
রূপাঞ্জন গোস্বামী
বিজ্ঞানী উইলিয়াম গিলবার্ট ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে বলেছিলেন, পৃথিবীকে ঘিরে আছে এক শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র (magnetic field)। পরবর্তীকালে বিজ্ঞানীরা অনুমান করেছিলেন, সেই চৌম্বক ক্ষেত্রে চৌম্বকীয় ঝড়ের কারণে আটকে থাকতে পারে বিপুল পরিমাণ তেজস্ক্রিয় কণা। কথাটির সত্যতা প্রমাণ হয়েছিল ১৯৫৮ সালে। আইওয়া ইউনিভার্সিটির মহাকাশ বিজ্ঞানী জেমস ভ্যান, আবিষ্কার করেছিলেন পৃথিবীকে ঘিরে থাকা দুটি অতি উচ্চ ক্ষমতাশালী তেজস্ক্রিয় বলয়। যেগুলির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ভ্যান অ্যালেন বেল্ট‘ (van allen belt)। যে বলয় দুটি সৌর ঝড়কে আটকে দিয়ে পৃথিবীর আবহাওয়ামণ্ডলকে রক্ষা করে।

পরবর্তীকালে ভ্যান অ্যালেন বেল্ট নিয়ে গবেষণা চালাতে গিয়ে চমকে উঠেছিলেন নাসার (NASA) বিজ্ঞানীরা। তাঁরা দেখেছিলেন, শক্তিশালী ভ্যান অ্যালেন বেল্ট অবিশ্বাস্য প্রভাব ফেলেছে পৃথিবীর মাত্র তিনটি স্থানের ওপর। এই তিনটি স্থান হল পেরুর মাচু পিচ্চু (Machu Picchu), ইংল্যান্ডের প্রাগৈতিহাসিক মনুমেন্ট স্টোনহেঞ্জ (Stonehenge) ও ভারতবর্ষের উত্তরাখণ্ডের কুমায়ুনে (Kumaon) অঞ্চলে থাকা একটি গিরিশিরা। যে গিরিশিরায় আছে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে নির্মিত মা দুর্গার অবতার কাসার দেবীর মন্দির (Kasar Devi temple)।
কাশ্যপ পাহাড়ের কাসার দেবী
কাঠগুদাম স্টেশন বা পন্থনগর বিমানবন্দর থেকে গাড়িতে আলমোড়া এসে, ধরতে হবে আলমোড়া-বাগেশ্বর হাইওয়ে। ১৪ কিলোমিটার যাওয়ার পর এগিয়ে আসবে ‘কাসার দেবী‘ (Kasar Devi) গ্রাম। হাইওয়ে ছেড়ে এগিয়ে যেতে হবে গিরিশিরা ধরে একটি পাহাড়ের চূড়ার। পাহাড়টির নাম কাশ্যপ হলেও, পাহাড়টি বিখ্যাত ক্রাঙ্ক’স হিল (Crank’s Ridge) বা হিপি হিল (Hippie Hill)নামে। কারণ ১৯৬০ থেকে প্রায় দেড় দশক ধরে, শান্তির সন্ধানে এই অঞ্চলে আসতে শুরু করেছিল হিপিরা। গিরিশিরার অরণ্যে তাঁবু ফেলে থাকত মাসের পর মাস।

গিরিশিরার শেষ প্রান্তে আসার আগেই দূর থেকে দেখা দেবে, পাইন ও দেবদারু গাছে ঘেরা থাকা একটি মন্দির কমপ্লেক্স। প্রায় ৮৬০০ ফুট উচ্চতায় থাকা এই মন্দির কমপ্লেক্সেই আছে কুমায়ুন পাহাড়ের জাগ্রত দুর্গা কাসার দেবী। যে মন্দিরের গর্ভগৃহ হল একটি গুহা। যে গুহায় বিরাজ করছে সিংহবাহিনী অষ্টভূজা মাতা কাসার দেবীর মর্মর মূর্তি। গর্ভগৃহে আছে ‘অখণ্ড জ্যোতি‘। কবে থেকে আগুন জ্বলছে কারও জানা নেই। এছাড়া কাসার মায়ের মন্দিরে আছে পবিত্র হোমকুণ্ড। যে কুণ্ডে কাঠ জ্বলে চব্বিশ ঘণ্টা। কুণ্ডের ছাই নাকি মানসিক রোগের মহৈষধ।

কাসার দেবী গ্রাম ও আশেপাশে থাকা গ্রামগুলির বাসিন্দারা বিশ্বাস করেন, কাসার মাতা রক্ষা করেন এলাকার জীবকূল। তাঁরই লীলায় গ্রামবাসীদের স্পর্শ করতে পারেনা বিষণ্ণতা। মন থাকে সদা প্রফুল্ল। স্থানীয় লোকেদের বিশ্বাস, প্রতি কার্তিক পুর্ণিমায় গ্রামে ঘুরে বেড়ান কাসার দেবী। গ্রামের রাস্তা থেকে ভেসে আসে তাঁর নুপুরের আওয়াজ। তাই কার্তিক পুর্ণিমার পবিত্র তিথিতে মন্দির প্রাঙ্গণে বসে কাসার মায়ের মেলা। মন্দির থেকে এক কিলোমিটার দূরেই আছে ১০৮ শক্তিপীঠের অন্যতম পিঠ কালীমাঠ। যে পীঠে দেবী কালিকার সঙ্গে পূজিত হন লক্ষ্মী ও সরস্বতী।

