নীলা গুরুং - টুমলিং
শেষ আপডেট: 19th June 2024 12:06
দ্রুত নামছে পারদ। খান তিনেক লেপের আদরেও ওম খোঁজার চেষ্টা বৃথা মনে হচ্ছে তখন। হঠাৎই কাঠের দরজায় ঠকঠক আওয়াজ। ঘড়ির কাঁটায় ন’টা হলেও পাহাড়ে তখন রাত গভীর। গরম জলের ফ্লাস্ক হাতে ধরিয়ে বেশ কিছুক্ষণ আগেই গুডনাইট বলে চলে গেছে মিষ্টি মুখের সেই মেয়েটা। কে তবে দরজা খোলার ডাক দিল আবার? ভাবতে ভাবতে খাট থেকে নেমে কাঠের দরজার হাতল ঘোরাতেই চমক। হাতে আরও অন্তত তিনটে কম্বল আর বালিশ নিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে হোমস্টের মালকিন (Tumling Nila Gurung)। আমার বারো বছরের ছেলের দিকে তাকিয়ে হিন্দিতে যা বললেন তার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়, “তোমরা তো তিনজন। কী করে কুলোবে তোমাদের এই বিছানায়? এই কম্বল-বালিশগুলো নাও। দেখো, যদি অসুবিধা হয় বলো, অন্য ঘর খুলে দিচ্ছি আমি।”
সত্যিই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আসলে খ্রিস্টমাস ইভের ভরা মরসুমে প্রায় ৯৫০০ ফিট উচ্চতায় এক পাহাড়ি গ্রামে মাইনাস তিন-চার ডিগ্রি তাপমাত্রায় যতটা ভিড় হওয়া সম্ভব তার পুরোটাই তো রয়েছে টুমলিঙে নীলাদির (Tumling Nila Gurung) আশ্রয়ে। তারপরেও? সন্ধেবেলা ডিনারে যখন বুফেতে সাজানো মুচমুচে বাটার নান, চিকেন কষায় ডুবিয়ে মুখে তুলছি, মনে হচ্ছিল মেগাসিটির কোনও রেঁস্তোরা। অবাক হয়েছিলাম। এই অবাক হওয়ারই যে আরও বাকি ছিল, সেটাই বুঝলাম রাত গভীরে। দরজায় দাঁড়ানো বছর পঞ্চান্নর নীলার (Tumling Nila Gurung) মুখে তখন যেন আলো হয়ে খেলে বেড়াচ্ছে একরাশ মায়া।
সান্দাকফুর পথে পা বাড়ানোর আগে সমতলেই শুনেছিলাম ‘নীলাদি’ (Tumling Nila Gurung) নামটা। কানে এসেছিল তাঁর হাতে তৈরি মাখন, মোমো, করলা ভাজি আর তেঁতুলের চাটনির সুখ্যাতি। তবে ছোট্ট গ্রাম টুমলিং এর পরিচিতিটাই যে এ ভাবে জড়িয়ে গেছে তাঁর নামের সঙ্গে, জানার বাকি ছিল পুরোটাই। ট্রেকিংয়ের ধকল নেবে না শরীর, তাই মানেভঞ্জন থেকে সান্দাকফু পৌঁছোতে আমাদের ভরসা ছিল ল্যান্ড রোভার। তবে এ দুর্গম পথে দেশি বিদেশি ট্রেকাররাই দলে ভারী। আর টুমলিঙের ‘নীলাদি’কে চেনেন না, তাঁদের মধ্যে খুঁজে পাইনি তেমন একজনকেও। চিত্রে, মেঘমা, টুমলিং, গৌরিবাস, কালিপোখরি হয়ে পৌঁছেছিলাম এ রাজ্যের সব থেকে উঁচু জায়গা সান্দাকফুতে। যাওয়ার পথেই টুমলিঙে নজর টেনেছিল নীলা গুরুঙের (Tumling Nila Gurung) হোমস্টে। মেঘের কোলে স্বপ্নের বাড়ি যেন। তখন শুধুই চোখে দেখা। কারণ আমাদের সেখানে থাকার কথা সান্দাকফু থেকে ফেরার সময়।
