
দ্য ওয়াল ম্যাগাজিন ব্যুরো: প্রাচীনকাল থেকেই বাংলায় পৌরানিক চরিত্র ও দেবদেবীর নামে নবজাতক বা জাতিকার নাম রাখার রীতি প্রচলিত। এই বিষয়ে দেবীদের মধ্যে এগিয়ে আছেন দুর্গা, লক্ষ্ণী ও সরস্বতী। দেবতাদের মধ্যে এগিয়ে আছেন মহাদেব, শ্রীবিষ্ণু, কার্তিক ও গণেশ। ভগবান শ্রীবিষ্ণুর আর একটি নাম হল ‘হরি’। এই ‘হরি’ নামটির সঙ্গে অন্য কোনও শব্দ যুক্ত করে, বাঙালি নবজাতকের নাম রেখে আসছে শত শত বছর ধরে।
হরিপ্রসাদ, হরিমাধব, হরিহর, রামহরি, এরকম কত সহস্র নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন শ্রীহরি। কিন্তু এই নামগুলির মধ্যে আছে এমন একটি নাম, যা একসময় নবজাতকের নাম হিসেবে অত্যন্ত জনপ্রিয় হলেও, আজ প্রায় ব্রাত্য। নামটি হলো ‘হরিদাস’। অথচ এই নাম নিয়ে, আজও বাঙালির হৃদয় জুড়ে আছেন বৈষ্ণব সাধক যবন হরিদাস। মহাপ্রভুর কৃপাধন্য সেই সাধক, যিনি দিনে তিন লক্ষবার কৃষ্ণ নাম জপ করতেন।
শ্রীল হরিদাস ঠাকুর (যবন হরিদাস)
আজ কেন ব্রাত্য ‘হরিদাস’
বর্তমান যুগে ‘হরিদাস’ নামটির অর্থ শ্রীহরির দাস নয়, জীবনের ময়দানে সর্বক্ষেত্রে অসফল এক মানুষ। ন’কোটি মানুষের বাংলায়, ঘণ্টায় অন্তত কয়েক হাজার বার উচ্চারিত হয় এই নামটি। বাংলার পথে মাঠে ঘাটে সামান্য মন কষাকষি বা বিতর্কের স্ফুলিঙ্গ দেখা দিলেই, যুযুধান দুই পক্ষের ঠোঁটের ডগায় উঠে আসে একটি বাক্য, “তুমি কোন হরিদাস পাল?”
গত পাঁচ ছয় দশক ধরে কোনও মানুষকে ইচ্ছাকৃতভাবে অযোগ্য ও তুচ্ছ বোঝাতে, দ্বিধাহীনভাবে বাঙালি ব্যবহার করেছে ‘হরিদাস পাল’ নামটিকে। কাউকে ‘হরিদাস পাল'(Haridas Pal) বললেই বক্তব্যটির সত্যতা বোঝা যাবে। ব্যাপারটি এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, পাল উপাধিধারী কোনও পরিবার নবজাতকের নাম হরিদাস রাখা প্রায় বন্ধই করে দিয়েছেন। যাতে নবজাতককে তার নামের জন্য সারাজীবন সমাজের তাচ্ছিল্য না কুড়োতে হয়।
কিন্তু হরিদাস পাল আদৌ অসফল ছিলেন না
একটু ভাবলেই আমরা বুঝতে পারব, “তুমি কোন হরিদাস পাল?” কিংবা “কে তুমি হরিদাস পাল এলে ভাই?”, ইত্যাদি অবজ্ঞাসূচক বাক্যবন্ধের মাধ্যমে আমরা সামনের ব্যক্তিকে তুচ্ছ করলেও, এক অজানা ব্যক্তির অসামান্য ক্ষমতার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করি। যাঁর নাম হরিদাস পাল। সর্বজন শ্রদ্ধেয় এক মানুষ। যিনি অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারতেন। যেকোনও কাজে যাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ছিল প্রশ্নাতীত। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছে যিনি ছিলেন কল্পতরু।
“তুমি কোন হরিদাস পাল?” বাক্যটির মাধ্যমে আসলে একজন মানুষকে বলা হয়, তুমি সেই হরিদাস পাল নও, যিনি তোমার জায়গায় থাকলে সমস্যাটির সমাধান করে দিতেন। কিংবা তুমি সেই হরিদাস পাল নও, যে তোমাকেও সম্মান দিতে হবে সেই মানুষটির মতো। এভাবেই আমরা প্রতিনিয়ত ‘হরিদাস পাল’ নামটি ব্যবহার করে, অজানা কোনও হরিদাস পালকে মহিমান্বিত করে চলেছি নিজের অজান্তেই।
কে সেই হরিদাস পাল!
