
রূপাঞ্জন গোস্বামী
‘সম্ভোগ সে সমাধি’। অর্থাৎ যৌনমিলনের দ্বারাই সমাধিস্থ বা ধ্যানস্থ হওয়া সম্ভব। মোদ্দা কথা যৌনমিলনই মোক্ষলাভের মোক্ষম পথ। শুধু এই বুলি দিয়েই একসময় বিশ্বকাঁপিয়ে দিয়েছিলেন মধ্যপ্রদেশের চন্দ্রমোহন জৈন, যাকে বিশ্ব চেনে ভগবান রজনীশ ওরফে ‘ওশো’ বলে।
যিনি পৃথিবীর বৃহৎ ধর্মগুলির শিকড়ে সরাসরি কুড়ুল মেরে অক্লেশে বলে দিতে পেরেছিলেন ধর্ম হচ্ছে মানুষের তৈরি করা সবচেয়ে বড় মিথ্যা। ১৯৭০-১৯৯০ এই কুড়ি বছর বিশ্বের সকল ধর্মকে এবং আমেরিকা সহ বিশ্বের তাবড় তাবড় দেশের সরকারকে নাস্তানাবুদ করে দিয়েছিলেন জব্বলপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের প্রাক্তন অধ্যাপক শ্রী চন্দ্রমোহন জৈন ওরফে রজনীশ।
যিনি দুধসাদা সাদা দাড়ি চুমরে, কোটি কোটি টাকার হীরে বসানো টুপিতে টাক মাথা ঢেকে সাংবাদিকদের বলতে পারেন ‘I am spiritual playboy, what’s wrong ?’
পৃথিবীর সেরা সেরা ধনীরা তাঁর শিষ্য-শিষ্যা । যখন তাঁকে প্রশ্ন করা হতো,তাঁর ভক্তরা ধনী কেন? তাঁর সপাট উত্তর , সব মহাপুরুষ গরীবদের উদ্ধারের জন্য এসেছেন , আমি না হয় ধনীদের উদ্ধারের জন্যই রইলাম। ১৯৬০ সাল থেকেই সারা ভারত ঘুরে সমাজবাদ, মহাত্মা গান্ধী ও হিন্দু ধর্মের আদ্যশ্রাদ্ধ করতে থাকেন। ১৯৭০ সাল থেকে ৭৪ সাল পর্যন্ত মুম্বাইতে তাঁর মশালা ধর্মের বীজ বপন করে, চলে আসেন পুনেতে। তৈরি করেন ওশো ইন্টারন্যাশনাল মেডিটেশন রিসর্ট। ১৯৮১ সালে সটান চলে যান আমেরিকা। ওরেগনে গড়ে তোলেন নিজের পেল্লায় সাম্রাজ্য ‘রজনীশপুরম’। যৌনমুক্তির জ্বরে কাঁপতে থাকল আমেরিকা। আন্দোলনের নাম হলো Jivan Jagruti Andolan; Neo-sannyas। বাধাহীন যৌনতাই মুক্তির একমাত্র পথ, রজনীশের এই তত্ত্বের অভিঘাতে ভেসে গেল আমেরিকার উচ্চবিত্তমহল।
রজনীশপুরমে প্রতিদিন সফট মিউজিকের অনুষঙ্গে অনুচ্চ স্বরে নব্বই মিনিটে ওশো ব্যখ্যা করতেন তাঁর ধর্মের খোলসে, যৌনতার মশলা মাখানো অদ্ভুত সব তত্ব। যেটিকে উইকিপিডিয়া বলছে তান্ত্রিক যৌনতা। নিজের সম্মোহনী দৃষ্টি দিয়ে ভক্তর চোখের দিকে তাকিয়ে যখন কোনও ভক্তের কপাল স্পর্শ করতেন আঙুল দিয়ে, সেই ভক্তটির শরীরে নাকি পৃথিবীর সমস্ত প্রশান্তি প্রবেশ করতো। ‘ওশো’ বক্তৃতার পর উন্মুক্ত জায়গায় চেনা অচেনা নারীপুরুষ কালচে লাল আলখাল্লা পরে পরস্পরকে জড়িয়ে ধ্যানমগ্ন হতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তাঁর আশ্রমে অন্তর্বাস পরে প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিলো, কিন্তু উন্মুক্ত স্থানে যৌনতায় নিষেধ ছিল না।