দু’দিন ছিলাম আমরা সান্দাকফুতে। নামার দিন সকাল সকাল রওনা হলেও বরফে ঢাকা পথের ঝক্কিতে টুমলিং পৌঁছোতে বেলা কাবার। আমাদের সাতজনের দলের জন্য বরাদ্দ ঘরগুলি দেখিয়ে দিয়েই স্মিতমুখে নীলা (Tumling Nila Gurung) বললেন, “আলুভাজাটাই শুধু তৈরি হচ্ছে। বাকি সব রেডি। চলে আসুন। লাঞ্চ করেই বেরিয়ে পড়ুন। টুমলিং এর সূর্যাস্ত কিন্তু খুব সুন্দর।”
তাঁর রান্নাঘরের বারান্দায় সেই প্রথম দেখা নীলা গুরুঙের (Tumling Nila Gurung) সঙ্গে। ট্রেকারদের মুখে মুখে সমতলেও যাঁর নাম ছড়িয়ে পড়েছে, সেই নীলাদি। সুন্দর খাওয়ার জায়গায় তাঁর সাজানো ছবিও ততক্ষণে নজরে এসেছে। সে ছবিতে পর্যটনশিল্পকে সমৃদ্ধ করার জন্য প্রত্যন্ত পাহাড়ের এক মহিলাকে সম্মান জানাচ্ছে ইস্টার্ন হিমালয়া ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুর অপারেশন অ্যাসোসিয়েশন। হিমালয়ের কোলে টুমলিং নামের ছোট্ট গ্রামটার সঙ্গেই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা এই মানুষটাকে নিয়ে কৌতূহল হয়েছিল খুব। সন্ধে নামতেই কড়া ঠান্ডার কামড়। গনগনে চুল্লির আঁচে গা সেঁকতে সেঁকতে মুখোমুখি হয়েছিলাম তাঁর (Tumling Nila Gurung)। পাহাড়িয়া এক গ্রামের আদ্যোপান্ত সাধারণ এক মেয়ের এমন সফল একজন এন্টারপ্রেইনার হওয়ার গল্পটা ঠিক যেন টুমলিঙের মতোই মোহময়।
“১৯৮৬ সাল। সুবাস ঘিসিং এর নেতৃত্বে গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে আন্দোলন চলছে তখন। পাহাড় জ্বলছে। জায়গায় জায়গায় ট্যুরিস্ট বাংলো পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সব। তখন এ রুটে ট্রেকাররাই সাধারণত আসতেন। আমাদের টুমলিঙে নয়, আরও খানিকটা উঠে গিয়ে জাউবাড়ি ছিল তাঁদের জিরিয়ে নেওয়ার ঠিকানা। একদিন বিকেলে ঘরের বাইরে বসে আছি। দেখলাম আস্তে আস্তে উঠে আসছেন এক বিদেশি দম্পতি। পরে জানলাম ইটালিয়ান। খুঁড়িয়ে হাঁটছিলেন ভদ্রমহিলা। পাহাড়ি পথে হাঁটতে গিয়ে পড়ে গিয়ে চোট পেয়েছিলেন পায়ে। তাঁকে থাকতে দিয়েছিলাম আমাদের বাড়িতে। হাঁটার ক্ষমতা ছিল না। তাই প্রায় সাতদিন আমাদের বাড়িতে রেখে সেবা করে ভাল করে তুলেছিলাম।” শুরুর গল্পটা জানতে চাইতেই অতীতে ডুব দিয়েছিলেন টুমলিঙের নীলাদি (Tumling Nila Gurung)। স্মৃতি হাতড়ে তুলে আনছিলেন ফেলে আসা সময়। “ওই ইটালিয়ান লেডিই বলেছিলেন, তুমি এত সেবাপরায়ণ। একটা হোমস্টে চালু করো না। এই দুর্গম পথে এমন ভালবাসা পেলে তো আমরা ট্রেকাররা বর্তে যাই।” সাড়ে চার বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছিলেন নীলা গুরুং (Tumling Nila Gurung)। পোষ্য কয়েকটা ইয়াক আর ছাগলের দুধ বিক্রি করে সন্তানদের মানুষ করেছিলেন তাঁর মা। দার্জিলিং উইমেনস কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশনের পর তখন জৌবাড়িতে একটা স্কুলে পড়াচ্ছেন নীলা। হোমস্টে করার ভাবনা নেই কল্পনাতেও। বললেন, “ওই ইটালিয়ান লেডির অনুপ্রেরণাতেই বাড়ির দু’টি ঘরে অতিথিদের থাকার ব্যবস্থা করলাম। এ পথে আসা ট্রেকারদের দাবিতে তারপর আরও ঘর বাড়ল। ধীরে ধীরে সে ঘর আরও সুন্দর করে সাজিয়ে তুললাম।”
