুরি অকেজো। খামারের হাল ধরেছেন মেয়ে জ্যোৎস্না। ঘরে বসেই মেয়েকে খুঁটিনাটি বুঝিয়ে দেন।
সালটা ১৯৮৮। জ্যোৎস্না তখন ৬। ছোট ভাইয়ের বয়স এক বছর। মেয়েকে ইঞ্জিনিয়ার বানানোর স্বপ্নে বিভোর বিজয় ডান্ডে। নিজে আইনজীবী হতে পারেননি, স্ত্রী লতার ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন ছিল। অভাবে সেটাও হয়নি। কাজেই সব আশা আকাঙ্খা মেয়েকে ঘিরেই জমাট বেঁধেছে। মেয়েও পড়াশোনায় তুখোড়। এই বয়সেই একবার যা শোনে হুবহু মনে রাখতে পারে। দিব্যি চলছিল সব। কিন্তু বাধ সাধল নিয়তি।
একটা দুর্ঘটনায় পা ভাঙলেন বিজয়। চিকিৎসকরা জানালেন, সাত মাসের আগে হাসপাতাল থেকে রেহাই মিলবে না কিছুতেই। মাথায় বাজ ভেঙে পড়ল স্ত্রী লতার। দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে তবে কি পথে বসতে হবে?
ছোট্ট পায়ে মায়ের সঙ্গে প্রথম আঙুর বাগানে (Woman Entrepreneur), বয়স তখন ৬
স্মৃতিতে সবটা ধরা পড়ে না। তবে সেই সাত মাসে যে দুঃস্বপ্নের রাত কাটিয়েছিলেন তাঁরা, এখনও মায়ের মুখ থেকে শুনলে চমকে ওঠেন জ্যোৎস্না। জানিয়েছেন, মায়ের হাত ধরে প্রথম আঙুর বাগানে পা রাখা সেই সময়ে। তার আগে বাগানের দিকে ছেলেমেয়েদের খুব একটা যেতে দিতেন না তাঁদের মা-বাবা। জ্যোৎস্নার কাজ ছিল কচি কচি হাতে মাটিতে পড়ে থাকা শুকনো পাতা তুলে এক জায়গায় জড়ো করা। মা আঙুর পারলে, সেগুলো যত্ন করে ঝুড়িতে সাজিয়ে রাখা। এমন করেই চলে আরও ৬টা বছর।
১২ বছরেই শিখে নিয়েছিলেন (Jyotsna Daund) খামারের কাজ, মা লতা তখন যুদ্ধ লড়ছেন
২০০৪। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছিলেন বিজয়। হাঁটাচলাও শুরু হয়েছিল। তবে ভারী কাজে না করে দিয়েছিলেন ডাক্তাররা। জ্যোৎস্নার মা তখন এক অন্য লড়াই লড়ছেন। একদিকে অসুস্থ স্বামী, অন্যদিকে আঙুরের এত বড় খামার, পাশাপাশি দু’টো ছোট ছোট ছেলেমেয়ে। মায়ের সঙ্গে কোমর বাঁধলেন মেয়ে। বয়স তখন ১১ বছর। কয়েক দিনে বুঝে নিলেন আঙুর চাষের যাবতীয় ধরন। খামারের পরিচর্চার কাজে পটু হয়ে উঠলেন জ্যোৎস্না। স্কুলও চলতে লাগল সমান তালে। তরুণীর কথায়, ‘‘কাকভোরে ঘুম থেকে উঠে খামারে যেতাম। গাছপালার দেখভাল সেরেই স্কুলে ছুটতাম। বিকেলে ফিরে হোমওয়ার্ক শেষ করেই ফের খামারে। গাছগুলো আমার বন্ধু হয়ে উঠেছিল।’’
এই ভাবে কাটল আরও কয়েকটা বছর। সুস্থ হয়ে খামারে যাওয়া শুরু করেছেন বিজয়। পড়াশোনা ও চাষবাস (Woman Entrepreneur) একই সঙ্গে চালাচ্ছেন জ্যোৎস্না। খামারের প্রতিটা আঙুর গাছের সঙ্গে তাঁর তখন এক নিবিড় সখ্য। গাছেদের মন বুঝতে পারেন তিনি। তাদের ভালো লাগা, কষ্ট নিজের মধ্যে অনুভব করেন জ্যোৎস্না। তাই তার হাতেই সোনা ফলতে শুরু করলো খামারে। পাশে বসে অবাক হয়ে দেখতেন বাবা বিজয়। আর মেয়েকে শোনাতেন তাঁর খামারের প্রতিটা গাছের গল্প।
মেঘে ঢাকল সুখের স্বপ্ন…
জ্যোৎস্না তখন বয়ঃসন্ধিতে। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। আবারও ঘনিয়ে এল বিপর্যয়। বৃষ্টি ভেজা মাটিতে পা পিছলে ফের দুর্ঘটনা ঘটালেন বিজয়। পা ভাঙল। ডাক্তাররা সাফ জবাব দিলেন, আর হাঁটাচলা সে ভাবে করতে পারবেন না বিজয়। এবারের ধাক্কাটা বড়ই কঠিন। হাসপাতালের বিছানায় শুয়েই অস্থির হয়ে পড়লেন বিজয়। কারণ ভরা মরসুমে ফলন দারুণ হয়েছে। এই সময় সঠিক পরিচর্চা না করতে পারলে এক বছরের সব পরিশ্রমই বৃথা। বাবার মাথায় হাত রেখে সান্ত্বনা দিলেন জ্যোৎস্না (Jyotsna Daund)।
ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় ও খরচ অনেক। কাজেই কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে বিএসসিতে ভর্তি হলেন। পাশাপাশি চলল আঙুরের চাষ। ‘‘আমি এখনও মনে করতে পারি কী কঠিন সময় ছিল সেটা। বৃষ্টিতে মা বাবাকে দেখতে দিনরাত হাসপাতালে দৌড়োদৌড়ি করছেন। এ দিকে খামারের কাজও পড়ে রয়েছে। বাবা হাসপাতালে শুয়েই আমাকে সার ও কীটনাশকের ব্যবহার বোঝাতেন। বাবার মুখে শুনেই ট্র্যাক্টর চালানো রপ্ত করি,’’ জ্যোৎস্না জানিয়েছেন, পিম্পলগাঁওতে তাঁর কলেজে ছিল বাড়ি থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার। দু’বার বাস পাল্টে, আরও ২ কিলোমিটার হেঁটে কলেজে যেতে হত। তরুণীর কথায়, ‘‘ভোরে উঠে বাগান দেখতাম। তারপর কলেজ। ফিরে পড়াশোনা সেরে সন্ধে বেলা ফের খামারের কাজ। রাতে প্রায় দিনই এখানে বিদ্যুৎ থাকত না। তাই সারা রাত জেগে পাম্প করে জল তুলে গাছে দিতাম।’’
আরও পড়ুন: Empowered Woman IPS: সংযুক্তার ‘মর্দানি’, এই মহিলা আইপিএসের নামে থরথর করে কাঁপে জঙ্গিরা
শুরু হলো স্বপ্নের উড়ান, সফটওয়্যার ডেভেলপার এখন আঙুর চাষি (Woman Entrepreneur)
কলেজ থেকে ক্যাম্পাস ইন্টারভিউতে একটি নামী সংস্থায় সফটওয়্যার ডেভেলপারের চাকরি পান জ্যোৎস্না। ভালো পদ, মোটা মাইনে। জীবন গতি নেয় অন্যদিকে। জ্যোৎস্নার কথায়, ‘‘অফিসে গোটা দিনটাই কেটে যেত। বাড়ি ফিরে আর খামারের কাজ করতে পারতাম না। কিন্তু এই খামার ছিল আমাদের পরিবারের মতো। গাছগুলো আমার বন্ধু। তাদের হাতছানি ছিল দুরন্ত।’’
২০১৭ সাল। চাকরি ছেড়ে পাকাপাকি আঙুর চাষে (Woman Entrepreneur) মন দিলেন জ্যোৎস্না। সংসার খরচ তুলতে এলাকারই একটি স্কুলের তিনি তখন কম্পিউটারের দিদিমনি। স্কুলের সময়টুকু বাদ দিলে সারাক্ষণ খামারেই দেখা যেত জ্যোৎস্নাকে। জানিয়েছেন, যে গাছে একটি থোকায় ১৫-১৭টা আঙুর হতো, সেখানে এখন ২৫-২০টা করে ফলন হয়।
গাছ লাগানোর ১২-১৩ মাসের মাথায় ফলন শুরু হয়। প্রথম বছর ফলন খুব একটা বেশি হয় না। তবে যত্ন নিলে প্রতি বছর ফলন কয়েক গুণ করে বাড়ে। জল দেওয়ার পদ্ধতিটি বৈজ্ঞানিক। এখানে সরু পাইপের মাধ্যমে বিন্দু বিন্দু করে গাছগুলিতে জল দিতে হয় (ড্রিপ ইরিগেশন)। এ ছাড়া নিয়মিত সার, হরমোন প্রয়োগ করতে হয় ও গাছের ডাল ছাঁটতে হয়। জ্যোৎস্নার কথায়, ‘‘গাছেদের যদি আপন ভেবে যত্ন করা হয়, তাহলে তারা কথা বলে। নিয়মিত তাদের যত্ন করতে হয় ঠিক সন্তানের মতো। ভালোবাসা পেলে তারাও জবাব দেয় সে ভাবেই। মিষ্টি আঙুরগুলোই তাদের ফিরিয়ে দেওয়া ভালোবাসা।’’
২০১৮ সালে ‘কৃষিথন বেস্ট ওম্যান অ্যাওয়ার্ড’ (Woman Entrepreneur) পেয়েছেন জ্যোৎস্না। এখন তিনি নাসিকের নাম করা আঙুর চাষি। বাড়ির খামারের আয়তন বেড়েছে। বেড়েছে তার গাছ-বন্ধুদের সংখ্যাও। তাদের মাঝে দাঁড়িয়েই ভবিষ্যতের এখন স্বপ্ন দেখেন জ্যোৎস্না।