কেউ বলেন এই হরিদাস পাল একটি কাল্পনিক চরিত্র। কারণ বাঙালির ইতিহাসে এই মানুষটির জীবন কাহিনির খোঁজ মিলবে না। অপরপক্ষের মতবাদ হল, গত পাঁচ-ছয় দশক ধরে বাঙালির বুলিতে পাকাপাকিভাবে জায়গা করে নেওয়া মানুষটি ছিলেন রক্ত মাংসেই গড়া। কারণ এরকম অনেক মানুষের নামই বাঙালি চলতি কথায় ব্যবহার করে, যাঁরা ছিলেন বাস্তব জগতের মানুষ। যেমন ‘হরি ঘোষের গোয়াল’ বাগধারাটির মধ্যে থাকা হরি ঘোষ, বাস্তব জগতের মানুষ ছিলেন। বাগবাজারে ছিল তাঁর গোয়াল। প্রচুর গরু থাকত সেই গোয়ালে।
আরও পড়ুন:
কিন্তু কে সেই বাস্তবের হরিদাস পাল! প্রশ্নটি নিয়েও বিতর্ক চলছে যুগের পর যুগ। দু’জন হরিদাস পালকে এ যাবৎ খুঁজে পেয়েছে বাঙালি। ভাগ্য যাঁদের নিয়ে এসেছিল কলকাতায় (Kolkata)। দু’জন হরিদাস পালই, কিংবদন্তির হরিদাস পাল হওয়ার যোগ্যতা রাখতেন। ফলে তাঁদের মধ্যে কে কিংবদন্তির ‘হরিদাস পাল’ তা নিয়ে আজ অবধি কোনও সিদ্ধান্তে আসা যায়নি। তবুও আসুন, চিনে নিই দুই হরিদাস পালকেই।
রিষড়ার হরিদাস পাল
হুগলির রিষড়া এলাকার এক গন্ধবণিক পরিবারে, ১৮৭৬ সালে জন্মেছিলেন হরিদাস পাল যুগলের মধ্যে সব থেকে বিখ্যাত হরিদাস পাল। নিতাইচরণ পালের পরিবারে জন্ম নেওয়া হরিদাস পালের সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিল দারিদ্র। তাই ষোল বছর বয়সে কাজ নিয়েছিলেন কলকাতার শোভাবাজা এলাকার একটি সোনার দোকানে। মাইনে ছিল অতি সামান্য। তাতে সংসার চলত না। একসময় ঋণের ফাঁদে পড়ে শেষ হতে বসেছিলেন। কিন্তু অভাবনীয়ভাবে একদিন ঘুরে গিয়েছিল ভাগ্যের মোড়।
হরিদাস পালকে তাঁর সুবিশাল সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী করে, প্রয়াত হয়েছিলেন তাঁর নিঃসন্তান মামা। রাতারাতি ধনকুবের হয়ে গিয়েছিলেন, ঝাঁপ তুলে সোনার দোকানে ঝাঁট দেওয়ার কর্মী হরিদাস পাল। পেল্লায় দোকানঘর কিনে ফেলেছিলেন বড়বাজারে। বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিটে কিনে ফেলেছিলেন প্রাসাদোপম বাড়ি। শুরু করেছিলেন বিদেশি কাচ ও লণ্ঠনের ব্যবসা।
সাফল্যের মুখ দেখেছিলেন ব্যবসাতেও। ব্যবসা প্রসারিত হয়েছিল গুয়াহাটি সহ ভারতের অন্যান্য শহরে। বিপুল বিত্তশালী হওয়া সত্ত্বেও এই হরিদাস পাল ছিলেন সৎ ও দয়ালু। আমরা দানবীর হাজি মহম্মদ মহসীন ও দানবীর আলামোহন দাসের নাম জানি। কিন্তু দানের দিক থেকে এই হরিদাস পাল সেই উচ্চতায় পৌঁছতে না পারলেও, সমাজের স্বার্থে একসময় প্রচুর অর্থব্যয় করেছিলেন। গড়ে তুলেছিলেন প্রচুর দাতব্য প্রতিষ্ঠান ও অবৈতনিক শিক্ষা কেন্দ্র। জনশ্রুতি আছে, তাঁর কিছু বাড়িও দুঃস্থদের দান করে গিয়েছিলেন এই হরিদাস পাল।
রিষড়া থেকে কলকাতায় আসা এই হরিদাস পাল, প্রয়াত হয়েছিলেন ১৯৩৩ সালে। কিডনির অসুখে ভুগে মাত্র সাতান্ন বছর বয়সে বিদায় নিয়েছিলেন প্রভাবশালী মানুষটি। ১৯৬৫ সালে, এই হরিদাস পালের সম্মানার্থে, কলকাতা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন, বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট ও মহাত্মা গান্ধী রোডকে সংযুক্ত করা কলেজ লেনের নাম দিয়েছিল হরিদাস পাল লেন।
হরিপুরের হরিদাস পাল