সকালে স্কুলের ছোট বাচ্চাদের পড়ানো আর বিকেলে বাড়ি ফিরে অতিথিদের দেখভাল এটাই তখন তাঁর রুটিন। তাঁর কথায়, “তখন তো আর এ পথে ট্যুরিস্ট বিশেষ ছিলেন না, যাঁরা আসতেন তাঁদের সবাই দিনভর পাহাড় চড়ে বিকেলে এসে আশ্রয় চাইতেন। রাতটুকু থেকে সকাল হলেই ফের রওনা হতেন। তাই তাঁদের দেখভালের পাশাপাশি পড়ানোর কাজ সামলাতে অসুবিধা হত না কোনও। বাড়িতে আমার দিদিও রয়েছেন। দু’জনে মিলে সামলেছি।” (Tumling Nila Gurung) এ ভাবেই কবে যে কেটে গেছে ৩৩ বছর, টের পাননি। এখন স্কুলের চাকরি থেকে ছুটি মিলেছে। এ দিকে হিমালয়ের আকর্ষণে টুমলিঙের পথে ভিড়ও বাড়ছে প্রতিদিন। টুমলিঙে এসে অতিথিদের যত্নআত্তিতে যাতে কোনও খামতি না থাকে সেদিকেই সতর্ক নজর তাঁর। শুরুতে পথশ্রমে ক্লান্ত ভাগ্যবান দু’জন মাত্র থাকার সুযোগ পেতেন। এখন নীলার অনুপ্রেরণায় তাঁরই আত্মীয়-স্বজন-পড়শিদের আরও বেশ কয়েকটি হোমস্টেতে আড়াইশো জনকে জায়গা দিতে পারে মেঘছোঁয়া এই গ্রাম। (Tumling Nila Gurung) নীলার (Tumling Nila Gurung) কথায়, “আগে বিষয়টা অনেক সহজ ছিল। শুধু ট্রেকাররা আসতেন। রাতের মতো আশ্রয় নিতেন। ন্যূনতম পরিষেবাতেই চলে যেত তাঁদের। কিন্তু এখন ট্যুরিস্টরাও আসছেন। খাবার বা আশ্রয়, দু’টোই মনমতো চাই তাঁদের। তাই আমাদের দায় ও দায়িত্ব দু’টোই বেড়েছে।”
এতসব সামলাতে গিয়ে আর ফিরে দেখা হয়নি নিজের দিকে। নিজের সংসার পাতার সময়ও গেছে ফুরিয়ে। এখন দিদির সন্তানরাই তাঁর ভরসা। হঠাৎই ছায়া ঘনায় নীলা গুরুঙের (Tumling Nila Gurung) মুখে। চুল্লির আগুনের আধো অন্ধকারে যা নজর এড়ায় না। “ওরা তো এই জেনারেশন। এই পাহাড়, এমন নির্জনতা ওদের না-পসন্দ। হোমস্টে চালাতে ওরা ইচ্ছুক নয়। দিনে কালে হয়তো বিক্রিই করে দিতে হবে সব।” সেই মানসিক প্রস্তুতি নেওয়া শুরুও করে দিয়েছেন নীলা (Tumling Nila Gurung)। তবে তা তো শুধুই হোমস্টে। টুমলিঙের কথা উঠতেই ফের উজ্জ্বল হয়ে উঠল নীলা গুরুঙের চোখ মুখ। “জানেন, একদিন এক বিদেশি অতিথি আমায় বলেছিলেন, আচ্ছা, ভারতের দিকটা এত হরাভরা (সবুজ) আর নেপালের দিকটা এত রুক্ষ কেন? এরপরেই আমি দু’কিলোমিটার এলাকায় পঞ্চাশ হাজার রডোডেনড্রনের চারা বসিয়ে দিয়েছি। বেড়ে উঠছে সেই গাছ। ফুলের মরসুম এলে রঙিন হয়ে উঠবে গোটা তল্লাট। কে বলবে তখন যে রঙ নেই আমার গ্রামে?” কাচের জানলা ভেদ করে দূরের পাহাড়ে ধাক্কা খাচ্ছে নীলার (Tumling Nila Gurung) দৃষ্টি। ঘোর কালো আকাশে তখন দিশা দেখাচ্ছে ঝকঝকে শানিত কালপুরুষ।