শেষ আপডেট: 5th December 2024 13:37
দ্য ওয়াল ব্যুরো: 'হায় হায় সাতপাকে বাঁধা পড়ো না/ এক-দুটা পাক কম হলে মন্দ হবে না/ শোলার টুপি লোহার হবে এটা জেনে রেখো।' বাংলার ঝুমুর, ভাদু-টুসু গানের কিংবদন্তি গায়ক অংশুমান রায়ের একটি বিখ্যাত গানের সঙ্গে আজকের অনেকেই পরিচিত নন। কিন্তু, জীবনের কোনও না কোনও দিন সাতপাকে বাঁধা পড়েননি এমন লোকের সংখ্যা খুবই কম। আর বিয়ের বুকিংয়ের ওয়েটিং লিস্টে রয়েছেন, এমন সংখ্যা তো অগুনতি। কিন্তু জানেন কি কেন বিয়ের অনুষ্ঠানে সাতপাকে বাঁধা পড়তে হয়? কী রহস্য রয়েছে এর পিছনে?
মনুসংহিতা, মহাভারত ইত্যাদি কিছু গ্রন্থে আমরা ৬ থেকে ৮ ধরনের বিবাহের উল্লেখ পাই। এই ধরনগুলোর আদি উৎপত্তি খুব সম্ভবত বেদের 'কল্প' নামক সহায়ক থেকে। দর্শনগত দিকটি খুব সম্ভবত ষড়দর্শন এর পূর্ব মীমাংসা থেকে এসেছে। কল্পের সূত্রাকারের উপদেশগুলোর ব্যাখ্যা দিয়ে যে বইগুলো তা ধর্মসূত্র নামে পরিচিত। ব্যাখ্যাকার বিভিন্ন হওয়ায়, এলাকাভেদের কারণ থাকায় বিভিন্ন পদ্ধতি দেখা যায়। তবে গড়পড়তা বিয়ের পদ্ধতিগুলি মোটামুটি একই থেকে গিয়েছে।
ব্রাহ্ম বিবাহ- এখানে কন্যার পিতা যথাসাধ্য অলংকারাদি সহ কন্যাদান করে থাকেন। এটি হিন্দু বিয়ের সঙ্গে অধিকাংশ মিলে যায়। তবে ব্রাহ্মমতে বিয়ের কিছু ফারাক আছে প্রথাগত হিন্দু বিয়ের সঙ্গে।
আর্ষ বিবাহ- এখানে বর কন্যাপক্ষকে যথাসাধ্য দান করবেন।
দৈব বিবাহ- এখানে কোনও ঋষিকে কন্যাদান করা হয়।
গান্ধর্ব- এখানে পিতামাতার অনুপস্থিতিতেও শুধু মালাবদলের মাধ্যমে বিয়ে হয়।
আসুর- এখানে মেয়েকে বিয়ের জন্য কেনা হয়।
রাক্ষস- এখানে মেয়েকে অপহরণ করা হয়।
সাতপাকে বাঁধার অর্থ শুধু আগুনের চারপাশে ঘোরাই নয়, এই মুহূর্তে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতিও দিতে হয় একে অপরকে। সপ্তপদী অর্থাৎ একসঙ্গে সাতপাকে বাঁধা পড়ার সময় যা বলা হয়, তা হল-
প্রথম চরণ – ওঁ ইশে একপদী ভব, সা মামনুব্রতা। অর্থাৎ, প্রথম চরণ ফেলো, তুমি আমার অনুবর্তিনী হও। দ্বিতীয় চরণ – ওঁ উর্জে দ্বিপদী ভব, সা মামনুব্রতা ভব। অর্থাৎ, দ্বিতীয় চরণ ফেলো, সমস্ত কর্মে আমার অনুবর্তিনী হও। তৃতীয় চরণ– ওঁ রায়স্পোষায় ত্রিপদী ভব, সা মামনুব্রতা ভব। অর্থাৎ, ধনপুষ্টির জন্য তৃতীয় চরণ ফেলো, এবং তুমি আমার অনুবর্তিনী হও। চতুর্থ চরণ – ওঁ মায়োভব্যায় চতুষ্পদী ভব, সা মামনুব্রতা ভব। সুখলাভের জন্য তুমি চতুর্থ পদ ফেলো এবং তুমি আমার অনুবর্তিনী হও। পঞ্চম চরণ – ওঁ প্রজাভ্যঃ পঞ্চপদী, সা মামনুব্রতা ভব। অর্থাৎ, পুত্রবতী হওয়ার জন্যে পঞ্চম পদ ফেলো এবং তুমি আমার অনুবর্তিনী হও। ষষ্ঠ চরণ– ওঁ ব্রতেভ্যঃ ষট্ পদী ভব, সা মামনুব্রতা ভব। অর্থাৎ সকল ঋতুর জন্যে ষষ্ঠ পদ ফেলো এবং তুমি আমার অনুবর্তিনী হও। সপ্তম চরণ– ওঁ সখে সপ্তপদী ভব, সা মামনুব্রতা ভব। অর্থাৎ, সপ্তম পদ ফেলো এবং সখ্যে তুমি আমার অনুবর্তিনী হও।
অর্থাৎ সাদামাঠা বাংলায় প্রথম প্রতিশ্রুতি- বর তাঁর বউ এবং তাঁর ভাবী সন্তানদের যত্ন নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। বিনিময়ে কনেও প্রতিশ্রুতি দেন যে তিনি তাঁর স্বামী এবং তাঁর পরিবারের যত্ন নেবেন।
দ্বিতীয় প্রতিশ্রুতি- এবার বর প্রতিশ্রুতি দেন যে তিনি তাঁর স্ত্রীকে সবরকম পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করবেন। বিনিময়ে কনেও প্রতিশ্রুতি দেন যে তিনি স্বামীর সবরকম দুঃখ-কষ্টে পাশে থাকবেন।
তৃতীয় প্রতিশ্রতি- এবার বর প্রতিশ্রুতি দেন যে তিনি তাঁর পরিবারের জন্য রোজগার করবেন এবং তাঁদের দেখভাল করবেন। একই প্রতিশ্রুতি এবার কনেও করেন।
চতুর্থ প্রতিশ্রুতি- স্ত্রীর হাতে তাঁর পরিবারের সমস্ত দায়িত্ব তুলে দেওয়া এবং একইসঙ্গে স্ত্রীর সমস্ত মতামতকে গুরুত্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন বর। স্ত্রী তাঁর সমস্ত দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করার প্রতিশ্রুতি দেন।
পঞ্চম প্রতিশ্রুতি- যে কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে স্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করার প্রতিশ্রুতি দেন বর। স্বামীকে সমর্থন করার প্রতিশ্রুতি দেন স্ত্রী।
ষষ্ঠ প্রতিশ্রুতি- স্ত্রীর প্রতি সৎ ও সত্য থাকার প্রতিশ্রুতি দেন স্বামী। স্ত্রীও স্বামীর প্রতি সত্য থাকার প্রতিশ্রুতি দেন।
সপ্তম প্রতিশ্রুতি- শুধু স্বামী হিসেবেই নয়, বন্ধু হিসেবেও সারাজীবন স্ত্রীর সঙ্গে থাকার প্রতিশ্রুতি দেন বর। বিনিময়ে স্ত্রীও স্বামীর সঙ্গে জাবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত থাকার প্রতিশ্রুতি দেন।