ঊনবিংশ শতকের এই হরিদাস পাল ছিলেন বাংলাদেশের হরিপু্রের বাসিন্দা। হরিপু্রের হরিদাস পাল কিন্তু রিষড়ার হরিদাস পালের মতো প্রথম জীবনে দারিদ্রের সম্মুখীন হননি। কারণ সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্ম হয়েছিল তাঁর। হরিপু্রের হরিদাস পালের পূর্বপুরুষেরা ইংরেজদের মোসাহেবি করে প্রভুত সম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন। স্ফূর্তি করতে নিয়মিত কলকাতায় আসতেন তাঁরা। বিভিন্নভাবে টাকা উড়িয়ে ফিরে যেতেন হরিপুরে।
হরিপুরের হরিদাস পালের ওপরেও তাঁর পূর্বপুরুষের এই বদগুণগুলির প্রভাব ফেলেছিল। প্রচুর অর্থ নিয়ে হরিদাস পাল, হরিপুর থেকে পাকাপাকিভাবে চলে এসেছিলেন কলকাতায়। কিনেছিলেন প্রচুর স্থাবর সম্পত্তি। শুরু করেছিলেন নানান ব্যবসা। দু’হাতে অর্থ বিলিয়ে প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিলেন কলকাতায়। কিন্তু ভোগবিলাস ও দান খয়রাতে ব্যস্ত থাকায়, ব্যবসাগুলির গণেশ উল্টে গিয়েছিল। একেবারে নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলেন হরিপুরের হরিদাস পাল। নিঃস্ব হরিদাস পালকে কেউ আগের মতো মান্য করত না। সমস্ত সুনাম ও সম্মান হারিয়ে ফেলেছিলেন প্রভাবশালী এই মানুষটি। নানান অসুখে হারিয়ে ফেলেছিলেন শরীর ও স্বাস্থ্য। চিকিৎসা করার মতো অর্থও তাঁর কাছে ছিল না শেষজীবনে।
আরও পড়ুন: মৃত্যুর পর বৃক্ষ হয়ে বেঁচে থাকবেন প্রিয়জনেরা, স্বপ্নে নয় বাস্তবের অরণ্যে
বাংলাদেশের লেখক ডক্টর মোহাম্মদ আমীন, ‘হরিদাস পাল কে ছিলেন : কেন প্রবাদে হরিদাস এলেন’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছিলেন হরিপুরের হরিদাস পালের একটি কাহিনি। অসুস্থ শরীর নিয়ে হরিপুরের হরিদাস পাল একদিন গিয়েছিলেন তাঁর এক প্রাক্তন কর্মচারীর কাছে। সাহায্য পাওয়ার আশায়। কিন্তু তাঁর স্বাস্থ্য তখন এতটাই ভেঙে গিয়েছিল, সেই কর্মচারী হরিদাস পালকে প্রথমে চিনতে পারেননি। তখন হরিদাস পাল তাঁর পরিচয় দিয়ে, প্রাক্তন কর্মচারীর কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন।
কিন্তু সুনাম হারানো ও নিঃস্ব প্রাক্তন মালিকের কথা পাত্তাই দেননি সেই কর্মচারী। বিস্মিত হরিদাস পাল বলেছিলেন, “এক সময় তুমি আমার কথা শুনতে।” তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বিরক্ত কর্মচারীটি বলেছিলেন,“তুমি কোন হরিদাস পাল, যে তোমার কথা এখনও শুনতে হবে?” কর্মচারীটি বোঝাতে চেয়েছিলেন, তুমি আর আগের মতো প্রভাবশালী হরিদাস পাল নেই, তাই তোমার কথা শোনার কোনও প্রয়োজন নেই। মাথা নিচু করে সেদিন ফিরে এসেছিলেন অপমানিত হরিদাস পাল। সেই হরিদাস পাল, একসময় কলকাতার বুকে যে সমস্যা যিনি তুড়ি মেরে সমাধান করে দিতেন।
এই ঘটনাটির পর থেকেই নাকি প্রথমে কলকাতা ও পরে সারা বাংলায় “তুমি কোন হরিদাস পাল” বাগধারাটি প্রচলিত হয়ে গিয়েছিল। তবে দুই হরিদাস পালের জীবন কাহিনি থেকে এটা স্পষ্ট, তাঁরা দু’জনেই ধনী, দাতা ও প্রভাবশালী ছিলেন। তাই তাঁরা জীবনের সর্বক্ষেত্রে অসফল ছিলেন, একথা বলা যাবে না। বরং গড়পড়তা বাঙালির থেকে অনেক ওপরেই ছিল তাঁদের অবস্থান। তবুও রঙ্গপ্রিয় বাঙালির নিদারুণ পরিহাসে, ‘হরিদাস পাল’ নামটি তার সাবেক গরিমা হারিয়ে, আজ হয়ে উঠেছে উপহাসের বস্তু। ‘অকর্মার ঢেঁকি’ বাগধারাটির সমার্থক।