হার্ড মিউজিকের সঙ্গে ভক্তদের উদ্দাম নৃত্যর পরিসমাপ্তি ঘটত বদ্ধকক্ষে ,সম্পূর্ন নগ্ন ও পরস্পরের কাছে অপরিচিত কয়েকশ জোড়া নারী পুরুষের উদ্দাম যৌনসঙ্গমে।এই পদ্ধতি নাকি মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভুলিয়ে দিয়ে মানুষকে আধ্মাত্মিক মোক্ষের পথে নিয়ে যায়। মানুষকে ত্যাগের পথে নিয়ে যায়। রাগ, হিংসা, ক্ষোভ, বিদ্বেষ নাকি জীবন থেকে উধাও হয়ে যায়। যৌনতা দিয়েই যৌনতার উর্ধে ওঠা যায়। ক্রমাগত যৌনমিলন করতে করতে যৌনমিলনে অরুচি এসে যায়। তখন মানুষ কামনা বাসনাকে ঘৃনা করতে শেখে।ভক্তিবাদে ডুবে যায়।
রজনীশের আশ্রমে যে কেউ যখন ইচ্ছা যে কোনও চেনা অচেনা মানুষের সঙ্গে সঙ্গম করতে পারতেন। মাসে নব্বইটি অপরিচিত পার্টনারের সঙ্গেও যৌনমিলন করেছেন বলে জানিয়েছেন কোনও কোনও আশ্রমিক।
তাঁর আশ্রমে কেন এত যৌনতা? রজনীশ জবাব দিতেন ‘‘let sex be a playfulness, a fun, after the invention of pill it is not a problem”।
এই ভাবেই রজনীশ আমেরিকাতে অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন কাল্ট-ফিগার হয়ে গেছিলেন। উচ্চবিত্তরা ওশোর ভক্ত বলে আমেরিকার রাজনীতিবিদরা মুখে কিছু বলতে পারতেন না। রজনীশ খ্রীষ্টান ধর্মকে দুবেলা গাল পাড়ছেন, কিন্তু কিছু করার নেই চার্চ ও প্রশাসনের। হিপিকালচারের পরে এ ভাবে কেউ মার্কিন সমাজের গোড়া ধরে নাড়িয়ে দিতে পারেননি। দুর্ভেদ্য প্রতিদ্বন্দী সোভিয়েত রাশিয়াকে ভাঙতে চলা সুপার পাওয়ার আমেরিকা নিজেই তখন রজনীশের ধর্ম, সেক্স এবং ড্রাগের নিখুঁত ককটেলে কাত ।
আরও পড়ুনঃ ঠিক যে ভাবে খুন হয়েছিলেন মাইকেল জ্যাকসন
রজনীশ অবাধ সেক্সের সপক্ষে তো বলেই ছিলেন, ড্রাগসের সপক্ষে বলে হিপিকালচারকেই যেন ফিরিয়ে আনলেন
‘if you can not provide meditation , you should provide medicine ( পড়ুন ড্রাগস)”।
এছাড়াও তাঁর চিন্তাধারা ছিলো নিয়মবহির্ভূত, অদ্ভুত । রজনীশ মনে করতেন জাগতিক যন্ত্রনা কমাতে সব ধরনের প্রতিবন্ধী শিশুদের স্বেচ্ছামৃতু্র অধিকার দেওয়া উচিৎ। এছাড়াও জিনগত সমস্যা যুক্ত ভ্রুণের ক্ষেত্রে তিনি গর্ভপাতকে আবশ্যিক করতে চেয়েছিলেন।
রজনীশের বিখ্যাত টেন কম্যান্ডমেন্টস। যা তাঁর ভক্তরা মেনে চলেন।
১) কারওর আদেশ শুনোনা, যদি না সেটা তোমারও মনের কথা না হয়।
২) জীবন ছাড়া অন্য কোনো ঈশ্বর নেই।
৩) সত্য তোমার ভেতরেই আছে, অন্য কোথাও খুঁজোনা ।
৪) ভালোবাসাই প্রার্থনা।
৫) নিজেকে শূন্যতায় পরিণত করাই সত্যের দরজায় পৌঁছে যাওয়া। শূন্যতাই মোক্ষ ও লক্ষ। To become a nothingness is the door to truth. Nothingness itself is the means, the goal and attainment.