কাসার দেবীর মন্দিরে পা রাখা মাত্রই, হাতছানি দিয়ে ডাকবে তুষারমৌলি হিমালয়। চোখ ক্যামেরায় ধরা পড়বে শিবলিং, পঞ্চচুল্লি, নন্দাদেবী, ত্রিশুল, চৌখাম্বা ও আরও কত চেনা অচেনা শৃঙ্গের দল। তাই কাসার দেবী থেকে সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয় দেখার অভিজ্ঞতা হারাতে চান না কেউই। এছাড়া মন্দির প্রাঙ্গণ থেকে দেখা যায় আলমোড়া ও হাওয়ালবাগ উপত্যকার নয়নাভিরাম নৈসর্গিক দৃশ্য।

বিশ্বে পরিচিত করেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ
কাসার দেবীকে বিশ্বের দরবারে প্রথম চিনিয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। ১৮৯০ সালে তিনি এসেছিলেন কাসার দেবী মন্দিরে। ধ্যানমগ্ন হয়ে থাকতেন মন্দিরের কাছে থাকা একটি গুহায়। কাসার দেবীর মায়াবী পরিবেশ স্বামীজিকে দিয়েছিল গভীর প্রশান্তি। যা তিনি লিখেও গিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে এই মন্দিরে এসেছিলেন বিশ্বের নানা দেশের শিক্ষাবিদ, মনস্তাত্ত্বিক, রহস্যপ্রেমী, গবেষক, দার্শনিক, সাহিত্যিক ও চিত্রশিল্পীরা।
এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ (Rabindranath Tagore), রবিশঙ্কর, উদয়শঙ্কর, বব ডিলন (Bob Dylan), জর্জ হ্যারিসন (George Harrison),ক্যাট স্টিভেন্স (Cat Stevens) লেখক ডি এইচ লরেন্স (D. H. Lawrence), আনন্দময়ী মা (Anandamayi Ma) সহ কত বিশ্ববরেণ্য মানুষেরা। এঁদের মধ্যে অনেকেই বলেছিলেন, গিরিশিরার আদিম অনাঘ্রাত পরিবেশ, তাঁদের মনের সব চিন্তা দূর করে দিয়েছিল। অফুরান আনন্দ ও শান্তি ঘিরে ধরেছিল তাঁদের অশান্ত মনকে।

এসেছিলেন নাসার বিজ্ঞানীরাও
কাসার মায়ের মন্দিরে এসেছিলেন নাসার বিজ্ঞানীরাও। ২০১৩ সালে পুরো গিরিশিরাটি জুড়ে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়েছিলেন তাঁরা (সূত্রঃ timesofindia.indiatimes.com)। প্রমাণ হয়েছিল সত্যিই কাসার দেবীর মন্দির ও আশেপাশের এলাকা প্রচণ্ড শক্তিশালী এক ভূচৌম্বকীয় ক্ষেত্রের মধ্যে অবস্থিত। যার সঙ্গে যোগাযোগ আছে পৃথিবীকে ঘিরে থাকা ভ্যান অ্যালেন বেল্টের। বিজ্ঞানীরা স্থানীয় মানুষের ওপর এই ভূচৌম্বকীয় শক্তির প্রভাব নিয়ে গবেষণা শুরু করেছিলেন। সে গবেষণা আজও চলছে। এক যুগান্তকারী ফলাফলের অপেক্ষায় আছে বিশ্ব।
পুরান ও ঊপনিষদ বহুকাল আগে থেকেই বলে এসেছে, প্রকৃতি মায়ের বুক থেকে উৎসারিত শক্তি কীভাবে মানুষের মনের ক্ষত সারায়। উৎসাহীরা তাই এখন কাসার দেবীর ভূচৌম্বক ক্ষেত্রের সঙ্গে সনাতন ধর্মের যোগসুত্র খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন। তাঁদের জিজ্ঞাসা, ভূচৌম্বকীয় তরঙ্গ থাকার জন্যেই কি কাসার দেবীতে বিরাজ করে নিশ্ছিদ্র শান্তি? চাপমুক্ত মন মেতে ওঠে অপার আনন্দে? প্রশ্নগুলির উত্তর দেবেন নাসার গবেষকেরা। কৌতুহলী মানুষদের ভরসা তাই বিখ্যাত লাইন দুটি।
যখন তুমি বিজ্ঞানকে জানবে, তখন তুমি ঈশ্বরকে বিশ্বাস করবে না।
যখন তুমি বিজ্ঞানকে বুঝবে, তখন তুমি ঈশ্বরকে দেখতে পাবে।