৬) জীবন হচ্ছে এখন এবং এখানেই ।
৭) সজাগ হয়ে বাঁচো।
৮) সাঁতার কেটোনা , ভেসে থাকো।
৯) প্রতিমুহূর্তে মরো, যাতে প্রতিমুহূর্তে নতুন হতে পারো।
১০) যেটা আছে সেটা খুঁজোনা, থামো এবং দেখো।
আরও পড়ুন ঃ রক্তের সম্পর্কেই অবাধ যৌনমিলন,নিস্তার নেই কোল্ট পরিবারের শিশুদেরও
তাঁর আমেরিকার আশ্রমের বৈভব ছিলো দেখার মতো। ওরেগনের অনুর্বর, কর্দমাক্ত, পড়ে থাকা ৬৪,২২৯ একর জমিতে গড়ে উঠেছিল ঝাঁ চকচকে রজনীশপুরম। নিজস্ব এয়ারপোর্ট,হোটেল,বার, রেস্টুরেন্ট, সুইমিংপুল, টেনিসকোর্ট , সিনেমাহল মানে আস্ত একটা শহর। নিরানব্বইটা দামি রোলসরয়েস হেলিকপ্টার, প্রাইভেট জেট কি ছিলোনা ধ্যান-সেক্স-ড্রাগের নেশায় বুঁদ ভক্তদের স্বঘোষিত ভগবানের। কিন্তু ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। স্থানীয় মানুষরা বাইরের লোকেদের উড়ে এসে জুড়ে বসা ও বেলেল্লাপনা মেনে নিতে পারল না। শুরু হলো প্রতিবাদ। জনসমর্থন পেয়ে এগিয়ে এলো স্থানীয় প্রশাসন। কেসের পর কেস খেতে লাগলো রজনীশপুরম। ১৯৮৪সালে এলো ওরেগন কাউন্টি নির্বাচন। স্থানীয় লোকেদের দাবিকে দাবাতে গেলে নির্বাচনে নিজেদের লোককে জেতাতেই হবে নইলে পাততাড়ি গোটাতে হবে রজনীশকে । পরীক্ষামূলক ভাবে পানীয় জলে ও খাবারে মেশানো হতে থাকে সালমোনেলা ব্যাকটিরিয়া যাতে প্রবল ডায়েরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বিরোধীপক্ষ পোলিং বুথে যেতে না পারে ভোটের দিন। শয়ে শয়ে লোক অসুস্থ হয়ে পড়তে লাগলো, মার্কিন গোয়েন্দা বিভাগ নেমে পড়লো তদন্তে। ফাঁস হয়ে গেলো রজনীশের চক্রান্ত যা ‘1984,bioterror attack’ নামে বিখ্যাত।
একই সঙ্গে রজনীশপূরমের সেকেন্ড ইন কম্যান্ড ‘মা আনন্দশিলা’ দুজন আশ্রমিককে হত্যার চক্রান্তের কেস খেয়ে বসলেন।স্বপার্ষদ গ্রেপ্তার হলেন ‘ওশো’ রজনীশ।জামিনে ছাড়া পেলেও পাততাড়ি গোটাতে হলো। মার্কিন মুলুকথেকে বিতাড়িত হলেন স্বঘোষিত ভগবান রজনীশ।একুশটি দেশ তাদের দেশে ঢোকার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলো। অগত্যা রজনীশের ভারতে ফিরে আসা ১৯৮৫ সালে।পুনের আশ্রমটিকে নতুন করে গোছাবার কাজে নেমে পড়েছিলেন ভক্তরা। রজনীশের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হলো পুনেতে।মুম্বাইয়ের তৎকালীন সুপারস্টার বিনোদ খান্না, নায়িকা পারভীন ববি সিনেমা ছেড়ে রজনীশে মজলেন। বেশ ভালোই চলছিলো ‘সেক্স গুরু’ ‘রোলসরয়েস গুরু’ রজনীশের ডলার আমদানি।
পঞ্চান্নটি ভাষায় তাঁর অসংখ্য বইয়ের অনুবাদ থেকেও কামাই কম হচ্ছিল না। কিন্তু ১৯৯০ সালের ১৯ শে জানুয়ারি মাত্র ৫৮ বছর বয়েসে হার্টফেল করে মারা যান রজনীশ। কিছুটা আকস্মিক ভাবেই।
আমেরিকার জেলে থাকার সময় বলেছিলেন তাঁকে বিষ দেওয়া হচ্ছে “living in the body had become a hell”। আশ্রমিকরা বলেন রজনীশকে আমেরিকার গুপ্তঘাতকরা বিষ প্রয়োগ করেছিলেন।
মৃত্যুর পর তাঁকে পুনের আশ্রমস্থিত শয়নকক্ষেই সমাধিস্থ করা হয়। সমাধি বেদীতে লেখা হয়। “OSHO // Never Born // Never Died // Only Visited this Planet Earth between // Dec 11
1931 – Jan 1990″